Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানুষের আয় ও আয়ু বাড়ার কথা কতটা সত্য?

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

গড়ের অঙ্কে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। গত অর্থবছরে ছিলো ২ হাজার ২২৭ ডলার। এক অর্থবছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩২৭ ডলার। দেশের মোট জিডিপি নির্ণয়ের জন্য নতুন করে ২০১৫-১৬ কে নতুন ভিত্তিবছর হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতোদিন ২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তিবছর হিসাবে গণনা করা হতো। নতুন ভিত্তিবছরের হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে।

কিন্তু ভেজালটা হয় গড়ের ব্যাপারে। বিশ্বের অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও এটি একটি আলোচিত বিষয়। অতি ধনবান থেকে অসহায় হতদরিদ্র সবার আয় সমান ধরা হয় এতে। অথচ, সমাজে একদিকে কিছু লোকের বিত্তবৈভব উপচে পড়ে। আরেক শ্রেণির দশা একেবারে বিপরীত। কিন্তু গড়ের অঙ্কে তারা সবাই সমান। বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু আপত্তি সত্তে¡ও এ হিসাবের বিপরীতে কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত নজরে পড়েনি। এ ছাড়া দেশে চলমান-বহমান উন্নয়ন সাদা চোখেই দেখা যায়। তাই যতটা সম্ভব সমতা নিশ্চিত করা জরুরি।

এদিকে আয়ের সঙ্গে বাড়ছে আমাদের আয়ুও। বিশ্বজুড়ে চলমান করোনা মহামারির মধ্যে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২ দশমিক ৮ বছর দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে নারীদের গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ৫ বছর এবং পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর। সেই হিসাবে বাংলাদেশের নারীদের আয়ুষ্কাল এখন পুরুষদের তুলনায় ৩ দশমিক ৩ বছর বেশি। আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। সংখ্যাগতভাবে আরও বিভিন্ন ক্ষেত্র ও সূচকেই বাড়তির যোগ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়তির গতি উপচে বা চুইয়ে পড়ার মতো। কমের কোনো বিষয়-আশয় নেই বললেই চলে। ব্যয়ের হিসাব কষাও দুষ্কর। অন্তহীন খাত। দফায় দফায় কতবার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বেড়েছে মানুষ ভুলেও যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম সকাল-সন্ধ্যা বাড়তিতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। চাল, পেঁয়াজ থেকে কাঁচামরিচ পর্যন্ত। সেই সঙ্গে ঢাকায় বাসাভাড়া। সব খাতেই ব্যয় বাড়ছে। কয়েক বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে প্রায় দিগুণ। ভোক্তা অধিকার সংগঠনের হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। এই হিসাব ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবার তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি। শিক্ষা, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় এই হিসাবের বাইরে। তাতে কী? সরকারপক্ষে জোর যুক্তি বড় কড়া। করোনা মহামারির মধ্যেও মানুষের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। নইলে তারা সামলাচ্ছে কেমনে? খরচের এত জোগান দিচ্ছে কীভাবে? হ্যাঁ দিচ্ছে। খরচ কমানোর বিচিত্র কত উপায় যে মানুষ বের করতে জানে! রিকশার পথ হেঁটে যাওয়া, কম দামি মাছ ও সবজি কেনা, বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে না যাওয়া, কত কী? মুখে নানান কথা বললেও গোপনে ওএমসের চাল, আটা, চিনি কেনার চিকন বুদ্ধি ধরেছেন বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত। বাড়তি আয়ু ধরে রাখার বিকল্প বলে কথা!

আয়ের সঙ্গে আমাদের আয়ু বাড়তে বাড়তে এখন একাত্তর বছর ছয় মাসের মতো। গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ২৪ বছরের বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে গর্বের সঙ্গে তথ্যটি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শোনামাত্র চমক এলেও তথ্যটি আমলে বা বিশ্বাসে নিতে একটু খটকা থেকেই যায়। কারণ করোনা, ডেঙ্গুসহ নানা রোগশোকে মানুষের অসুস্থতা ব্যাপক। আয়ু হ্রাসের পরিস্থিতিই বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তব আমাদের সহায়। আয়ের সঙ্গে আয়ুতে শুভসংবাদ। থাক না বিশেষজ্ঞদের কিছু বাড়তি কথা। আয়ুর চেয়ে মানুষ কতটা সুস্থ জীবনযাপন করছে, সেটাকে বড় প্রশ্ন মনে করেন তারা। তারা বলতে চান, অন্যান্য রোগের যে প্রাদুর্ভাব এবং করোনাসহ ক্রনিক ডিজিজ (দুরারোগ্য ব্যাধি) এবং নন-কমিউক্যাবল ডিজিজ (অসংক্রামক রোগ) বাড়ার ফলে একটা উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী সত্তর বছর বেঁচে থাকলেও তার কর্মক্ষমতা অনেক কম। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ কি তা মনে করে?

জনসংখ্যার হিসাবে এই বিশাল পৃথিবীতে বাংলাদেশ অষ্টম দেশ। আয়তনের দিক থেকে ৯৩তম। স্বাভাবিক কাÐজ্ঞানে তথ্যটা শুনতেই তাজ্জব হওয়ার মতো। এত মানুষ এই আয়তনে ঘুমায় কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাব খোলাসা করা একটু কঠিন বৈকি! বহুমুখী দুর্নীতি, অনিয়ম, ঠকবাজিসহ মানবসৃষ্ট অনাচারের সঙ্গে খরা, বন্যা, জলোচ্ছ¡াসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও এত মানুষ বেঁচে থাকে, ঘুমায়ও। খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। বস্ত্রহীনও নয় তারা। এগুলোর প্রতিটাতেই বিস্ময় লুকানো। এর সূত্রসহ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ যে নেই, এমনও নয়। তবে অস্বাভাবিক। অনেকে একে আল্লাহর খাস রহমত হিসেবে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের অনেক অর্জনই জ্যামিতি-গণিতের বাইরে। অস্বাভাবিকতায় ঠাসা। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি উতরে বাংলাদেশের কিছু অগ্রগতির ম্যাজিকে বিশ্বসেরা বিশারদ-বিশ্লেষকদেরও তাজ্জব হতে হয়। প্রচলিত সূত্র বা নিয়ম দিয়ে এ অগ্রগতির ব্যাকরণ উদ্ধারে হিমশিম খান তারা। যথারীতি আমাদের কিছু ঘটনাবলিও বিশ্বদরবারে অস্বাভাবিক, দৃষ্টান্তহীনও। এর পর আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের মতো। বাধা এলেও উতরে যাই। জয়ও ঘরে তুলি। হারলেও ঘুরে দাঁড়াই।

বাংলাদেশ আমাদের মতো। অথবা আমরা বাংলাদেশের মতো। অবিরত জানান দিচ্ছি, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, বেড়েছে উৎপাদনশীলতা। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশ। গত কয়েক বছরে ফলের ফলনও ঈর্ষণীয়। আমে সপ্তম। পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। চতুর্থ বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী। দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকও আমরা। আর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ এ তথ্য প্রাইমারি শিক্ষার্থীরাও জানে। উল্লিখিত তথ্যাবলি এখন বিশ্ববাসীও জানে। কমবেশি মানেও।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার কথা বাদ দিলে, পারিপার্শ্বিক অনিবার্যতায় এখন আর কারো তা মানা, না মানায় কিছু যায়-আসে না। তবে জলবায়ুর দ্রæত পরিবর্তনের জেরে যে বাংলাদেশ দিনকে দিন কঠিনতম অবস্থার দিকে যাচ্ছে, তা এখনো অনেকের জানার বাইরে। ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনীতি, সক্ষমতা ইত্যাদি কারণে জলবায়ু আমাদের এরই মধ্যে নিয়ে গেছে ভঙ্গুর দেশের তালিকায়। কষ্টময় করে তুলছে আমাদের বাড়তি আয়ুকে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাংলাদেশকে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে ফেলছে। এসব দুর্যোগ দেশটির বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাড়িঘর ছাড়া করছে। বরবাদ করছে ফল, ফসল, জীবিকা। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাপ রাজধানীসহ নগর-মহানগরগুলোয় বায়ুদূষণ স্বাভাবিক ঘটনায় এনে ঠেকিয়েছে। আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের এ তীব্রতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) কাছে ভয়াবহতা হিসেবেও শনাক্ত। তাদের মতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৯১টি দেশের বায়ুর গুণগত মানের বিচারে চতুর্থ অবস্থানে। ডবিøউএইচও বায়ুদূষণকে আরও অনেক আগেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে দায়ী করেছে। তাদের প্রতিবেদন বলছে, শহরের জনসংখ্যার ৯০ ভাগ বাসিন্দা প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণের বিপজ্জনক মাত্রার মুখোমুখি হচ্ছে। এটি অনুমান করা হয় যে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার আগেও বিশ্বব্যাপী মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বাইরের দূষণ দ্বারা অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে। এখনতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েক দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন মহামারি পরিবেশকে যে মাত্রায় নাজুক করেছে তা বেশি আয়ুকে বরং যন্ত্রণাময়ই করছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • jack ali ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১২:২৫ পিএম says : 0
    আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম চাপাবাজদের জন্য? এরা আজকে দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলেছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মানুষ

২৭ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন