Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্নীতির চর্চা যেন শিক্ষা জীবন থেকে শুরু না হয়

মো. শাহাদাত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৮ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

নীতির বাইরে যা হয়, তাই দুর্নীতি। দুর্নীতির সংজ্ঞা দেশ, কাল ও সংস্কৃতিভেদে পরিবর্তনশীল। বিশ্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ১৩২তম অবস্থান দখল করলেও আমাদের বাস্তব অবস্থা আরো ভয়ংকর। আমাদের তথ্যপ্রবাহ উন্নত দেশের মতো স্বচ্ছ নয়। টিআইবি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিক্ষা খাত অষ্টম হলেও সকল খাতের দুর্নীতির মূলে রয়েছে এই খাত। কারণ, আমাদের দেশে দুর্নীতির কৌশল রপ্ত করা শুরু হয় শিক্ষা জীবন থেকে, যা বিশ্বে বিরল। নীতি-নৈতিকতা শিখানোর বিপরীতে কোমলমতি শিশুদের শেখানো হয় কীভাবে পরীক্ষায় বেশি নাম্বার পাওয়া যাবে।

নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত রাষ্ট্র কখনই সফল রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে শিক্ষক সমাজ কারো মাঝেই নীতির কোনো বালাই নেই। যে জাতির দুর্নীতির চর্চা শুরু হয় শিক্ষা জীবন থেকে সে জাতি কি আর দুর্নীতি মুক্ত থাকতে পারে? পারে না। স্বয়ং বাবা-মা-ই বেশি নম্বর প্রাপ্তির জন্য সন্তানকে অন্যেরটা দেখে লেখার কৌশলটা ভালোভাবে বুঝিয়ে ও শিখিয়ে দেয়, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সংগ্রহের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। যখন অভিভাবকের হাতে সন্তানের দুর্নীতির হাতেখড়ি, তখন তাকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি হয় কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে লেখা এখন ছাত্রদের কাছে অধিকারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমবেশি এই অপরাধ করছে। শিক্ষার্থীরা তাদের ইচ্ছামত দেখাদেখি করে লেখে, তাদেরকে বারণ করেও কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। কারণ, শাস্তি প্রয়োগের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত করে ফেলা হয়েছে। কখনও কখনও প্রতিষ্ঠান অবজেক্টিভ প্রশ্নের উত্তরমালা সরবরাহ করার পাশাপাশি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপ বিতরণ করে। একজন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি অনুকরণ করে শিক্ষককে। কিন্তু আমাদের শিক্ষক সমাজ যে প্রাইভেট টিউশন চালু করেছে, তার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না। এর ফলে একজন শিক্ষক তার প্রাইভেট শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন বলে দিচ্ছেন। পরীক্ষায় ফেল করলেও নিজ বিষয়ে পাস করিয়ে দিচ্ছেন। ৪৬টির অধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আন্তর্জাতিক মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের নেই। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বিক্রির কাণ্ড প্রায় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবর্তে বিভিন্ন রংয়ের দলের ছড়াছড়ি। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার পরিবর্তে কালো রাজনীতি আর হানাহানি শিখছে।

গাইতে গাইতে গায়েন কিংবা কঁচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত এমন প্রবাদ বাক্যগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ রূপে প্রযোজ্য। অর্থাৎ একটি কোমলমতি শিশুকে যেখানে নীতি ও আদর্শের শিক্ষা দেওয়ার কথা, সেখানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উল্টো পথে হাঁটছে। এখানে শিশু বয়সেই দুর্নীতির হাতিখড়ি দেওয়া হয়। ধাপে ধাপে একজন পরিপূর্ণ দুর্নীতিবাজ বানানো হয়। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী তার কর্মজীবনে সহজেই দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে শিক্ষকের সম্পৃক্ততা অনেক কম। ৯০ ভাগ বেসরকারি শিক্ষকের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় সেখানে বেসরকারি কর্মপরিবেশ ও বাধা কোনো কিছুই পর্যালোচনা ছাড়া সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক কোনো পরিবর্তন এখনও হয়নি। আনুপাতিক হারে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত সকল পদে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে নতুবা সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করতে হবে। শতকরা ৮০ ভাগ সমস্যাই এর মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে। সবার আগে শিক্ষককে তার আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। উন্নত বিশ্বে যেখানে শিক্ষকদের বেতন ও সম্মান সর্বোচ্চ, সেখানে বাংলাদেশে দুটোই সর্বনিম্ন পর্যায়ের।

উল্লেখ্য যে, জাপানে একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করতে হলে রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন লাগে। নরওয়েতে একজন প্রাইমারি শিক্ষকের বেতন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ। ফলে ঐসমস্ত দেশের শিক্ষকরা নিজেই নিজের সততা বজায় রাখেন। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষকদের নৈতিকতায় নিয়ে আসতে হবে। সকল পাবলিক পরীক্ষা যেন শতভাগ নকল ও দেখাদেখি মুক্ত হয় তার জন্য পর্যাপ্ত কার্যকর মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। বিশেষ করে সাময়িক শাস্তি প্রদানে যেমন খাতা নিয়ে কিছুক্ষণ আটকিয়ে রাখা কিংবা জায়গা পরিবর্তন করে দেয়া ইত্যাদি। এছাড়াও কয়েক বছর শিক্ষার্থী পাসের হার কম হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধ করার নিয়মে পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার্থীর পাসের হারের সাথে কোনভাবেই শিক্ষক সমাজের বেতন নির্ভর করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্যাটার্নে পরিবর্তন আনতে হবে। বয়স ও নির্ধারিত নম্বরের আইডিয়া পরিবর্তন করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কারণ, পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর কোনভাবেই শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়নের মাপকাঠি হতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা শুরু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে গবেষণার সূতিকাগার, যেখান থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য নতুন নতুন টেকনোলজি বের হয়ে আসবে। তাছাড়া, আমাদের চাকরি ব্যবস্থাও সঠিক পথে নেই। বিশেষ কিছু টেকনিক্যাল ক্ষেত্র ছাড়া সকল ক্ষেত্রেই লেজে-গোবরে অবস্থা বিদ্যমান। ইতিহাসের ছাত্র ব্যাংকার হতে পারে আবার কমার্সের শিক্ষার্থী ম্যাজিস্ট্র্যাট হতে পারে। বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির অবস্থা আরো নাজুক। যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ছক বাঁধা একসেট বই মুখস্ত করে চাকরি পেতে হয়, যা তার চাকরি জীবনে কখনই কাজে লাগে না। তাই বিসিএস কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিসিএস কারিকুলাম হবে বিষয়ভিত্তিক, যেখানে মেধা মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রভাষক ও কলাম লেখক।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতির চর্চা যেন শিক্ষা জীবন থেকে শুরু না হয়
আরও পড়ুন