Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যানজট নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

রাজধানীর যানজটের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে অসহনীয় যানজট নিয়ে নগরজীবন চলছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই জট বেড়ে চলেছে। এ নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। নগরবিদরা যানজট সহনীয় রাখার ব্যাপারে নানা পথ বাতলে দিয়েছেন। কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় কোনো পরামর্শই কাজে আসেনি। যানজটে প্রতিদিন এবং বছরে মানুষের কী পরিমান আর্থিক ও শারিরীক ক্ষতি সাধিত হয়, তার হিসাব প্রায়ই পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি কত হয়, বিভিন্ন সংস্থা থেকে তাও প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস)-এর সদ্য প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতি বাদ দিয়ে যানজটের কারণে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি দেশের জাতীয় বাজেটের ২০ শাতাংশ এবং তা জিডিপি’র ২.৫ শতাংশ। এছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাথাপিছু আয়ের ক্ষতি হচ্ছে, মাইনাস ৫.৮ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যানজট বছরের পর বছর ধরে অর্থনীতির কত বড় ক্ষতি করে চলেছে।

যানজট নিরসনে এ পর্যন্ত পরিকল্পিত ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যেসব ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে, যানজট নিরসনে তা কোনো সুফল দিচ্ছে না। সেখানেও যানজট লেগে থাকে। যানজট এখন মাথার উপর চলে গেছে। সরকার মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ করছে। রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার বিকল্প পথ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যানজট কতটা সহনীয় পর্যায়ে আসবে, তা দেখার বিষয়। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, যানজট কমাতে এগুলোও যথেষ্ট হবে না। এর কারণ হচ্ছে, রাজধানীতে কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হয় না। এক সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির দিকেই যদি দৃষ্টিপাত করা যায়, তাহলে দেখা যাবে সেখানে পরিকল্পনার কোনো বালাই নেই। এক প্রতিষ্ঠান কাটাছেড়া করে যাওয়ার পর আরেক প্রতিষ্ঠান এসে তা শুরু করে। ঢাকার সেবামূলক অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন কোনো না কোনো সড়ক খুঁড়ছে এবং তা মাসের পর মাস সংস্কারহীন অবস্থায় ফেলে রাখছে। এক সংস্থা খুঁড়লে তার সংস্কারের দায়িত্ব আরেক সংস্থার। ঐ সংস্থার সংস্কারের উদ্যোগ নিতে নিতেই মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়। এমন ঢিমেতালে সংস্কার যানজটের অন্যতম কারণ। ঢাকাকে কোনোভাবেই আদর্শ নগরী হিসেবে গণ্য করা যায় না। একটি আদর্শ নগরীতে আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। এই সড়কের বেশিরভাগই যানবাহনের অবৈধ পার্কিং এবং হকারদের দখলে থাকে। ফলে যানজট নিত্যকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এতে মানুষের কর্মজীবন যেমন স্থবির হয়ে পড়ছে, তেমনি আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত অপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩৮ লাখ শ্রমঘন্টা নষ্ট হয়। এর মূল্য শত কোটি টাকার বেশি। ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। অ্যাম্বুলেন্সে আটকে থাকায় কত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, তার হিসাব নেই। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালে দেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। সমস্যা হচ্ছে, একটি উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী কেমন হয়, সে সম্পর্কে নগর কর্তৃপক্ষের ধারণা অস্পষ্ট বলেই মনে হচ্ছে। আবার উন্নয়নশীল দেশের ঘোষণা যে পিছিয়েও যেতে পারে, এ বিষয়টিও আমলে নিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না। যানজটের কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হচ্ছে, তা এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। উন্নয়নশীল দেশের ঘোষণা দেয়ার পরও তা পিছিয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। মালদ্বীপ ২০০৩ সালে উন্নয়নশীল দেশের মযার্দা পাওয়ার কথা থাকলেও সুনামির কারণে তা ৯ বছর পিছিয়ে যায়। ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে নেপাল ২০১৮ সাল থেকে ৩ বছর পিছিয়ে যায়। দেশ দুটির পিছিয়ে যাওয়ার কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও এদেশে যানজট ও পরিবহন নৈরাজ্য তার চেয়ে কম দুর্যোগ নয়। ধারণা করা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ঘোষণায় দেশে বিনিয়োগ বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, সউদী আরবসহ বিভিন্ন ধনী রাষ্ট্রগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে বিনিয়োগকারীরা যখন রাজধানীতে নেমে দুঃসহ যানজটে পড়বে এবং তাদের সময় নষ্ট হবে, তখন তাদের এই আগ্রহে নিঃসন্দেহে ভাটা পড়বে। যানজটের ক্ষতির সাথে বিনিয়োগের এই ক্ষতি দেশের অর্থনীতিকে যে পিছিয়ে দেবে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ জনসংখ্যার আধিক্য। এ শহরে দুই কোটির মতো মানুষ বসবাস করছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ বাস করছে। এমন জনঘনত্বপূর্ণ শহর বিশ্বে বিরল। অন্যদিকে, অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে ঢাকা। অর্থনীতির সিংহভাগ এখান থেকেই পরিচালিতি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ নানা সেবা প্রাপ্তির প্রধানতম কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা। প্রতিদিনই দেশের আনাচ-কানাচ থেকে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। ফলে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। নগরবিদরা বহুবছর ধরেই বলে আসছেন, ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে। এখানে যে সুবিধা রয়েছে, তা সহ প্রশাসনিক সুবিধা অন্যান্য বিভাগ ও জেলা শহরে সৃষ্টির কথা বলেছেন। ঢাকার সুবিধা বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে মানুষের চাপও কমবে। এ কাজটি করা হচ্ছে না। ফলে ঢাকা হয়ে উঠেছে যানজট, বায়ূ দূষণ, শব্দ দূষণ এবং বসবাস অযোগ্য নগরী। আমরা মনে করি, ঢাকার যানজট কমাতে পরিকল্পিত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে যানজট নিরসন করতে হবে। যেসব মেগা প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুত করতে হবে। যেটুকু সড়ক বিদ্যমান সেগুলো মসৃণ ও তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন