পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইংরেজী নতুন বছরের শুরুতে আমাদের সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা নতুন আশঙ্কার দোলাচলে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নানামাত্রিক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এবং তার পরিধি ক্রমবর্ধমান হওয়ার আশঙ্কা, অন্যদিকে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টে দেশ আবারো বিধিনিষেধের কবলে পড়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে দেশ। কর্মসংস্থান হারিয়ে কোটি মানুষ অতিদরিদ্র হয়েছে। তবে এরই মধ্যে স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমেছে। কোটি মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক হিস্যা নিজেদের কব্জায় রেখে বিলিয়নিয়র আল্ট্রা রিচ লোকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর মানে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ দেশে-বিদেশে শ্রম দিয়ে রেমিটেন্স আয় করে রাষ্ট্রের সম্পদ বাড়াচ্ছে, সেই সম্পদের সুষম বন্টন করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। ধনী আরো ধনী হওয়া, গরিব আরো গরিব হওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজকে ভারসাম্যহীন করে তোলার মধ্য দিয়ে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অনাচার অবিচার বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মূলত এর জন্য দায়ী হলেও রাষ্ট্র ও সরকারের কাজ হচ্ছে, আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষিত রাখা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনা। আমাদের সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সেই মহতি দায়িত্ব পালনের বদলে তথাকথিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে আইনগত স্বচ্ছতা ও বিচারহীনতার আবর্তে ঠেলে দিচ্ছে। এই অস্বচ্ছতা ও বিচারহীনতার গ্যাঁড়াকল থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে না পারলে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের রাজনৈতিক সরকার এবং রাষ্ট্রকে এখনো মাঝে মধ্যেই ব্যর্থতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে গন্ডানিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব-পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ৭ জন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একই প্রশ্নে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কুশীলবদের মধ্যেও একটি মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে গণচীন ও মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে প্রায় অভিন্ন ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে তা হচ্ছে, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথেই বৈরীতা নয়’। গত পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ তার এই পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখে চলেছে। রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক-ভৌগলিক সত্তা। এর আন্তর্জাতিক সীমান্ত থাকবে, প্রতিবেশী থাকবে, সীমান্তবিরোধ থাকবে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্ব›িদ্বতা যেমন থাকবে, তেমনি দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতামূলক ফোরামও থাকবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে এসব ক্ষেত্রে বৈরিতা পরিহার করা সব সময় সম্ভব নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, আদতে বাংলাদেশের সাথে যেমন কোনো প্রতিবেশি বা দূরের দেশগুলোর প্রত্যক্ষ শত্রæতা নেই, একইভাবে কারো সাথে কমিটেড বন্ধুত্বও নেই। একাত্তুরে যেমন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে নিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন স্বাধীন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ঠিক একইভাবে রোহিঙ্গা পুর্নবাসনের প্রশ্নে ,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিলেও পরস্পর বৈরী রাষ্ট্র চীন এবং ভারত স্পষ্টভাবেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়েছে। একাত্তুরে পাকিস্তানের প্রতি চীন-মার্কিনীদের ভূমিকার মত এখন রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ভূমিকাও দুর্বল ও দোদুল্যমান। এর চেয়ে অনেক গৌণ বিষয়ে পশ্চিমারা বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা গেলেও রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে তাদের ভূমিকা যেন এখনো অনেকটা বাগাড়ম্বরতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্কই স্থিতিশীল বা চিরস্থায়ী নয়। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ কথা আরো ধ্রæবতর সত্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি হচ্ছে, আত্মনিয়ন্ত্রিক সমঝোতার শিল্প বা কৌশল ‘পলিটিক্স ইজ দ্য আর্ট অব কনফাইন্ড কম্প্রোমাইজ’। বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সমর্থন ও বৈরিতার বিভক্তিকে সামনে রেখেও আমরা ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ নীতি গ্রহণ করতে পারলেও আভ্যন্তরীনভাবে সব রাজনৈতিক বিভেদ পরিহার করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়নে কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। যে তিনটি মহৎ লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও আমরা সেই লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারিনি। সাধারণ মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে আন্তর্জাতিক মহলের ভবিষ্যদ্বানি ও আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমানিত করে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশ একটি সাফল্যজনক অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হলেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ও প্রতিহিংসার কারণে আমাদের রাষ্ট্র এখনো ভঙ্গুর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। দেশে আইনের শাসন না থাকলে, রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপস্থিতি না থাকলে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক সহিংসতার মুখোশ পরে বিচারহীনতার আদলে লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়। গত এক দশকে দেশ থেকে অন্তত ৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতেও অর্থপাচার বন্ধ হয়নি, বরং আরো বেড়েছে। করোনাকালে ২০২০ সালে বহুজাতিক আর্থিক গবেষণা ও কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান ওয়েল্থ এক্স ‘অ্যা ডিকেড অব ওয়েল্থ’ শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেখানে দেখা যায়, এক দশকে বিশ্বের দেশগুলোতে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। এ সময়ে অতি ধনী বা ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে বেড়েছে ১৪.৩ শতাংশ হারে, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রথম ১০ দেশের মধ্যে এরপর ভিয়েতনামে বেড়েছে ১৩.৯ শতাংশ হারে, তারপর আছে চীন (১৩.৫%) কেনিয়া (১৩.১),ফিলিপাইন (১১.৯), থাইল্যান্ড (১০.৬), নিউজিল্যান্ড (৮.৭), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৮.২), পাকিস্তান (৭.৫) এবং আয়ারল্যান্ড (৭.১%)। যদিও এসব দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা এক রকম নয়। কর্পোরেট ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে আল্ট্রা রিচ ধনীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা বিদ্যমান থাকলেও বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা দেশকে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির বিশ্ব তালিকার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার অবস্থানে নেই, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যেমনই হোক, গরিব মানুষের সম্পদ লুন্ঠন করে ধনীর আরো ধনী হওয়ার পরিস্থিতি বিশ্বে বাংলাদেশ সবচেয়ে অনুকুল।
সবকিছুরই একটি স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক পরিনতি থাকে। বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক-এগারো সেনাসমর্থিত সরকারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গত ১৪ বছরেও বাংলাদেশে একটি বহুপ্রত্যাশিত ও অনিবার্য রাজনৈতিক সমঝোতা হয়নি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক কুশীলবদের প্রভাবে আভ্যন্তরীণ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন ও অনুঘটকদের ভূমিকা কি ছিল তা এখন আর সচেতন মহলের অজানা নেই। সাবেক মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিন্টন থেকে শুরু করে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জির লেখা থেকে এ বিষয়ের নেপথ্য ঘটনাবলীর অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। আঞ্চলিক বাস্তবতা ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত বোঝাপড়ার নিরিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো চীনের প্রতিপক্ষে ভারতের সাথে কৌশলগত অবস্থান সুসংহত করতে ভারতীয় কূটনৈতিক প্রভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরণের শিথিল অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম অভিযোগগুলোকে তারা অস্ত্র হিসেবে হাতে রেখেছিল। গত এক দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে হাজার কোটি ডলারের চীনা বিনিয়োগ এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কৌশলগত ভূমিকায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধির কারণে এক সময়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশীদার হয়েও মার্কিন স্বার্থে প্রস্তাবিত চীনবিরোধী কৌশলগত জোটে বাংলাদেশকে বাগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, গুম-খুন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারহীন হত্যাকান্ড, বড় বড় দুর্নীতির সাথে জড়িত ও সম্ভাব্য অভিযুক্ত ব্যক্তি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে (নেপথ্যে চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়া সরকারকে ঘায়েল করতে) জনগণের ক্ষোভ ও প্রত্যাশার অনুকূলে নিজেদের মত করে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। মার্কিনীদের মতলব যাই হোক, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার মত মৌলিক বিষয়ের প্রতি দেশের মানুষের সচেতন আগ্রহ রয়েছে। এ কারণেই সরকার ও বিভিন্ন সেক্টরের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খড়গ অনেক বেশি গুরুত্ববহ, তাৎপর্যপূর্ণ। গত এক যুগে দেশে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাবলী, হাজার হাজার মামলায় বিরোধিদলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার-হয়রানি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে শত শত মানুষের গুম, নিখোঁজ ও বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত অথবা পদযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করার ক্ষমতা বা বাস্তবতা বাংলাদেশে এখন নেই বললেই চলে। এ কারণেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ (সমর্থন!) অনেক বেশি।
র্যাবের কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সাবেক র্যাব প্রধান হওয়ার কারণে বাংলাদেশের বর্তমান আইজিপিসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে সরকার বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে কৈফিয়ত তলবসহ নানাবিধ কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। ইতিমধ্যে বিজিএমইএ’সহ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের এসব তৎপরতার ফলাফল দেখা না গেলেও বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রশি টানাটানি দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে নিষেধাজ্ঞার পরিধি বা তালিকার বহর আরো লম্বা হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। প্রথমে র্যাবের ৭ কর্মকর্তার নামের সাথে আরো কিছু নাম যুক্ত হওয়ার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলাবলি হচ্ছিল। এরপর তা ২ শতাধিক, তারপর ৪ শতাধিক থেকে এখন সাড়ে ৩ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন তথ্য উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে। এসব তথ্য যদি সত্য হয়, দেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে উদ্বিঘœ হতে হয়। তথাকথিত লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে এখন এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ অবস্থায় আঞ্চলিক-আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের নীলনকশা ছিন্ন করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। বিদেশিদের অভিযোগ ও নিষেধাজ্ঞার পেছনে যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, অভিযোগগুলো গুরুতর। ব্যাপক দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবর্হিভুত হত্যাকান্ড, গুম-খুন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে রাখার মত বিষয়গুলোর সাথে রাষ্ট্র গঠনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিহিত। এসব বিষয়ে দীর্ঘকালীন ব্যত্যয় দেশের জনগণ সহ্য করতে পারে না, মেনে নেয়না। ভূ-রাজনৈতিক কারণে সুযোগ সন্ধানি বিদেশিরা সে সুযোগ গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
দেশে দুর্নীতি লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এর প্রথম শর্ত হচ্ছে, জনগণকে নিজেদের পছন্দ মত প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ অবারিত করা। জনপ্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, বিচার বিভাগসহ সর্বক্ষেত্রে জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের দলনিরপেক্ষ আইনগত স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। শত বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের সিপাহী-জনতার বিদ্রোহের অভিজ্ঞতার আলোকে ১৮৬১ সালে যে পুলিশ অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিল, লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পুলিশ এখনো মূলত সেই আইনেই চলছে। রাষ্ট্র নয়, জনগণ নয়, সরকারের গদি এবং কায়েমী স্বার্থ রক্ষাই ছিল সেই পুলিশ আইনের মূল লক্ষ্য। বৃটিশদের প্রণীত শিক্ষানীতি ছিল ভারতীয় মুসলমান ও হিন্দুদের নিজস্ব ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করে কিছু সংখ্যক ইংরেজদের অনুকার ভোগবাদি কেরানি-মুৎসুদ্দি সৃষ্টি করা। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই শিক্ষাব্যবস্থা আরো অতল গহŸরের অন্ধকারে নেমে গেছে। শিক্ষাব্যবস্থা এখন নানাবিধ বৈষম্য ও রমরমা সার্টিফিকেট বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় পরিনত হয়েছে। গত এক দশকে দেশ থেকে যেমন লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে- একই সাথে মেধা পাচার, মানব পাচার, নারী ও শিশু পাচারের ঘটনাও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রশাসন থেকে শুরু করে আদালতের উকিল-মোক্তার ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও দলাদলিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয় স্থল হচ্ছে বিচারিক আদালত। দেশের নি¤œ আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ মানুষের। এভাবে কোনো রাষ্ট্র বা সভ্য সমাজ চলতে পারে না। এ সপ্তাহে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের চার বিচারপতি শপথ গ্রহণের পর বিচার বিভাগের দুর্নীতি দূর করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আপীল বিভাগে সদ্য উন্নীত বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহীম বলেছেন, ‘বৃদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি রোধ করতে আমি শপথের যথাযথ চর্চা চালিয়ে যাব’। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোট পুন:গণনার দাবিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কয়েকশ’ মামলা করেছিলেন। নিজের পক্ষে একটি রায়ও আদায় করতে পারেননি। নিজের নিয়োগ দেয়া বিচারপতিরাও আইন এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে কোনো রুল জারি করেননি। বিচারক-বিচারপতিরা ক্ষমতার চর্চা করেন না, তারা আইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নোত রাখার শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো সেই শপথ রক্ষায় কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সেই শপথ রক্ষায় ব্যর্থতারই ফল। আমাদের নিজস্ব মানদন্ড এবং জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং সুশাসন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই সব অভিযোগ ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বাধ্য করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।