Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমার ও ভারতের নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০২ এএম

পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্র চীন-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতে বাংলাদেশ অনেকটা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকলেও ভারত ও মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের কারণে সামাজিক বিষ্ফোরণের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে। রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের গণহত্যা-গণধর্ষণের ঘটনাবলী ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার্য বিষয়ে পরিনত হয়েছে। বিচারের রায়ের ফলাফল যাই হোক, একটি পরিকল্পিত এথনিক ক্লিনজিং বা গণহত্যার দায় কখনো মুছে যায় না। নব্বইয়ের দশকে রুয়ান্ডায় হুতু মিলিশিয়াদের হাতে লাখ লাখ তুতসি সংখ্যালঘু মানুষ নিহত হওয়ার বেশ কয়েক বছর আগেই সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেখানে একটি বড় ধরণের সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাত ও গণহত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। রুয়ান্ডা গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার আগে যারা এর ভবিষ্যদ্বানি করেছিলেন, জেনোসাইড স্টাডিজ অ্যাকাডেমিসিয়ান ও জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডক্টর গ্রেগরি স্ট্যান্টন তাদের অন্যতম। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডিতে মাত্র কয়েক মাসের জাতিগত সংঘাতে ৫ লক্ষাধিক সংখ্যালঘু তুতসিকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই গ্রেগরি স্ট্যান্টন এবার ভারতে অনুরূপ মুসলিম গণহত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকে তিনি রয়ান্ডা ও মিয়ানমারের মুসলমানদের অবস্থার সাথে তুলনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টির জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক স্ট্যান্টন সম্প্রতি ‘কল ফর জেনোসাইড অফ ইন্ডিয়ান মুসলিমস’ শীর্ষক এক কংগ্রেসনাল ব্রিফিংয়ে ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার আশঙ্কার কথা পুর্নব্যক্ত করেন। ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল এই কংগ্রেসনাল ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। উল্লেখ্য, গুজরাট দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মুসলমান নিহত হওয়ার সময় ২০০২ সালেও গ্রেগরি স্ট্যান্টন ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সে সময় নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। দাঙ্গা ও মুসলিম গণহত্যা প্রতিরোধে তিনি কিছুই করেননি। দাঙ্গা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদিকে নিষিদ্ধও করেছিল। সেই নরেন্দ্র মোদি দিল্লীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার পটভূমি রচিত হতে শুরু করে। কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার, সেখানে যোগাযোগ বø্যাক-আউট, সামরিক বাহিনীর বিশেষ শাসন জারি করা, বিচারহীন গুম-খুনের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া এবং বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষি নাগরিকত্ব আইন চালুর ঘটনাকে সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও গণহত্যার পটভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ডক্টর গ্রেগরি স্ট্যান্টন।

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য বড় ধরণের হুমকি। ২০১৭ সালে বা গত দশকেই এই সংকট সৃষ্টি হয়নি। বৃটিশ-ভারতের ভূ-রাজনৈতিক কারসাজি এবং বার্মার সামরিক জান্তার বর্ণবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কৃত্রিমভাবে সমস্যাটিকে আজকের জটিল পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বার্মার পশ্চিমাংশে পর্বত ও নদীবেষ্টিত আরাকান রাজ্যটি বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পশ্চাদভূমি হয়ে ওঠার পেছনে হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। কথিত আছে, খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে বার্মা উপকূলে আরব বণিকদের জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর সাতরে আশ্রয় নেয়া লোকদের বংশধররাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। নাফ-নদীর অপর পাড়ে চট্টগ্রামেও তারা বসতি স্থাপন করেছিল। আরাকানের রোহিঙ্গাদের সাথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের লোকজ ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মিল থাকার কারণে বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে। আরাকানের সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের শত শত বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমা রয়েছে। আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাতে বিপর্যস্ত আরাকানের তৎকালীন ¤্র-উক স¤্রাট নারামেখলা পালিয়ে বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ’র কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রায় ২৪ বছর বাংলায় অবস্থানের ফলে নারামেখলা বাংলার মুসলিম সংস্কৃতির দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। অবশেষে সুলতানের সামরিক সহায়তায় নারামেখলা সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। নারামেখলা আরাকানের সিংহাসনে পুনরায় আরোহনের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আরবি মোহরাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা প্রবর্তন করেন। বাংলা থেকে নারামেখলার সাথে সৈনিক হিসেবে আরাকানে যাওয়া মুসলমানরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়েও আরাকানে বাঙ্গালি মুসলমানের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বাংলার সুলতান উপহার হিসেবে কিছু ভূমিও তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ এবং নারামেখলার মৃত্যুর পর নারামেখলার উত্তরসূরিরা বাংলার ত্রিপুরা ও কুমিল্লার কিছু অংশ দখল করে নিয়েছিল বলে জানা যায়। এভাবেই আরাকানের সাথে বাংলার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রাচীন ইতিহাসের গল্প রচিত হয়েছে। রোহিঙ্গারা হাজার বছর আগে বার্মার পশ্চিম উপকূলে বসতি গড়ে সেখানে তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। হাজার বছর পরে বাঙালি মুসলমান তকমা দিয়ে তাদেরকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করতে বৃটিশ-ভারত-পশ্চিমা ও বার্মিজ দূরভিসন্ধি রুখে দিতে না পারলে বাংলাদেশকে অনেক বড় ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। বৃটিশ ঔপনিবেশোত্তর সময় থেকে এ তৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান অগোছালো, পরিকল্পনাহীন ও অস্থিতিশীল।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন ভারতীয় মুসলমানদের অসামান্য (হিন্দুদের চেয়ে বেশি আত্মত্যাগ) ভূমিকা ছিল, একইভাবে ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনেও আরাকানের মুসলমান নেতাদের অসামান্য ভূমিকা ছিল। বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশের জাতীয় নির্বাচনে বেশকিছু মুসলমান নেতা নির্বাচিত হয়ে রাজনীতিতে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। বৃটিশরা তাদের সর্বশেষ সেনশাসনে বার্মিজ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির তালিকা থেকে আরাকানের মুসলমানদের বাইরে রাখার যে ষড়যন্ত্রমূলক দুরভিসন্ধি গ্রহণ করেছিল, তার প্রতিফলন হিসেবে সেখানে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিপীড়িন শুরু করে। ১৯৫৮ সালে প্রথম হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন থেকে পালিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে চলে এসেছিল। পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক উদ্যোগে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ রাখাইনে ফেরত নিতে বাধ্য হয়েছিল। বার্মিজ সামরিক জান্তার নিপীড়নে ১৯৭৮ সালে আবারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিলে জিয়াউর রহমানের শক্ত কূটনৈতিক ভূমিকার মুখে তাদেরকে ফেরত নিয়ে পুনর্বাসন করতে বাধ্য হয় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার। এরপর ১৯৮২ সালে বার্মায় নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করা হয়, যেখানে বার্মিজ নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের কোনো অবস্থানই স্বীকার করা হয়নি। হাজার বছর ধরে রাখাইনে বসবাস করে বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখার পরও শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় ভারতেও নতুন নাগরিকত্ব আইনের নামে বিভিন্ন রাজ্যের লাখ লাখ মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে ভারতের বিজেপি সরকার। এসব বিষয়কে মিয়ানমার বা ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে গণ্য করে বাংলাদেশের চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই। জাতিসংঘ ২০১৩ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ২০১৬ সালে জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যা শুরুর আগ পর্যন্ত কেউই এ বিষয়ে তেমন প্রতিবাদ বা প্রতিকারের ভূমিকা পালন করেনি। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উপর চীনের প্রভাব এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে পশ্চিমারা রোহিঙ্গা গণহত্যা ও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে মাঝে মধ্যে মৃদু স্বরে কথা বলতে শোনা যায়। তাদের মৌন সম্মতির কারণে ২০১৭ সালে গণহত্যার মুখে পালিয়ে আসা প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের মৌলিক মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের স্বীকৃতিসহ পুনর্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের কোনো শক্ত কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে রাজনীতি ও গলাবাজি করা ইউরোপীয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিনীরাও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেকটা দায়সারা কথাবার্তা বলেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে।

গণহত্যা ও গণধর্ষণ থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালের আগস্টে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মন রক্ষা করে প্রথমে ২৩ নভেম্বর দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি, অত:পর ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মাঠ পর্যায়ে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর আরো ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুই করা যায়নি। মাঝখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নানা ধরনের চরমপন্থী হুমকিসহ কিছু দ্বা›িদ্বক বিষয়ের প্রস্তাবও দেখা গেছে। মিয়ানমারের পাশে চীনের প্রতিপক্ষরা বাংলাদেশের সাথে একটি ঝামেলা পাকিয়ে তোলার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে বাংলাদেশ তাতে পা দেয়নি। প্রতিবেশিদের সাথে বন্ধুত্ব ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখতে বাংলাদেশের সদিচ্ছার মর্যাদা ভারত বা মিয়ানমার কখনো দেয়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়া নাকি রোহিঙ্গাদের সামরিক ট্রেনিং দিয়ে সীমান্তে পাঠানোর হুমকি দেয়ার পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসন করতে বাধ্য হয়েছিল। শান্তির জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা ও সক্ষমতা খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। একতরফা শান্তির প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা কখনো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে না। শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কখনো কখনো যুদ্ধই হতে পারে একমাত্র বিকল্পহীন সমাধান। যুদ্ধ সব সময় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমেই শেষ হয়না, কূটনৈতিক-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়েও বিজয় নিশ্চিত হতে পারে। সামরিক সংঘাত এড়াতে সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের দিকে মনোনিবেশ করা এখন সময়ের দাবী। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবাধিকার প্রশ্নে চীন-ভারত ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে কিছু বাহ্যিক মতবিরোধ থাকলেও তাদের পুনর্বাসন ও নাগরিকত্বের প্রশ্নে মৌনতার মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে অনেকটা অভিন্ন অবস্থানই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ধারণা করা যাচ্ছে, বড় ধরণের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ব্যতিরেকে, ফিলিস্তিন বা কাশ্মিরিদের মত রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানও খুব শীঘ্র হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরাসরি আক্রান্ত হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বিশ্ব সম্প্রদায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আনুসাঙ্গিক কার্যক্রমে বাংলাদেশকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। সরাসরি সম্পর্কযুক্ত না হলেও ভারতের এনআরসি ও বিজেপির মুসলমান বিদ্বেষী নানামাত্রিক তৎপরতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে অন্যতম টার্গেটে পরিনত করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ, বিদ্রোহ ও জাতিগত সংঘাতের সাথে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি শক্তির প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও নেপথ্য ভূমিকা দেখা গেছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে- ফিলিস্তিন, কাশ্মির, গুজরাট, রাখাইন, লেবানন, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মূলত মুসলমানরাই। এর মানে হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব অঘোষিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। নব্বইয়ের দশকে স্যামুয়েল পি.হান্টিংটন ‘দ্য ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন বা সভ্যতার দ্ব›দ্ব নামে যে তত্ত¡ দাঁড় করিয়েছেন তার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে পশ্চিমা পুঁজিবাদের সাথে ইসলাম তথা মুসলিম বিশ্বের সাংঘর্ষিক অবস্থান। নাইন-ইলেভেনের রহস্যময় সন্ত্রাসী বিমান হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ক্রুসেড বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র নামে মুসলিম দেশগুলোর উপর সামরিক আগ্রাসন অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির যে কৌশল গ্রহণ করেছিল, গত দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বে অনেক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেও মুসলমানদের প্রতি তাদের গৃহিত নীতি এখনো অব্যাহত আছে। তিনি ভবিষ্যদ্বানি করেছিলেন, এই সংঘাতে ইসলামি সভ্যতা চৈনিক সভ্যতার সাথে মিলেমিশে একাট্টা হয়ে যেতে পারে। এটা খুবই সাধারণ হিসাব। চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের সাথে পাকিস্তান, ইরান-তুরস্কসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অংশগ্রহণ সেই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে তোলে। তবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের অস্তিত্বের সংকটের প্রশ্নে ভিন্ন প্যারাডাইমও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই শুধু নয়, মিয়ানমারের সম্ভাব্য খনিজ সম্পদের উপর নিজেদের স্বার্থের দখল অক্ষুন্ন রাখেতে সেখানে চীন-ভারত ও আমেরিকার মধ্যে এক ধরণের নেপথ্য নিবিড় বোঝাপড়া দেখা যাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে ভারতে বিজেপি’র ফ্যাসিবাদি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যার পর এখন বর্বর নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে লাখ লাখ মুসলমানকে রোহিঙ্গাদের মত রাষ্ট্রহীন করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের নীরব সমর্থন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২শ কোটি হলেও কোনো একক রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক মুসলমানের বাস ভারতে। প্রায় ২৫ কোটি ভারতীয় মুসলমানকে হত্যা বা বিতাড়িত করা কোনো রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে হয়তো অসম্ভব। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের নামে, হিন্দুত্ববাদের নামে, ভারত ও তার প্রতিবেশি দেশগুলোর মুসলমানদের উপর যেকোনো সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে আরো সংহত, কৌশলগত ভূমিকা এবং আভ্যন্তরীন সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন