পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পাশাপাশি সংঘাত-সহিংসতা এবং হিন্দুদের বাড়িঘর দোকানপাটে হামলা ও অগ্নিসংযোগের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃংখলা সুরক্ষায় ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়ার পরও এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটতে পেরেছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন রয়েছে। ইতোমধ্যে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন প্রতিবাদকারী নিহত হয়েছে। হামলা ও সহিংসতার জেরে আরো একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পূজামণ্ডপে মূর্তির পায়ের ওপর পবিত্র কোরআন রাখার মতো গর্হিত কাজ আর কিছু হতে পারে না। কোনো প্রকৃত সনাতন ধর্মাবলম্বী বা কোনো প্রকৃত মুসলমানের পক্ষে এ ধরনের অপকর্ম করা সম্ভব নয়। বুঝাই যায়, কোনো কুচক্রী মহলের প্ররোচনা এবং প্রত্যক্ষ মদদে কেউ বা কিছুলোক এটা করেছে। এতে রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য ও মতলব। দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি হলে, অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে যাদের লাভ, তারাই এর পেছনে জড়িত থাকতে পারে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, এতদিনেও কোরআন অবমাননার জন্য কে বা কারা দায়ী, তা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। খুব শিগগিরই তাদের আটক করা হবে। এও বলা হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে যারাই সম্পৃক্ত থাক, তাদের কেউই রেহাই পাবে না। বলা বাহুল্য, মূল ঘটনার রহস্য উদঘাটন ছাড়া পরিস্থিতির প্রকৃতি ও গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সেই কাজটিই এখনো হয়নি। পুলিশ ও গোয়েন্দরা কবে নাগাদ রহস্য উদঘাটন করতে পারবে, সে প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওই ঘটনার সূত্র ধরে দেশে একের পর এক অঘটন ঘটতে দেখা যাচ্ছে। দেশের ভাবমর্যাদাও বহির্বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝপাড়া এলাকায় গত রোববার রাত ১০টার দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের প্রায় ২০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। খবরে বলা হয়েছে, আইনশৃংখলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান ও কঠোর নজরদারির মধ্যেও বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের এক যুবক ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেয়ায় এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত কিছু লোক হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার প্রেক্ষিতে যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে কমবেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে, ঠিক তখনই ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট দেয়া রীতিমত ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। কে ওই পোস্টটি দিলো, তাকে দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ওই ধরনের পোস্ট দেয়া ঘৃণ্য অপরাধ। কিন্তু কেউ ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছে বলে তার সম্প্রদায়ের নিরীহ-নিরপরাধ লোকদের বাড়িঘরে আগুন দিতে হবে, এটা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। যারা এটা করেছে তারা অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূলে আঘাত করেছে। অনেক সময় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ মতলববাজদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যদিও সেটা তারা আগে বুঝতে পারে না। এক্ষেত্রেও তেমন কিছু হয়েছে কিনা সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে। পবিত্র কোরআনের অবমাননা, ধর্মের অবমাননা, মহানবী সা. এর অবমাননা ইত্যাদি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এসবের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো এবং প্রতিকার দাবি করা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। তবে আইন হাতে তুলে নেয়া, কারো ওপর হামলা করা কিংবা নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কাজ করা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো হামলাকারী, অগ্নিসংযোগকারী ও নির্যাতনকারী রেহাই পেতে পারে না। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে।
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে এ পর্যন্ত ১০ জেলায় ২৮টি মামলা হয়েছে। মামলায় আসামী করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে। অন্তত ৩শ জনকে ধরা হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা আশংকা করছেন, এতে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ জুলুম ও হয়রানির শিকার হতে পারে। এটা যাতে না হয়, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃংখলা বিষয়ে মানুষের অসন্তোষ রয়েছে। পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে নিরাপত্তার দুর্বলতা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে আইনশৃংখলা সুরক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে যখন একটা বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তখন সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন প্রশ্নাতীত। অথচ, আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সেদিকে না তাকিয়ে দোষারোপের রাজনীতি শুরু করেছে। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুর্ভাগ্যজনক। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত এক যুগের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশংসা করেছেন। কিন্তু হঠাতই সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত কেন নেমে এলো, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ইতোমধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিবসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ যেসব অভিমত দিয়েছেন তাতে দেশের রাজনীতি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে যে কোনো সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির ফয়দা নেয় প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি। এবারও সে ফায়দা নিতে তারা তৎপর। ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা এবং বিজেপি নিতাদের কথাবার্তায় সেটা স্পষ্ট। কুমিল্লার ঘটনার সঙ্গে ত্রিপুরার আগামী নির্বাচনের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ইতোমধ্যে অনেকে মন্তব্য করেছেন। সেখানে বিজেপির অবস্থা ভালো নয়। এই প্রেক্ষাপটে বিজেপি কুমিল্লার ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে। এই লক্ষ্যেই উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কাজেই, কুমিল্লার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মনে করার কোনো কারণে নেই। উদ্দেশ্যমূলক ও সুপরিকল্পিত এই ঘটনাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। প্রতিকারে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।