Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

যুক্তরাষ্ট্রের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি

| প্রকাশের সময় : ২০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

গত বুধবার বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন প্রতিবেদন (সিপিসি) প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বর্নিত তালিকা আগেও ছিল। হালনাগাদ তালিকায় দুইটি পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তন দুটি হচ্ছে, রাশিয়াকে যুক্ত ও সুদানকে বাদ দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো তালিকা হালনাগাদ করা হয়। দেশটির সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন তার কার্যালয় থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ধর্মীয় স্বাধীনতার পদ্ধতিগত, চলমান এবং গুরুতর লঙ্ঘনের সাথে জড়িত বা সহ্য করার অভিযোগে দেশগুলোকে এ বিভাগে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমি বার্মা, চীন, ইরিত্রিয়া, ইরান, ডিপিআরকে, পাকিস্তান, সউদী আরব, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানকে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিয়মতান্ত্রিক, চলমান এবং গুরুতর লঙ্ঘনের সাথে জড়িত বা সহ্য করার জন্য বিশেষ উদ্বেগের দেশ হিসেবে মনোনীত করেছি। আলজেরিয়া, কমোরোস, কিউবা এবং নিকারাগুয়াকে বিশেষ ওয়াচ লিস্টে রেখেছেন বল তিনি উল্লেখ করেছেন। সংগঠন হিসেবে তালেবান, আইএসআই প্রভৃতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্লিঙ্কেন তার বক্তব্যে বলেছেন, আমরা এসব দেশের সরকারকে তাদের আইন ও অনুশীলনের ত্রুটিগুলো প্রতিকার করতে এবং অপব্যবহারের জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার জন্য চাপ দিতে থাকব।

বিশ্বমোড়ল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতি, মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ নানা বিষয়ে সোচ্চার। নাক গলানো থেকে শুরু করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করারও নজির রয়েছে।। এসব বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে উদ্বেগ জানানো এবং চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানানো সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পরাশক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এসব প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও সচেতন হয়। তবে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিষয়ে দেশটির আপডেট প্রতিবেদনে যেসব দেশের নাম দেখা গেছে, তার সিংহভাগই মুসলিম দেশ। বাকি যে দেশগুলো রয়েছে, সেগুলো তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত। ফলে প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ভারতের নাম তালিকায় না থাকা নিয়ে এ প্রশ্ন উঠেছে। পর্যবেক্ষকরা একে একপেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রতিবেদনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যে ‘মুসলমান বিদ্বেষ’ এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে। অথচ কে না জানে, বর্তমান বিশ্বে ধর্র্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুন্ন এবং মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, উচ্ছেদ, ধর্মান্তরকরণ থেকে শুরু করে দেশ থেকে বের করে দেয়ার সব ধরনের অপপ্রক্রিয়া ভারতে হচ্ছে। বিশ্বের আর কোনো দেশে এ মুহূর্তে এমন উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম বিদ্বেষ দেখা যায় না। ভারতের প্রতিবেশী যে পাকিস্তানের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেখানে কোনো হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বী হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন বা বিতাড়নের শিকার হচ্ছে, এমন ঘটনা বিগত কয়েক দশকের মধ্যে ঘটেছে বলে নজির নেই। অথচ ভারতে প্রতিদিন যেভাবে মুসলমানরা হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে, মসজিদ জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, জুমআর নামাজ আদায়ে বাধা দেয়া হচ্ছে, মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, এ বিষয়গুলো কি যুক্তরাষ্ট্রের চোখে পড়েনি বা পড়ছে না? সারাবিশ্বের বিখ্যাত সব সংবাদপত্রে এ নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোও কি তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না? নাকি ভারত তার বন্ধু হওয়ায় ‘সাত খুন মাফ’ হয়ে গেছে? যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের একচোখা নীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং মুসলিমবিদ্বেষ প্রসূত। যে তালেবানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেই তালেবানের সাথেই শান্তি চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। তালেবানকে তালিকাভুক্ত করা কি স্ববিরোধিতা নয়? যুক্তরাষ্ট্র কি এটাও দেখেনি, তার দেশের বিখ্যাত পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে ভারতের নির্মিত ‘সূর্যবংশী’ সিনেমায় মুসলমান বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয় কীভাবে সমালোচনা করেছে? মাস দুয়েক আগে আসামে যে পুলিশের গুলিতে নিহত মুসলমানের লাশের উপর উগ্র সাম্প্রদায়িক এক ফটোগ্রাফারের ‘নৃত্যদৃশ্য’ বিশ্বমিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে, তাও কি তার দৃষ্টিতে পড়েনি? আমরা যদি অতীতে ভারতের সাম্প্রদায়িকতার দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখব, ২০০২ সালে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অজুহাতে উগ্র হিন্দুরা দাঙ্গা বাঁধিয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি মুসলমানকে নৃশংস ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছে। গর্ভবতী মুসলমান নারী থেকে শুরু করে, শিশু, পুরুষদের জবাই ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২০০৬ সালে মালেগাঁও বিস্ফোরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জুমআর নামাজের পর মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে। তার দুই বছর পর ২০০৮ সালে একই এলাকায় আরেক বিস্ফোরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা মুসলমানদের হত্যা করেছে। দেশটিতে ধারাবাহিকভাবে মুসলমানদের ওপর এমন অমানবিক এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ অদ্যাবধি চলছে। বিশেষ করে কাশ্মীরে, আসামে, উত্তর প্রদেশে মুসলমান হত্যা, নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন মুসলমান বিদ্বেষ বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হত্যা-নির্যাতন চলতে দেখা যায় না। বর্তমানে মোদির শাসনাধীন ভারতের মুসলমানই নয়, অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছে না। বিশ্বের সকল দেশ এ পরিস্থিতি দেখলেও কেবল যুক্তরাষ্ট্রই দেখতে পাচ্ছে না।

একক প্রভাবশালী দেশ হিসেবে যেকোনো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মন্তব্য এবং বক্তব্য বিশ্বে গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক বলে বিবেচিত হতো। দুঃখের বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের সেই গ্রহণযোগ্যতা এখন নেই বললেই চলে। বিশ্ব নেতৃত্বে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। চীনের মতো বৃহৎ শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রকে আর আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছে না। এর কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার বিতর্কিত বক্তব্য ও প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন নীতি হচ্ছে, ‘আমার সাথে থাকলে এবং কথা শুনলে তুমি আমার বন্ধু, না হলে আমার শত্রু।’ দেশটিকে বুঝতে হবে, বিশ্বে তার এই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। এখন নিজের পছন্দমতো দেশকে শত্রু বা মিত্র বানানোর মতো বিশ্ব পরিস্থিতি নেই। যুক্তরাষ্ট্র ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমান বিদ্বেষ থেকে এটা করা হয়েছে। তার এ দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্র


আরও
আরও পড়ুন