পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজকাল সমাজ-ভাবনায় মন্দা চলছে। সমাজ ধাবিত হচ্ছে, এক দায়িত্বহীন জীবনযাপনের দিকে। অবিশ্বাসী ও আত্মতৃপ্ত মানুষ শুধু আত্মস্বার্থ সিদ্ধির মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। সমাজে চলছে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা। আত্মবিকাশের জন্য পারস্পরিক প্রতিযোগিতা যে প্রয়োজন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা শুধু স্বার্থসিদ্ধির জন্য হবে কেন? সংঘটিত লৌকিক ধর্ম, ফলিত বিজ্ঞান ও দর্শন আমাদের উপহার দিয়েছে নবজীবন প্রণালী, কিন্তু আমরা সুস্থ সমাজে বসবাস করতে পারি, তার কোনো সুস্পষ্ট দিশা এগুলো দিতে সক্ষম হয়নি। সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে মমতাপ্রাণিত চেতনা ও সংযোগ স্থাপনের যে শিক্ষা সুষ্ঠ সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন, তা যে বিদ্যার্থীদের সুশিক্ষা, চারিত্রিক উৎকর্ষ ও সামাজিক মানসিকতার জন্ম দিতে সমর্থ, সে সম্পর্কে আমরা একেবারে উদাসীন।
সমাজসেবা শিক্ষা স্কুলে অবশ্যপাঠ্য না হলেও, কিছু কিছু বিদ্যালয় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছু সমাজসেবা যে করে থাকে, সে সম্বন্ধে আমরা একেবারেই অবহিত নই তা কিন্তু নয়। তবে সামান্য কিছু মাটি কাটিয়ে, রাস্তাঘাটে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালিয়ে, প্রাপ্তবয়স্কদের অক্ষর জ্ঞান দিয়ে বা অনুরূপ কিছু করে যে সমাজসেবা করা হচ্ছে, সেগুলোর পরিধি নিতান্ত অপ্রশস্ত ও একেবারে নগণ্য। সমাজসেবা বলতে মানবিক মমতা, সমাজের সার্বিক উৎকর্ষ, জাতীয়তাবোধ, মানবীয় সম্পর্ক ও সহমর্মী মানসিকতা গঠনের শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। আমাদের সমাজে যা প্রকট হয়ে উঠেছে সেটা হচ্ছে, আত্মস্বার্র্থের প্রতিযোগিতা। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী আজ দেশ, সমাজ এমনকি নিজেদের পিতা-মাতাকে ভুলে যাচ্ছে। হারিয়ে ফেলছে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আর্কষণ। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের সমাজ ভাবনা। উচ্চ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা প্রবাসে গবেষণা করে নানা পুরস্কার লাভ করছে। এ ধারা যদি চলতে থাকে, তাহলে এমন দিন আসবে যখন দেশে উন্নতমানের ডাক্তার, সুনিপূণ ইঞ্জিনিয়ার, যোগ্য অধ্যাপক, সুদক্ষ প্রশাসক, সাহিত্যিক বা কর্মশীল রাজনীতিবিদ-এর আকাল দেখা দেবে। দেশে সরকারি বৃত্তি এবং গবেষণা করার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্তে¡ও সম্পদ ও প্রতিপত্তির পূর্ণতা লাভের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেশও সমাজ ছেড়ে বিদেশে যেতে দ্বিধা করছে না। যে দেশ ও সমাজ তাদের মানুষ হতে এত কিছু দিয়েছে, তা তারা যেন বেমালুম ভুলে যাচ্ছে। এ জন্য অবশ্য সরকারি নীতি নির্ধারকরা ও কর্মকর্তারা যথেষ্ট দায়ী। লাল ফিতার দৌরাত্ম, স্বজননীতি ও সর্বোপরি সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তার, যোগ্য শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা পেতে প্রতিনিয়ত অন্তরায় সৃষ্টি করছে। ফলে তারা বিদেশমুখী হচ্ছে। তাছাড়া, পাশ্চাত্য জীবনধারায় অভ্যস্ত এবং অনুপ্রাণিত হয়ে ও ভ্রান্ত মূল্যবোধে আকর্ষিত হয়ে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিস্বার্থ ও উচ্চকাক্সক্ষা পূরণ করাকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের প্রতি দায়বোধ জাগ্রত করার এবং সমাজে মানবিক সম্পর্ক রক্ষার কোনো প্রচেষ্টা তাদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। হারিয়ে ফেলছে হৃদয়ের ঐশ্বর্য। তাই শিক্ষাবিভাগ ও শিক্ষকদের একটা বিশেষ দায়িত্ব হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন মানসিকতা গড়ে তোলা, যাতে তারা পরবর্তীকালে সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ মানবিক জীবনযাপন করতে তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের এই অবদান ভবিষ্যতে সামাজিক জীবনে অবশ্যই বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
বর্তমানে স্কুলগুলোতে এমন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যাতে অর্থসর্বস্ব যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের রাস্তা সুগম হয়। জীবনে সাফল্য বলতে এখন আর্থিক সাফল্য বুঝাচ্ছে। যোগ্যতা বিচারে মানুষের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। সমাজে মানুষ জন্মে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য, প্রতিযোগিতার জন্য নয়। স্কুলগুলো শুধু কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে মানুষ গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান নয়, মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের অনুশীলন ক্ষেত্রও বটে। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের বর্তমান সমাজকে বাঁচাতে মানবিক সম্পর্কের অনুশীলনের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান সামাজিক পরিবেশে আমাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা বিশেষভাবে জরুরি। তাই আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি সেভাবে বির্ধারিত হওয়া উচিত। এ বিধান কার্যকর করার জন্য শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষয়টি মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন করা তত কঠিন।
বর্তমান আবহে সামাজিক দায়িত্ব পালনে অনীহা, সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি অবহেলা, ব্যক্তিগত আর্থিক সাফল্যকে পরম সাফল্য বিবেচনা করায়, বিদেশি জীবনদর্শনকে অনুকরণ করায় আমরা ধীরে ধীরে সমাজব্যবস্থা বিসর্জন দিতে চলেছি। এগুলো হচ্ছে, মূলত সামাজিক শিক্ষার অভাবে। আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার হাতেখড়ি দিচ্ছে একশ্রেণীর অভিভাবক। এই ব্যক্তি স্বার্থসর্বস্ব শিক্ষা নবীন প্রজন্মকে সমাজভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ফলে তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও উচ্চাশা পূরণে যতœবান হয়ে উঠেছে। কথায় বলে মানুষ জীবনের প্রথম ১৫ বছরে যে শিক্ষা লাভ করে, তা জীবনে কখনো বিস্মৃত হয় না। তাই সমাজের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দিতে হবে। জীবনে মূল্যবোধ বিসর্জন যে জাতীয় বিপর্যয় এনে দিতে পারে, এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের অবহিত করতে হবে। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বেচেতনার সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে ও সমাজকল্যাণের মহৎ ভাবনাগুলো মনে রেখে সমাজকে পুনর্গঠিত করা একান্ত জরুরি, সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরও অনুপ্রাণিত করতে হবে। এর পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে মানবিক সম্পর্ককে। তাদের অবহিত করাতে হবে, বৃহত্তর সমাজজীবন বাদ দিয়ে একক উন্ন্য়ন প্রয়াস সমাজের উন্নয়নের পরিবর্তে শুধু বৈষম্য সৃষ্টি করে। ক্রমাগত প্রেরণার দ্বারা শিক্ষার্থীদের সুপ্ত সামাজিক চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
বর্তমান শিক্ষানীতিতে সেবা, সমাজ ভাবনা, মমতা ও আদর্শ শিক্ষার সুযোগ খুব কম। নেই শিশুদের অন্তরে সুপ্ত সমাজচেতনাকে বিকশিত করার অনুপ্রেরণা। ফলে ভোগবাদী সমাজে তরুণ শিক্ষার্থীরা সমাজসেবার আদর্শ ও মানসিকতা পেছনে ঠেলে অর্থসর্বস্ব জীবনমুখী হয়ে পড়েছে। আত্মস্বার্থ উপেক্ষা করে পরার্থ কামনা তাদের কাছে উপহাসে পরিণত হয়েছে। সমাজসেবার আদর্শের ভাবনা সমাজজীবন থেকে নির্বাসিত বলে আইন প্রণয়ন করে সমাজসেবার আদর্শের কথা বলতে হচ্ছে। তবে এটাও সত্য, বিশেষ নিয়মকানুন করে স্বার্থান্বেষী মানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব নয়, যদি না আদর্শগতভাবে তা গৃহীত হয়। সেজন্য শিক্ষাসূচির মধ্যে সমাজসেবার আদর্শ ও কর্তব্য আবশ্যিকভাবে সংযোজন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অপরের জন্য কিছু করলে ভেতরের শক্তির উন্মেষ হয়-এ নীতিবোধ শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, সুশিক্ষাই মহৎ জীবন ও সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে পারে। তা নাহলে, সমাজে যে ট্রেন্ড বা ধারা চলছে, তাতে সার্বিক সামাজিক অবক্ষয় কেউ রোধ করতে পারবে না, করা সম্ভব নয়।
লেখকঃ সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।