পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। হউক সেটা সড়ক কিংবা নদী পথে। রেল কিংবা আকাশ পথে। বিল্ডিং ধ্বসে কিংবা বিল্ডিং থেকে পড়ে গিয়ে। পানিতে ডুবে কিংবা আগুনে পুড়ে। যেকোন ভাবেই হোক, একেকটি ঘটনা বহু জীবনের বিনাশ ঘটায়। অসংখ্য তাজাপ্রাণ মুহুর্তে লাশ হয়ে যায়। কতো মানুষকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। কতো পরিবারের একমাত্র উপাজর্ননকারী ছেলেটি এখন পঙ্গু হয়ে আছে। হাত, পা ভেঙে কতো মানুষের কর্ম থেমে গেছে। কতো শিশুর বাবাকে কেড়ে নিয়েছে দুর্ঘটনা। কেড়ে নিয়েছে কতো সন্তানের মাকে। কতো বাবা-মা হারিয়েছেন আদরের সন্তানকে। কতো ভাই বোনকে, বোন ভাইকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে হারিয়েছে। এসবের সঠিক হিসাব নেই। সড়ক ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই অগ্নিদগ্ধ মানুষের আহাজারি শোনা যায়। মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, স্বামী, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন হারানো মানুষের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রতিদিন অগ্নিদগ্ধ ও পঙ্গুত্বের সীমাহীন যন্ত্রণার সঙ্গী হচ্ছে অগণিত মানুষ। পরিবারের একমাত্র রোজগার ব্যক্তিটিকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে পথের দ্বারে নেমে আসতে হয়েছে সম্ভাবনাময় বহু পরিবারকে। দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের স্বজন ও ভুক্তভোগীরাই বুঝে জীবনের যন্ত্রণা।
এ যন্ত্রণার কোন কমতি নেই। দিন দিন বেড়েই চলছে। ২০২১ সালে সড়ক দূর্ঘটনার একটি পরিসংখ্যান গত কয়েক দিনের দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২১ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৩৭১ টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬২৮৪ জন। আহত হয়েছেন ৭৪৬৮ জন। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। তাছাড়া গত বছর করোনার কারণে ৮৫ দিন গণপরিবহণ বন্ধ ছিল। এই দিনগুলো বাদ দিলে গড়ে দৈনিক ২২ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ৮০৩ জনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। সড়ক দুর্ঘটনা হতাহতের যেসব তথ্য আমরা পাই, তা বিভিন্ন বেসরকারি কয়েকটি গবেষণা সংস্থার তৈরি করা। তারা এসব তথ্য বিভিন্ন মিডিয়া থেকে সংগ্রহ করে প্রদিবেদন তৈরি করে। উপরের তথ্যটি রোড সেফটি ফাউন্ডেশন তৈরি করেছে। জানা গেছে, সরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। দেশে প্রতিদিন সড়কে অধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ আহত-নিহত হচ্ছেন। দেশের মানবসম্পদ ও অর্থসম্পদের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে; তবু কেন সরকারিভাবে এর হিসাব সংরক্ষণ করা হচ্ছে না, তা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশে আরো অসংখ্য দুর্ঘটনার খবর মিডিয়ায় আসে না। যদি সারাদেশের সকল দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা হতো, তাহলে এ সংখ্যা আরো তিন চার গুণ বেশি হতো। এছাড়া লঞ্চ ও ট্রেন দুর্ঘটনা এবং অগ্নিকাÐের মর্মান্তিক ঘটনায় বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। যেই পানি দিয়ে আগুন নেভানো হয় সেই পানিতে ভাসমান লঞ্চে রাতের অন্ধকারে ঘটে গেল এক ভয়াবহ অগ্নিকাÐের ঘটনা। সেদিন সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ নামক বহুতল লঞ্চটিতে পাঁচ শতাধিক যাত্রী ছিলেন। এর মধ্য থেকে শতাধিক নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরো অনেকে। ধারণা করা হচ্ছে, নিখোঁজ সকলেরই সলিলসমাধি হয়েছে।
একটি দিনও নেই যেদিন কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে না। আমরা প্রতিদিন দুর্ঘটনার সংবাদ পড়ি। গণমাধ্যমগুলোতে রক্তে-রঞ্জিত, ক্ষত-বিক্ষত লাশের চিত্র ভিডিও দেখি। দেখি দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ছবি। আগুনে পুড়ে যাওয়া জীবন ও আসবাবপত্রের ছাই বা ধ্বংসাবশেষ দেখি। একেকটি দুর্ঘটনার বিবরণ পড়ে বা চিত্র দেখে চোখের পানি ফেলি। হা-হুতাশ করি। দুই-চার কথা বলি। এতেই কী দায়-দায়িত্ব শেষ? কেন ঘটছে এসব ঘটনা? সবই কি দুর্ঘটনা? সড়কে মৃত্যুর মিছিল কেন থামছে না? এতে কি কারো মাথা ব্যাথা আছে? কেউ কি আছেন নিয়ন্ত্রণ করার? সড়ক আইন থাকার পরেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না কেন? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব ঘটনা কেবলই দুর্ঘটনা নয়। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক যখন লক্কড়ঝক্কড়, মেয়াদ উত্তীর্ণ আনফিট গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চালায়, তখন দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ঝুকিপূর্ণ বাসভবন, খানা-খন্দে ভরা সরু পথ, ত্রæটিপূর্ণ ব্রীজ, ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ, ত্রæটিপূর্ণ লঞ্চ-বিমান, অতিরিক্ত যাত্রী, ট্রাফিক আইন মানার প্রতি উদাসিনতা, মানুষের অসচেতনতা, প্রতিহিংসা, কে কার আগে যাবে এমন অশুভ প্রতিযোগিতা, চালকদের মাদক সেবনসহ দুর্ঘটনার আরো অনেক কারণ রয়েছে। যতদিন এসব সমস্যার সমাধান না হবে, ততদিন সুশৃঙ্খল সড়ক আশা করা যায় না।
জানা গেছে, বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা নেয়া হয় না। আর যেসব মামলা নেওয়া হয়, তাও নানা অদৃশ্য কারণে বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নিস্পত্তি হয় না। সড়ক আইনে কঠোর শাস্তির বিধান না থাকা, বিধান থাকলেও তা প্রয়োগে শিথিল মনোভাব পোষণ করা- এসব কারণেই কী চালকরা এতো বেপরোয়া?
সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। শিক্ষার্ধীরা সহপাঠীদের হারিয়ে বিভিন্ন সময় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে রাজপথে নেমেছে। রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল। তখন ছাত্ররা দেখিয়ে দিয়েছিল সড়কের অনিয়মগুলো। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন সরকারের নানা প্রতিশ্রæতির পর বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু সড়কে বিশৃঙ্খলা বন্ধ হয়নি। সরকার আইন পাস করে। কয়জন তা মানে? ঘাতকরা আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। ধর্মঘটের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তাদের কাছে রেহাই পায়না অ্যাম্বুলেন্সের রোগীও। ওরা ঘটনা-দুর্ঘটনায় ফেলে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। নেতা, আমলা আর আইনের ফাঁক দিয়ে তারাও পার পেয়ে যায় অনেক সময়। তাই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে আরো কঠোর হওয়া দরকার।
ফিটনেসহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করা, দ্রæতগতি ও চালকদের অদক্ষতা-অসচেতনার ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো, চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার আগে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, সড়ক ও রেলপথ নিয়মিত চেকআপ করা, সরু পথ প্রশস্ত করা, ভাঙ্গা সড়ক ও ব্রীজ দ্রæত মেরামত করা প্রয়োজন। ট্রাফিক আইন মানার প্রতি ব্যাপকভাবে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। দায়িত্বশীলসহ সকল নাগরিক যদি নিজ থেকে সচেতন হন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলা অনেকাংশে কমে যাবে।
শিক্ষক : জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।