পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনের ঐশীত্ব, মহত্ত্ব ও এর স্থায়িত্ব কেয়ামত পর্যন্ত হেফাজতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আল কোরআন মানব জাতির ওপর মহান স্রষ্টার পবিত্র আমানত। এই অর্থে যে, এর মাধ্যমে বিশ্বে আল্লাহর নির্দেশিত বিধান কায়েম করবে, যা সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দেয়। শয়তান পৃথিবীতে এসেছে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে, মানুষের মধ্যে বিভাজন, ভেদাভেদ, সহিংসতা ও রক্তপাতের ঘটনার জন্ম দিয়ে প্রত্যাশিত শান্তি ও সৌহার্দ্যরে পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করতে। আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ, তোমার ধর্ম নিকৃষ্ট, এটা বলে আজ পর্যন্ত কাউকে সঠিক পথে নিয়ে আসার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্বজাহান ইসলামে মুরিদ’। কলেমার পতাকাতলে শামিল হয়ে প্রবল অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে অসম সাহসে সাধারণ মানুষের সাম্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যেমন ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাস, সেই সাথে আল্লাহর মনোনীত চিরন্তন ধর্মের শান্তির বাণী বিশ্বের দেশে দেশে পৌঁছে দিতে আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষরা নিজেদের ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবনের সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করে ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হজরত শাহজালাল-শাহপরাণের সহযোগীরা সুদূর ইয়েমেন থেকে নিজেদের সহায়সম্বল যা কিছু ছিল তাই নিয়ে এই পশ্চাৎভূমি বাংলাদেশে এসে নৌকা ভিড়িয়েছিলেন। এরপর বছরের পর বছর ধরে এ দেশের নিপীড়িত হতদরিদ্র, ভুখা-নাঙ্গা মানুষগুলোর মুখে একবেলা অন্ন তুলে দিতে নোঙরখানা চালু রেখেছিলেন। সেই সাথে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রবল অত্যাচারী স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতেও তারা কুণ্ঠিত হননি। এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ইখতিয়ারুদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয় একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সামরিক-ঐতিহাসিক ঘটনা হলেও সেই ঘটনায় তৎকালীন বাংলার রাজাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিরোধ বা রক্তপাতের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এদেশের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা উচ্চবর্ণের জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির দ্বারা অত্যাচারিত ও নিগৃহীত ছিল। সাম্য, মুক্তি ও শান্তির বাণী নিয়ে আসা মুসলমান ওলি-আউলিয়াদের ত্যাগ ও অহিংস চেতনা তাদের নতুন আলোর সন্ধান দিয়েছিল বলে এ দেশের মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিল।
আল কোরআন মানুষের জন্য ‘কমপ্লিট কোড অব লাইফ’ বা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান রূপে স্বীকৃত। এটি কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা শুধু মুসলমানের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। তবে যারা ইসলামকে নিজেদের ধর্ম এবং কোরআনের নির্দেশনাকে নিজেদের জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা কোরআনের প্রতি সেন্সেটিভ হওয়া স্বাভাবিক। কোরআনের কোনো অবমাননা তারা সহ্য করতে পারেন না। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি ও অতি প্রতিক্রিয়াশীলতা লক্ষ করা যায়। এ কারণেই নেপথ্যে ক্রিয়াশীল শয়তানি শক্তি মুসলমানদের উস্কে দিতে কখনো কোরআন অবমাননা, কখনো রাসূলের ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করে, কখনো ইসলাম সম্পর্কে মিথ্যা ও ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করে মুসলমানদের দাঙ্গাবাজ, কলহপ্রিয়-অসহিষ্ণু বলে প্রমাণ করতে চায়। গত কয়েক দশকের মধ্যে বিতর্কিত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ পর্যন্ত ইসলাম অবমাননার সাথে জড়িত কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি মুসলমানরা। তবে মুসলমানদের প্রতিবাদী কণ্ঠের পাশাপাশি জনতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বার্থান্বেষী চক্রের ইন্ধনে কখনো কখনো সহিংস শক্তির তৎপরতাও আছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতাআলা রাসূল (স.)-কে বলছেন, হে রাসূল যারা আপনাকে অপমান করে, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে আপনি তাদের এড়িয়ে চলুন, আল্লাহ উত্তম ফায়সালা করবেন। পশ্চিমা বিশ্বে জায়নবাদীদের এজেন্টরা মুসলমানদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিতে, প্রতিবাদের নামে সহিংসতায় উস্কে দিয়ে বদনাম করতে নানা ধরনের উস্কানিমূলক তৎপরতা দেখা গেছে। পক্ষান্তরে গত হাজার বছরেও মুসলমানরা কখনো কোনো ধর্ম বিশেষের জন্য অবমাননাকর কিছু করার রেকর্ড নেই। সুইডিস কার্টুনিস্ট লার্স ভিঙ্গ ২০০৭ সালে ইসলামের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর কার্টুন আঁকায় পুরো বিশ্বে মুসলমানদের প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। ইউরোপের একশ্রেণির মানবাধিকারকর্মী ফ্রিডম অব স্পিচ, ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের কথা বলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করতে চাইলে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত একাধিক সংস্থার তরফ থেকে ইসলাম অবমাননাকর বক্তব্য ও কার্টুন-ব্যঙ্গচিত্রকে অধিকারের পরিপন্থী হিসেবে মত প্রকাশ করেছিল। বিশ্বের যেখানেই থাকুন, ইসলাম ও রাসূলের অবমাননাকারীরা কখনো সাধারণ মুক্তভাবে জীবনযাপন করতে পারেন না। রার্স ভিঙ্গেরও জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি ছিল। সুইডিস সরকার তার জন্য সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। গত ৩ অক্টোবর এক সড়ক দুর্ঘটনায় লার্স ভিঙ্গ তার দুই দেহরক্ষীসহ নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পর গাড়িতে আগুন ধরে গেলে তাদের দেহ পুড়ে যায় বলে খবরে জানা যায়।
এ দেশে শারদীয় দুর্গাপূজার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়কে সেলিব্রেট করতে লর্ড ক্লাইভের পৃষ্ঠপোষকতায় বসন্তকালীন দুর্গাপূজাকে শরৎকালে উদযাপনের মাধ্যমে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রলেপ দেয়া হয়েছিল বলে কথিত আছে। সে থেকেই বর্ণভেদাক্রান্ত হিন্দু ধর্মীয় দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানকে সার্বজনীন খেতাব দেয়া হয়। এদেশে হিন্দু-মুসলমানরা হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে খ্রিষ্টান-ইহুদি ও মুসলমানদের হাজার বছর ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্য ছিল। ইহুদি ধর্মবিশ্বাস থেকে জুদাইজম এবং জুদাইজমের উচ্চাভিলাসী আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর সেই ঐতিহ্য নস্যাৎ হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ভারতে হিন্দুত্ববাদ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে এ উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যে চির ধরতে শুরু করে। এ দুই ক্ষেত্রেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির ভিত্তিতে নেপথ্যে সক্রিয় ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ সংহত করার এজেন্ডা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বিদায় হলেও তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডা এবং ডিভাইড অ্যান্ড রুলের রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে এখনো সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য যতই সমাজের অভ্যন্তরে প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে, ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভাজন যেন তত বেশি রাজনীতির বিকল্প শক্তি হয়ে উঠেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে এখন ধর্মীয় দল ও গোষ্ঠীগুলো রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতের ক্ষমতাসীনরা মূলত ইসলাম বিদ্বেষকে পুঁজি করে দেশের সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক শক্তিকে দাবিয়ে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থাকার সব রকম তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। কয়েক মাস আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসকে হটিয়ে সেখানে বিজেপির শাসন কায়েম করতে দিল্লির কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতারা ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিলেন। সে সময় নির্বাচনের ব্যালটে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ভারতে নতুন করে ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ভারতে ধারাবাহিক মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গায় অনেক মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনার মধ্যেই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে গণবিক্ষোভের জন্ম হয়। মোদির ঢাকা আগমনের বিরোধিতায় দেশের রাজনীতিতে নতুন এক ঐক্য গড়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে, মধ্যপন্থী বিরোধী দল, ইসলামি দল ও হেফাজতে ইসলামসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একসুরে মোদির আগমনের বিরোধিতায় কণ্ঠ মিলিয়েছিল। মোদিবিরোধী প্রতিবাদ দমাতে গিয়ে সরকারি বাহিনীগুলো গুলি করে বেশ কিছু মানুষকে হত্যা করেছিল। এত কিছুর পরও নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ক্যাম্পেইনের জন্য সাতক্ষীরার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েছিলেন ভোট চাইতে। তবে নির্বাচনে মোদির বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিধস বিজয় ঠেকাতে পারেনি।
একটি অসৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বিজেপি নিজেদের শাসন কায়েম করতে চায়। আসামে সফল হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দাঁত ভেঙেছে মোদির। এখন ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন খেলায় মেতেছে বিজেপির এজেন্টরা। এ খেলার কুশীলবরা বাংলাদেশেও সক্রিয় থাকতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। ত্রিপুরার সন্নিকটবর্তী কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে মূর্তির পায়ের উপর কোরান রেখে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেয়া এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনাকে দেশের কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দল ও গোষ্ঠী সমর্থন না করলেও বিজেপি ইসকন নেতাদের অতি প্রতিক্রিয়া এবং বিষয়টিকে জাতিসংঘ মহাসচিব পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পেছনে সেই রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি কাজ করছে বলে সহজেই অনুমান করা যায়। ভারতের বিজেপি সরকার দেশের অসাম্প্রদায়িক সাংবিধানিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে সে দেশে চরম হিন্দুত্ববাদী শাসন চিরস্থায়ী করতে চায়। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করে তারা সে লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) এবং ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি)-এর মতো বিতর্কিত, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও বর্বর আইন জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে উপমহাদেশজুড়ে অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। শত শত বছর ধরে বসবাসরত আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করার নাটকীয় তৎপরতা এখনো সক্রিয় রয়েছে। এ অপতৎপরতার বিষয়ে বাংলাদেশ নীরব থাকতে পারে না। ২০১৮-১৯ সালে আসামে সিএএ আইনের বিরুদ্ধে সেখানকার বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানরা একাট্টা হয়ে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সিটিজেনশিপ আইনবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫ জন নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বসেছিল। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মাঝখানে দেড় বছর সবকিছু কিছুটা সংযত থাকলেও করোনা মহামারি সামলে ওঠার পর আবারো সেখানে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আসাম ট্র্যাডিশনালি অবিভক্ত বাংলার অংশ, সেখানে হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-অসমীয়রা যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। আসামের মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা ও উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে। উদাহরণ স্বরূপ ভারতের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমদের পরিবারের কথা বলা যায়। ফখরুদ্দিনের বাবা কর্নেল জালনুর আলি আহমেদ ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডাক্তার ছিলেন। ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ কংগ্রেসেরে নমিনেশন নিয়ে আসামের বারপেটা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে ভারতের ৫ম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকাবস্থায় ১৯৭৭ সালে নয়াদিল্লিতে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। বিজেপির সিটিজেনশিপ আইনে ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের বেশ কয়েকজন বাদ পড়েছিলেন বলে খবর বেরিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর আসাম ও ত্রিপুরা নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে হিন্দুত্ববাদীরা, এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশে পূজামণ্ডপে কথিত কোরান অবমাননা, বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলার উস্কানি এবং এ নিয়ে ভারতীয়দের নাক গলানোর নানামুখী তৎপরতা যেন একই সূত্রে গাঁথা। কোনো ধার্মিক মুসলমান বা হিন্দু অন্য ধর্মের গ্রন্থ বা ধর্মাচারের অবমাননা করতে পারে না। বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মীয় নেতারাও এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য মহলবিশেষের অপতৎপরতা বলে দাবি করেছে। ঘটনা এখনো শেষ হয়নি। পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। রংপুরের জেলে পল্লীতে রহস্যজনক আগুনে বেশ কিছু ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। ভারতীয় সিন্ডিকেটেড মিডিয়াগুলো এসব ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে সারাবিশ্বে প্রচার চালাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান সাধারণ মানুষ, সরকার এবং সব প্রধান রাজনৈতিক দল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। ভারতের কাশ্মিরে, দিল্লিতে, আসাম-পশ্চিমবঙ্গে জাতীয়তার নামে, গো-রক্ষার নামে একের পর এক মুসলিম বিদ্বেষী আইন এবং অমানবিক তৎপরতায় এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও বাংলাদেশে তার কোনো আঁচ লাগেনি। এ দেশের মানুষের ধর্মীয় চেতনার মূল শিক্ষাই হচ্ছে, প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের জানমালের হেফাজত করা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর শিক্ষা হচ্ছে, মুসলমানদের শাসনে সব সম্প্রদায়ের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আজ যারা কোরআন অবমাননার ধুয়া তুলে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের উস্কানি ও ইন্ধন দিচ্ছে তারা পরোক্ষভাবে বিজেপির এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে কৃত্রিম সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আসাম-ত্রিপুরায় মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের মুখ বন্ধ রাখতে চায়। বাংলাদেশের জনগণ, সব রাজনৈতিক শক্তি, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ ও সচেতন আছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। কোনো অপশক্তির দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।