Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মৎস্য চাষ : কর্মসংস্থানের উপযুক্ত ক্ষেত্র

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

মাছ চাষ করার আগে প্রথমে পুকুরের মাটির গুণাগুণ এবং উৎপাদন ক্ষমতা জেনে নেয়া আবশ্যক। পাথুরে মাটি বা বালু মাটিতে মাছের তেমন বৃদ্ধি ঘটে না। সাধারণত দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটিতে মাছের উৎপাদন বেশি হয়। সুতরাং পুকুর খননের আগে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে নেয়া অপরিহার্য। মাছ পালনে সুফল পেতে হলে চাষীদের সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর নির্ভর করা উচিত। মাছ চাষ করার পুকুরটি কমপক্ষে এক বিঘা বা তার চেয়ে বেশি আয়তনের হওয়া উচিৎ। অন্যথায় আশানুরূপ ফলন পাওয়া সম্ভব নয়। পুকুরপাড়ে অনাবশ্যক গাছ লাগানো ঠিক নয়। কারণ, গাছের পাতা পানিতে পড়ে পচে মাছের বসবাসের অনুপযুক্ত করে তোলে। পানিতে জলজ উদ্ভিদ বা কচুরীপানা থাকলে মাছের মারাত্মক ক্ষতিসাধন হয়। এ ব্যাপারে মাছ চাষী ভাইদের সাবধান হওয়া দরকার।
মুক্ত আলোতে পুকুরটিকে সবসময় জলজ উদ্ভিদ মুক্ত রাখতে হবে। অনেকের ধারণা পানিতে কচুরীপানা থাকলে মাছ শেকড় থেকে আহার সংগ্রহ করে দৈহিক বৃদ্ধি ঘটায়, এ ধারণা পুরোপুরি ভুল। কচুরিপানা খুব বেশি পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ করায় পানির মধ্যে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। এ অবস্থা মাছের জন্য খুব ক্ষতিকর। মাছের ক্ষতিসাধন করতে পারে এমন বহু কীটপতঙ্গ জলজ উদ্ভিদের শেকড় ও পাতায় আস্তানা গেড়ে সহজে বেড়ে উঠে, যা মাছের রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সুতরাং সর্বাবস্থায় পুকুর জলজ উদ্ভিদ মুক্ত রাখা চাই। পুকুর খননের সময় এমন ব্যবস্থা রাখা দরকার যাতে বর্ষায় অধিক পানি হলে তা সহজে বের করে দেয়া যায়, আবার খরা মৌসুমে পানি বেশি কমে গেলে নিকটস্থ কোন উৎস থেকে পুকুরের ভিতরে প্রবেশ করানো সম্ভব হয়। মাছের অধিক উৎপাদনের জন্য পুকুরের গভীরতা ২ থেকে ২.৫০ মিটার হওয়া বাঞ্চনীয়। এর চেয়ে বেশি গভীরতা মাছের বৃদ্ধির প্রতিবন্ধক।
অনেক সময় নতুন পুকুরে মাছ বাড়তে সময় লাগে। অর্থাৎ মাটির উর্বরতা শক্তি সৃষ্টি হতে ৩/৪ বছর সময় লেগে যায়। নতুন পুকুর খননের সময় উপরের ৬/৭ ইঞ্চি মাটি প্রথমে আলাদা করে সরিয়ে রাখতে হবে। পুকুর খনন শেষ হলে তলদেশে এ সরানো মাটিগুলো বিছিয়ে দিয়ে শক্ত করে বসিয়ে দিতে হবে। এবার বিঘা প্রতি ৩০০ কেজি কমপোস্ট সার ছড়িয়ে দিতে হবে। বাড়ির আবর্জনাগুলো একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কাঁচা গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে ভালভাবে পচিয়ে নিলে কমপোস্ট সার তৈরি হয়। এ কমপোস্ট সার পুকুরের জন্য খুব উপকারী। এভাবে পুকুর খনন করে প্রথমে এক ফুট পানি প্রবেশ করিয়ে আরো ১৫/২০ দিন অপেক্ষা করতে হবে। পচন সারগুলো পানির সঙ্গে মিশে পুকুরের তলদেশকে উর্বর করে তুলবে। এবার পানি প্রবেশ করিয়ে পুকুর পূর্ণ করতে হবে। এরপর প্রয়োজন মত চুন ও সার প্রয়োগ করতে পারলে নতুন পুকুরে পুরাতন পুকুরের মত মাছের ফলন পাওয়া সম্ভব।
পুরাতন পুকুরে মাছ চাষ করতে চাইলে সম্ভব হলে তা শুকিয়ে নিয়ে মাছ ও জলজ উদ্ভিদ মুক্ত করে কয়েকদিন শুকিয়ে নিয়ে তারপর চুন প্রয়োগ করতে হবে। পানি শুকানো সম্ভব না হলে সাবান ও মাহয়া তৈলের সংমিশ্রণ প্রয়োগ করে মাছ পানিতে থাকা অবস্থায় মাছের পোনা ছাড়লে বৃদ্ধি বেশি হয় না। কারণ পানিতে মাছের যে আহার বর্তমান থাকে তাতে এ অবাঞ্চিত মাছগুলো ভাগ বসায়। যার ফলে পোনা মাছগুলোর বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। সুতরাং ভাল ফলন পেতে হলে পোনা ছাড়ার আগে কয়েকটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, পুকুর পরিস্কার করে নিতে হবে যাতে পানিতে কোন জলজ উদ্ভিদ না থাকে। দ্বিতীয়ত, অবাঞ্চিত মাছ তুলে নিতে হবে। তৃতীয়ত, পুকুরে চুন ও সার প্রয়োগ। সার প্রয়োগের ৮/১০ দিন আগে বিঘা প্রতি ৭০ কেজি চুন প্রয়োগ করা দরকার। চুন প্রয়োগের ফলে একদিকে মাছের বৃদ্ধি হয়, অন্যদিকে মাছের রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। ফলে মাছের স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে। পুকুরে পোনা ছাড়ার তিন সপ্তাহ আগে বিঘা প্রতি ৬৭০ কেজি কাঁচা গোবর প্রয়োগ করা দরকার। মাছের চারা গোবর থেকে উৎপন্ন নাসীয় অনুজীব আহার হিসাবে গ্রহণ করে তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠে। বিভিন্ন জাতের মাছ এক সঙ্গে পালন করলে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে তুলনামূলক হারে বেশি। তাই মাছের ভাল ফলনের জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিক মিশ্র চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। একেক ধরণের মাছ পুকুরের একেক স্তরের খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। কোনোটি উপরের স্তরের আহার গ্রহণ করে আবার কোনটি মধ্য অংশে কোনটি শুধু নিচের অংশের আহার গ্রহণ করে। সুতরাং কোন মাছ কোন স্তরে খাদ্য গ্রহণ করে তা আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন। আমাদের দেশীয় মাছের মধ্যে কাতলা উপরের অংশে, রুই মধ্যবর্তী অংশে এবং মৃগেল নিচের অংশে খাদ্য গ্রহণ করে। বিদেশীজাত মাছের মধ্যে গ্রাসকার্প উপরের অংশে এবং কমনকার্প নিচের অংশে খাদ্য গ্রহণ করে। অতএব মিশ্র চাষে এ ছয় প্রকার মাছ সাধারণত ছাড়া হয়। মিশ্র চাষে পুকুরের সকল স্তরের খাদ্য মাছ গ্রহণ করে থকে, ফলে মাছের বৃদ্ধি অধিক হয়। চুন ও জৈব সার প্রয়োগের পর পুকুরটি মাছের পোনা ছাড়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে। ভাল ফলনের জন্য সুস্থ ও নিরোগ মাছের পোনা নির্বাচন অত্যন্ত জরুরী। কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা পোনা সংগ্রহ করা দরকার। এর চেয়ে ছোট সাইজের পোনা পুকুরে ছাড়লে অধিকাংশ পোনা নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। মিশ্র চাষে দেশী ও বিদেশী যে ৬ জাতের মাছের কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে এগুলো একসঙ্গে চাষ করা সবচেয়ে লাভজনক। প্রতি বিঘা পানিতে কোন মাছ কি পরিমাণ দিতে হবে তার সঠিক হিসাব প্রত্যেক চাষীদের জানা থাকা দরকার অন্যথায় ভাল ফলনের আশা করা যায় না। প্রতি বিঘা পানিতে কাতলা-৩৫০, সিলভার কার্প-১৫০, রুই-৪০০, গ্রাস কার্প-৩০০, মৃগেল-৩০০, কমনকার্প-৫০০ মোট ২০০০ টি পোনা ছাড়তে হবে। আবার শুধু দেশি জাতের কাতলা, রুই ও মৃগের এ তিন জাতের মাছ একসঙ্গে চাষ করলে বিঘা প্রতি কাতলা-৩০০, রুই- ৪৫০, মৃগেল-৬০০ মোট ১৩৫০টি চারা ছাড়তে হয়।
মাছ পুকুরে ছাড়ার পর এদের পরিচর্যা করা আবশ্যক। একদিকে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য ভান্ডার মজবুত করতে হয়, অপরদিকে পরিপূরক আহার সরবরাহ করে মাছের অধিক উৎপাদনে সাহায্য করতে হয়। শুধু প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর নির্ভর করলে আশানুরূপ ফল লাভ করা সম্ভব নয়। মাছের পোনা পুকুরে ছাড়ার পর ১০টি মাসিক কিস্তিতে প্রতি বিঘায় প্রতিমাসে গোবর ২৭০ কেজি, ইউরিয়া ৩ কেজি, সুপারফসফেট ১২ কেজি, মিউরেট অব পটাশ ২ কেজি প্রয়োগ করা আবশ্যক। সার প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যদি পানিতে শেওলা জন্মে তবে কিছুদিনের জন্য সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। ‘যত সার তত মাছ’-এ বিশ্বাস ঠিক নয়। মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগ করলে পুকুরের উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং মাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। সুতরাং লক্ষ্য রাখা দরকার সার ও পরিপূরক আহার যেন পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করা হয়।
পরিপূরক খাদ্য হিসেবে সমপরিমাণ চালের ভুসি ও খৈলের গুঁড়া একত্রে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়। মাছের পোনা ৮/১০ ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা হয়ে গেলে চালের ভুসি ও খৈলের গুঁড়া ভিজিয়ে ঢোলা তৈরি করে কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে থালায় দেয়া যেতে পারে। এতে খাদ্যের অপচয় কম হয়। পুকুরে প্রতি বিঘা পানিতে বছরে ৮০০ কেজি পরিপূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। প্রথম ৩ মাসে প্রতিদিন ৯০০ গ্রাম করে, দ্বিতীয় ৩ মাসে প্রতিদিন ১৮০০ গ্রাম করে, তৃতীয় ৩ মাসে প্রতিদিন ২ কেজি ৭০০ গ্রাম করে এবং শেষ ৩ মাসে প্রতিদিন ৩ কেজি ৬০০ গ্রাম করে পরিপূরক খাদ্য দেয়া হয়। বিশেষ করে সকালের দিকে খাদ্য দেয়া উত্তম। কয়েকদিন পরপর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা দরকার। কোন রোগের আশঙ্কা হলে সঙ্গে সঙ্গে বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে সুপরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। এভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পুকুর তৈরী করে পরিমিত সার ও পরিপূরক আহার প্রয়োগ করলে চাষী ভাইয়েরা মাছে ভাল ফলন পাবেন। মাঝে মধ্যে বাজারে চালু মাল্টিপ্øেক্স ব্যবহার করলে পুকুরটি খনিজ সারে সমৃদ্ধ হবে এবং মাছের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
পুকুর ছোট হোক আর বড় হোক, এ কথা সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে, মাছের ভাল ফলন পাওয়ার জন্য প্রচলিত ধারণাকে ত্যাগ করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে মাছ চাষ শুরু না করলে কখনো আশানুরূপ ফল লাভ সম্ভব নয়। চাষী ভাইদের এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবার জন্য সবসময় বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের সুপরামর্শ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসা উচিত।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৎস্য


আরও
আরও পড়ুন