Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জলবায়ু-পরিবেশ দূষণ ও অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হলে সুশাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

আমাদের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ কোনটি? এমন প্রশ্নে অনেকে অনেক রকমের জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেও বাস্তব সত্য হচ্ছে- নির্মল বায়ু, বিশুদ্ধ পানি এবং উর্বর মাটি এবং সবুজ ভূমি। তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতাপে এসব অমূল্য-মহামূল্য সম্পদগুলো আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এবারের করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের শতকোটি মানুষ আবারো উপলব্ধি করেছে, প্রতিদিন আমরা বিনামূল্যে নি:শ্বাসের সাথে যে অক্সিজেন গ্রহণ করছি তা কত অমূল্য, বেঁচে থাকার জন্য কত অপরিহার্য! আমাদেরকে ভোগবাদের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় ফেলে বাতাসে অক্সিজেনের মধ্যে নানা রকম বিষাক্ত অপদ্রব্য ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি ও পরিবেশ দূষণের শিকার সমগ্র মানব সম্প্রদায়। ভূমির উর্বরা শক্তি কমে যাওয়ায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বাড়তি খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থাকে নতুন নতুন জৈব প্রযুক্তি, রাসায়নিক যৌগ, পেট্টোকেমিক্যাল এবং যান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যবান্ধব কৃষি পদ্ধতি ও কৃষিবীজগুলোকে কৃষকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে কর্পোরেট এগ্রো কোম্পানির জিএমও বীজ এবং পেট্টোকেমিক্যালের উপর নির্ভরশীল করে তোলার মধ্য দিয়ে বিশ্বের কৃষিব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ছক সক্রিয় আছে গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই। পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশে দেশে ফসলহানি ও খাদ্যাভাবের সংকটকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের শ্লোগান তুলে এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, ভূ-গর্ভস্থ পানি নির্ভর যান্ত্রিক সেচব্যবস্থায় প্রচুর ফসিল জ্বালানি খরচ করে অতিরিক্ত যে ফসল উৎপাদিত হয়, তাতে কৃষকের খরচ উঠেনা। বাম্পার ফলনের পরও কৃষকের মুখে সেই হাসি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বায়ুতে ছেড়ে দেয়া ফসিল জ্বালানির দূষিত ধোঁয়া, মাটি ও পানিতে ছড়িয়ে পড়া নানা রকম বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষিজমি স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতা হারিয়েছে। খাদ্যের সাধারণ স্বাদ, পুষ্টি ও গুণাগুণের মধ্যেও ভেজাল ঢুকে গেছে। দেশে দেশে মানুষের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা আমাদের কাছ থেকে মহান ¯্রষ্টার দেয়া অমূল্য দান তথা নেয়ামতগুলোকে শুধু কলুষিতই করে তোলা হচ্ছে না, এসব সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকারিতা কতিপয় কর্পোরেট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার পরিবেশবান্ধব সম্ভাব্য বিকল্প উদ্যোগগুলোকে পাশকাটিয়ে রাতারাতি কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর নামে গত ৫-৬ দশকে মনসান্টো, সিনজেন্টা, কারগিল, বায়ারের মত পেট্টোকেমিক্যাল কোম্পানী এখন বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থার বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।

গত এক সপ্তাহ ধরে ভারতের রাজধানী দিল্লীর স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত বছরের করোনা লক-ডাউনের ঝক্কি সামলে উঠতে না উঠতেই এবার প্রবল বায়ুদূষণের কারণে এখন আবারো সর্বাত্মক লক-ডাউনের কথা ভাবতে হচ্ছে দিল্লী সরকারকে। গত বছরের শুরুতে ভারতে করোনা লক-ডাউনের কারণে হঠাৎ বায়ু দূষণের মাত্রা কমে যাওয়ায় অনেকদিনের ধুলোর আস্তরণ থিতিয়ে নির্মল হয়ে পড়ায় ভারতের সীমান্ত এলাকায় দূরের পাহাড়চূড়ার মনোরম দৃশ্য অবলোকনের সচিত্র সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এর কিছুদিন আগেও ধুলোর আস্তরণে দিনের বেলায় দিল্লীর আকাশের সূর্য অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ার খবর বিশ্ব সংবাদ হয়েছিল। তখন রাস্তায় গাড়ি চালনা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়েছিল দিল্লী সরকার। এবারের অবস্থা আগের চেয়েও অনেক খারাপ। বায়ু দূষণের কারণে মানুষের চলাচল ও জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার বাস্তবতা নিয়ে এখন দিল্লী হাইকোর্টে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। দু-চারদিন যানবহন বন্ধ রেখে বা লকডাউন দিয়ে এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব কিনা সে প্রশ্নও উঠে এসেছে। চিফ জাস্টিস এনভি রমন এটর্নি জেনারেল তুষার মেহতাকে এই প্রশ্ন করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভারত তার প্রতিদ্ব›দ্বী চীনের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে রাজধানী শহর দিল্লীকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরে পরিনত করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা গত এক দশক ধরে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে স্থান পাচ্ছে। শুধু ঢাকা নয়, পুরো বাংলাদেশই এখন চরম বায়ু দূষণের শিকার হয়েছে। ঢাকার চারপাশের সব নদীর পানি বহু আগেই তার স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়েছে। এসব নদীতে এক সময় জেলেরা মাছ ধরতো, জনপদের মানুষ নদীতে গোসল করতো, শাপলা-শালুক কুড়াতো। এখন এসব নদীর পাশে দাঁড়ালে তীব্র দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে মুখে রুমাল চেপে ধরতে হয়। একেকটি নদী বিষাক্ত পানির ¯্রােতধারায় পরিনত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণের জন্য গত অর্ধ শতাব্দী ধরে হাজারীবাগ টেনারি শিল্পের রাসায়নিক দূষণকে অন্যতম কারণ হিসেবে দাবি করা হয়েছিল। হাজারীবাগ থেকে টেনারিশিল্প সরিয়ে নিয়ে সাভারে একটি আধুনিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ টেনারিশিল্প নগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল আরো দুই দশক আগে। এক বছরের মধ্যে বাস্তকায়নযোগ্য সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সরকারের দুই দশক পেরিয়ে গেছে। হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নেয়া টেনারি কারখানাগুলো এখন সাভারের জলাভূমি, খাল ও ধলেশ্বরী নদী চরমভাবে দূষিত করছে। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে সিইটিপি বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখন পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকেও সাভারের ট্যানারি শিল্প বন্ধের দাবি তোলা হচ্ছে। টেনারিশিল্প দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি বড় খাত। এ শিল্পের সাথে জড়িত আছে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ও শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। ট্যানারি শিল্পাঞ্চলের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে পরিচালিত করতে না পারার কারণে এ শিল্পের রাসায়নিক দূষণ যদি নদ-নদীকে বিষাক্ত করে তোলে, কোটি কোটি মানুষের বাস্তু ও জনস্বাস্থ্যের উপর যদি সরাসরি এর বিরূপ প্রভাব পড়ে তাহলে এমন শিল্প বন্ধ করে দেয়াই শ্রেয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে ফসিল জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কৃষিব্যবস্থা, শিল্পায়ণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বনভূমি, পাহাড়, নদী সংরক্ষণ ও নগরায়ণের পরিবেশগত বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করা। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্বের উষ্ণায়ন ও ক্লাইমেট চেঞ্জের বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা সতর্ক সঙ্কেত দিলেও ধনী দেশগুলোর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতার কারণে জাতিসংঘের মত বিশ্ব সংস্থা তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। স্কটল্যান্ডের গøাসগোতে কপ-২৬ বা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের ২৬তম আসর বসেছিল। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্টের কারণগুলো নিয়ন্ত্রণসহ বিশেষত ফসিল জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কমিয়ে আনতে ছাব্বিশ বছর ধরে পরিচালিত প্রয়াসের নাম কপ(সিওপি- কনফারেন্স অব পার্টিজ)। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ১৯৯২ সালে রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত আর্থ সামিটের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ১৯৯৫ সালে জার্মানীর বার্লিনে প্রথম পূর্নাঙ্গ জলবায়ু সম্মেলন কপ-১ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত কিউটো সম্মেলনে গৃহীত কিউটো প্রটোকল থেকে এ পর্যন্ত ২৬টি কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। এর জন্য মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের মত অর্থনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বী দেশগুলোই দায়ী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কপ-২১ বা ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ালে এ ক্ষেত্রে একটি বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওয়াশিংটনের ক্ষমতায় থাকায় কপ-২৫ পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর কিছুদিন আগে স্পেনের মাদ্রিদে কপ ২৫ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে প্রত্যাবর্তনে জো বাইডেনের প্রতিশ্রæতির প্রেক্ষাপটে এবারের কপ-২৬ সম্মেলন নিয়ে কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছিল বিশ্ব। তবে ভারতের মত দেশের একগুঁয়েমির কারণে কয়লা ভিত্তিক জ্বালানি দূষণের সাথে আপস করতে বাধ্য হয়েছেন বিশ্ব নেতারা। ভারতের আবহাওয়া বিষয়ক মন্ত্রী ভুপেন্দার যাদবের বিরোধিতার কারণে গøাসগো চুক্তি থেকে সবচে ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার প্রতিশ্রæতি আটকে গেছে। ভুপেন্দার যাদব যখন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে কয়লার অমিত ব্যবহারের পক্ষে তার যুক্তি তুলে ধরছেন, তখন দিল্লীর আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। ফসিল জ্বালানি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার ধুলিতে বাতাসে মানুষের দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে, আবারো সর্বাত্মক লক ডাউনের প্রস্তুতি চলছে বলে বিজনেস ইনসাইডার অনলাইনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।

ভোগবাদী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে ক্ষমতার দ্ব›দ্ব, ধনলিপ্সা, দুর্নীতি ও বেপরোয়া লুন্ঠনবাজির সূচনা। লুণ্ঠন দুর্নীতির মচ্ছব এখন আকাশ-বাতাস, মাটি-পানির দূষণ ছাপিয়ে মানুষের মন-মগজ ও সমাজবাস্তবতার গভীরে কারসিনোজেনিক ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে। আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব সম্ভাবনা রুদ্ধ হতে বসেছে। দেশের বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ও মানবাধিকারের মত মৌলিক গণতান্ত্রিক বিষয়গুলো এখন কালোটাকার মালিকদের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আগে অর্থনৈতিক লুণ্ঠনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। মাত্রারিক্ত জীবাশ্ম ও ফসিল জ্বালানির উপর বারে বিশ্বের জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের বারোটা বাজিয়ে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা করা হচ্ছে, কয়লা পোড়ানো ও ট্যানারি বর্জ্যে প্রাণের আকর বাতাস ও পানি দূষিত করে অর্জিত অর্থের বড় অংশই দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশে দেশে মানুষের মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার, ন্যায়বিচার, সুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের সুশিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

গত শতাব্দীতে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, যুদ্ধবিমান-মারনাস্ত্রের অভাবনীয় অগ্রগতির মধ্য দিয়ে দুইটি মহাযুদ্ধ এবং দেশে দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বল্গাহীন প্রতিযোগিতা বিশ্বের মানুষকে মানবিক-আধ্যাত্মিক চেতনা থেকে বিচ্যুত করেছে। ভূ-পৃষ্ঠের গঠন প্রক্রিয়ায় ভূ-অভ্যন্তরে কোটি কোটি বছরে সঞ্চিত জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষের সভ্যতা, প্রযুক্তি ও ভোগ বিলাসের প্রধান জ্বালানি হলেও এর অমিতব্যয়ী ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বেখবর-বেপরোয়া হওয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে সমগ্র মানব সভ্যতা ও প্রাণী জগৎকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় সৌর-কীরণের ওজনস্তর ক্ষয়ে গিয়ে প্রাণী-দেহের জন্য ক্ষতিকর অতি বেগুনী রশ্মি সরাসরি ভূ-পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হওয়ার কারণে মানবদেহে ক্যান্সারের মত নানাবিধ রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়ে মানুষের মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে। গত এক শতাব্দীতে পৃথিবীর বনজঙ্গল কমেছে অস্বাভাবিক হারে। সেই সাথে প্রাণীজগৎ থেকে হাজার হাজার প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশে দেশে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও ঐতিহ্যবাহী কৃষিব্যবস্থায় যেসব ফসল ও উদ্ভিদের চাষাবাদ চলছে, সেসব বীজ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর এক্সপেরিমেন্ট ও বাণিজ্যিকিকরণের ধারায় বিলীন হতে চলেছে।

কোটি কোটি মানুষ যখন ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, উচ্চ রক্তচাপসহ নানাবিধ নতুন নতুন স্বাস্থ্য উপসর্গে আক্রান্ত হচ্ছে। যখন কোটি কোটি মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও অপরিহার্য ওষুধের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, তখন শ্রেফ খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর অজুহাতে ট্র্যাডিশনাল কৃষিবীজগুলো কৃষকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ক্ষতিকর জিএমও বীজ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিশাপ থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে হলেও উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গতানুগতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাব ও প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। খাদ্যচক্র সংরক্ষণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনপ্রণালীতে পরিবর্তন ও কৃষিব্যবস্থাকে পেট্টোকেমিক্যাল নির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের মানবিক-নৈতিক-আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও সামাজিক নিরাপত্তার ইস্যুগুলোকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হবে। এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন দুর্নীতি, ক্ষমতার অনৈতিক দ্ব›দ্ব, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক লুটপাটতন্ত্র বন্ধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আগামী বছর মিশরের শার্ম আল শেখে অনুষ্ঠেয় ২৭ তম কপ সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর তরফে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরুর প্রত্যাশা রাখতে চাই। কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার আগেই বিশ্বের শতকোটি মানুষ রাজনৈতিক-মানবিক-অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের শিকার হয়েছে। মানুষকে পুঁজির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে মানবিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জলবায়ু


আরও
আরও পড়ুন