পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুর্নীতি শব্দটি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। সামাজিক জীবনে প্রতিদিনই আমরা কোন না কোন দুর্নীতির খবর জানছি, শুনছি এবং পড়ছি। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেনি। আমাদের পারিবারিক জীবন এমনকি ব্যক্তি জীবনে পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মকভাবে। ঋণ নিয়ে হজম করে ফেলা, সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করা, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস চুরি, চাকরির নামে প্রতারণা ও হয়রানি করা মোটেই নতুন ঘটনা নয়। দুঃস্থ মানুষদের গম নিয়ে, এতিমদের বস্ত্র নিয়েও দুর্নীতি হচ্ছে। পরীক্ষার আগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি, অতঃপর পরীক্ষার হলেও দুর্নীতি আধিপত্য বিস্তার করেছে। মেধা তালিকায় স্থান নির্ধারনেও চলে দুর্নীতি।
দুর্নীতি ধর্মতাত্তি¡ক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আদর্শের বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তির আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। অর্থনীতিবিদগণ একে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘দুর্নীতি এমন একটি কার্য যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়, যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে, এতে করে দুর্নীতির সাথে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয়, এবং এই কার্যে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটি থাকে কর্তৃপক্ষ।’ দুর্নীতি সমাজের প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ। দুর্নীতির সাথে পেশা, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, পদবী প্রভৃতির অপব্যবহার সংশ্লিষ্ট।
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে। দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হলে তা দিয়ে শিশু ও প্রসূতির চিকিৎসা, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মেরামত ও জনকল্যাণে ব্যয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে দেশ যেমন অনেকদূর এগিয়ে যেত, তেমনি দাতাদের উপর আমাদের নিভর্রশীলতাও অনেকটা কমে আসত। জাতীয় জীবনের গভীরে প্রোথিত এমন জাতীয় সমস্যার সমাধানের সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনাও নেই। তবে সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন যে, জাতীয় জীবনীশক্তি বিনাশকারী এই ভয়াবহ মহামারি হতে জাতিকে রক্ষা পেতে হলে সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন।
দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ অন্যান্য ক্ষতির বিশালতার কারণে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ দুর্নীতিকে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ছে এও নতুন কথা নয়। তবু দুর্নীতি কমছে না। দিন যতই যাচ্ছে দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তত বেশি প্রবেশ করছে। সমাজে সৃষ্টি করছে চরম অস্থিতিশীলতা। দুর্নীতির কারণে সামাজিক ভারসাম্য নষ্টের ফলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী দুষ্টক্ষতের।
ঘুষের কথাতো আছেই। ঘুষ প্রদান ছাড়া ফাইল নড়ে না। উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলেন, এক সময় ঘুষের প্রতি এতই অনীহা ছিল যে, যে চাকরিতে ঘুষের সুযোগ থাকতো, সামাজিকভাবে ঐ ধরনের চাকরি কমর্রতদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনেও অনীহা ছিল। এখন অনীহার বদলে দেখা যায় উপরি আয়ের কথা চিন্তা করেই আত্মীয়তার ক্ষেত্রে অনেকেই এগুচ্ছে। নৈতিকতার প্রতি মানুষের আন্তরিকতা যেন আর থাকছে না। সমাজে এ ধরনের নৈতিক স্খলনের ফলে বাংলাদেশে এখন ঘুষের লেনদেন হয় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক একটি স্মারক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মোট লেনদেনের শতকরা ৭ ভাগ ঘুষ দিতে হয়।
দুর্নীতি বিভিন্ন মানদন্ডে ঘটতে পারে। আওতা বা বিস্তৃতি ছোট হলে এবং তাতে যদি অল্পসংখ্যক মানুষ জড়িত থাকে তবে তাকে ক্ষুদ্রার্থে আর যদি বড় আকারে প্রভাবিত হয়ে পড়ে তবে ব্যাপকার্থে দুর্নীতি হিসেবে নির্দেশিত হয়। ক্ষুদ্র দুর্নীতি, ছোট মাত্রায় এবং প্রতিষ্ঠিত সামাজিক অবকাঠামো ও প্রশাসনিক নিয়মের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অনুগ্রহ বা অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই প্রকারের দুর্নীতিতে ক্ষুদ্র উপহার বা ব্যক্তিগত সংযোগকে ব্যবহার করা হয়। মূলত উন্নয়নশীল বিশ্বে এই প্রকারের দুর্নীতি বেশি।
দুর্নীতি আরো বিভিন্নভাবে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। যেমন: প্রশাসনিক দক্ষতা হ্রাস করে, জনগণের বিড়ম্বনা বৃদ্ধি করে, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি করে, জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করে, মূলধন গঠন ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে, সামাজিক নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে দুর্নীতিবিষয়ক যেসব আইন রয়েছে তার মধ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এবং দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭ উল্লেখযোগ্য।
দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িত হতে না পারে তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই আইনটি করা হয়। এই আইনের আওতায় কেউ এ জাতীয় অপরাধ করলে সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদন্ড কিংবা অর্থদন্ড অথবা কারো ও অর্থ উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৫৭ অনুযায়ী বিধান রয়েছে যে, সরকার যদি তথ্য প্রাপ্তির পর অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হয় যে, কোন ব্যক্তি বা তার নিজস্ব কোন প্রতিনিধির নিকট এমন পরিমাণ অর্থ কিংবা সম্পদ রয়েছে যা ঐ ব্যক্তির জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৩ গঠিত হয়।
সরকার সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদে তৎপর রয়েছে। অবৈধ লেনদেন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ক্ষমতা অপব্যবহারে জড়িত থাকার অভিযোগে হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
জনগণের পক্ষ হতে সহযোগিতা না পেলে সরকারের পক্ষে দুর্নীতিনিরোধ সম্ভব নয়। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। আরো যা করতে হবে তা হল: বিচার বিভাগের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা বাড়াতে হবে, মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে, ধর্মীয় বিশ্বাসকে উজ্জীবিত করতে হবে।
লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।