বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মহিউদ্দিন খান মোহন
আমাদের ক্যালেন্ডারের পাতায় আরো একটি শোকাবহ তারিখ সংযুক্ত হলো। ১ জুলাই তারিখটি এখন থেকে প্রতি বছর আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে এক পৈশাচিক, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকা-ের কথা; যা সংঘটিত হলো উগ্রবাদী কতিপয় বিপথগামী তরুণদের দ্বারা। জাতির হৃদয়ে সৃষ্ট এ ক্ষতচিহ্ন কোনোদিন মুছে যাবে বলে মনে হয় না। রাজধানীর গুলশানের স্পেনিশ রেস্তোরাঁ ‘হলি আর্টিজানে’ সেদিন রক্তের যে ¯্রােত বয়ে গেল, তা আমাদের সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন হাজির করেছে। যারা এ হত্যাকা- ঘটালো তাদের উদ্দেশ্য কী তা এখনো আমরা জানতে পারিনি। কোন আদর্শিক কারণে ওরা মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজে প্রবৃত্ত হলো, কারা ওদের আদর্শিক নেতা, কোথা থেকে পেল ওরা অস্ত্র, গোলাবারুদ আর অর্থ সহায়তা এসব প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি। হয়তোবা সঠিক তদন্তের পরে এসব প্রশ্নের জবাব বেরিয়ে আসতে পারে।
সেদিন হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তোরাঁয় কী ঘটেছিল তা গণমাধ্যমের কল্যাণে এখন সবাই জানেন। তাছাড়া জিম্মি উদ্ধার অপারেশন নিয়ে যেসব কথা বা বিতর্ক হচ্ছে অর্থাৎ পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে যেসব কথা হচ্ছে তা নিয়েও আলোচনা করতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই, এদেশের মানুষ পুলিশ-র্যাবের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের বহু ‘বন্দুকযুদ্ধের’ কেচ্ছা-কাহিনী শুনেছে। পুলিশ র্যাবের বরাতে শোনা যেসব বন্দুক যুদ্ধে শুধু সন্ত্রাসীরাই নিহত হয়েছে, একজন পুলিশ বা র্যাব সদস্যও মারা যায়নি। আর যেসব স্থানে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছে সেসব এলাকার কেউ কখনোই কোনো গুলির শব্দও শুনতে পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কিন্তু যেদিন জনসমক্ষে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের সত্যিকার বন্দুক যুদ্ধ হলো সেদিন দুঃখজনকভাবে প্রাণ হারালেন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। আর সন্ত্রাসীদের হত্যা করে জিম্মিদের উদ্ধার করলো সেনা কমান্ডোরা মাত্র বারো মিনিটের এক অপারেশনে।
এটা ঠিক যে, ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে অনেক বিতর্ক তোলার অবকাশ আছে। যেমন, গুলশান-বারিধারা-বনানীতে প্রবেশ এবং নির্গমনের পথে ব্যাপক পুলিশী তল্লাশীর পরেও অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ওরা সাতজন কীভাবে সেখানে ঢুকে পড়তে পারলো? সন্ত্রাসীদের রেস্তোরাঁ দখল এবং ভেতরে অবস্থানরত সবাইকে জিম্মি করে রাখার পর পুলিশ অভিযান চালাতে কেন বিলম্ব করল? সেনা কমান্ডোদের যখন আনতেই হলো, তাহলে দশ ঘণ্টা পরে কেন?
হলি আর্টিজানের ঘটনার পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, আমাদের এ মাতৃভূমি কী কোনো অস্থির আবাসভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে? কারা আমাদের এ দেশকে নিয়ে এক ভয়ঙ্কর খেলায় মত্ত হয়ে উঠতে চাচ্ছে? আমরা যখন এটা বুঝতে পারছি যে, আমাদের এ দেশ, আমাদের তরুণ সমাজ তথা আগামী প্রজন্মকে নিয়ে কোনো এক বা একাধিক মহল সর্বনাশা এক খেলায় মেতে উঠতে চাচ্ছে, সে ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা কতোটা প্রস্তুতি নিচ্ছি? কিংবা সে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য কী কৌশল অবলম্বনের চিন্তাভাবনা করছি। রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার, এ ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব আর দায়ের কথা তো না বললেও চলে। ফলে ভয়ঙ্কর ওই ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় তারা কী ভাবছেন সেটাই এ ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় বলে আমি মনে করি।
১ জুলাইয়ের রক্তাক্ত ঘটনার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের সব দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে পেরেছি। তারা নৃশংস ওই ঘটনার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা ‘সন্ত্রাসবাদ’ মোকাবিলায় তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনার নিন্দা জানানো এবং তা অবসানের লক্ষ্যে তাদের বক্তব্যে মিল দেখে দেশবাসী যে আশান্বিত হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। কেননা, দেশবাসী চায় জাতীয় দুর্যোগে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তথা রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে ভয়াবহ পরিণতির হাত থেকে জাতিকে রক্ষায় এগিয়ে আসুক। তাদের এ চাওয়া অযৌক্তিক বা অতি আশা নয়।
গুলশান ট্রাজেডির পর গত ২ জুলাই রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আমরা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ অপরদিকে, পরদিন ৩ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ সংকট থেকে উত্তরণে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য অনেকের মনেই আশার সঞ্চার করেছিল। ৪ জুলাইয়ের কোনো কোনো পত্রিকায় তাদের দুইজনের বক্তব্যে ‘দল নয়, দেশ আগে’ মনোভাব পরিলক্ষিত হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের বিশিষ্টজনেরাও তাদের এ মনোভাবকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর সন্ত্রাসবিরোধী বক্তব্য দেশবাসীকে আশান্বিত করে তুললেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বক্তব্য ও অবস্থান তাদের সে আশার গুঁড়ে বালি ছড়িয়ে দিয়েছে বলা যায়। বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পরপরই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বেগম খালেদা জিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বক্তব্য রাখেন। সংবাদ সম্মেলনে হানিফ বলেন, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন আছে। এটা আমরাও মনে করি। কিন্তু জাতীয় ঐক্য হবে কার সঙ্গে? যিনি জঙ্গি লালন করছেন, জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, সন্ত্রাসী কর্মকা- পৃষ্ঠপোষকতা করছেন তার সঙ্গে? তাহলে তার (খালেদা জিয়া) সঙ্গে কীভাবে জাতীয় ঐক্য সম্ভব? সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশে সব সন্ত্রাসী কর্মকা-ের উৎস হচ্ছেন খালেদা জিয়া এমন অভিযোগ করে হানিফ বলেন ‘খালেদা জিয়া ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে জনগণকে বিপর্যস্ত করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। তার এ ঐক্যের আহ্বান সবার কাছে অবাক করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। (৪ জুলাই ২০১৬-এর পত্রিকা সমূহ)।
মাহবুব-উল আলম হানিফ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। ফলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা যে তার দলেরই বক্তব্য সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর দলীয় সভানেত্রীর অনুমোদন ছাড়া তিনি এসব বলেছেন এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই। সুতরাং এটা ধরে নেয়া যায় যে, জঙ্গি তৎপরতা যে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ জাতীয় কোনো ঐক্য গড়ে তুলতে আগ্রহী নয়। তারা তাদের ‘একলা চলো’ নীতিতেই এখনও অটল রয়েছেন।
এদিকে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে ‘জঙ্গি প্রতিরোধে’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল সারা দেশে কমিটি গঠন করবে। ১২ থেকে ২১ জুলাই দেশের জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কবি, সাহিত্যিক সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার কথা তাদের। গত ৪ জুলাই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডি কার্যালয়ে ১৪ দলের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে ২৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিএনপিকে সঙ্গে রাখা হবে কিনা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি তো এখনো একাত্তরের ঘাতক জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেনি। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একই সুরে কথা বলেছেন।
সুতরাং, এটা ধরে নেয়া যায় যে, সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান সরকার তাতে কর্ণপাত করবে না। তারা তাদের মনমত ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়ে তুলবে, যেখানে শুধু তারা এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী ও সুবিধাভোগী কতিপয় সাইনবোর্ড সবর্স্ব রাজনৈতিক দল ও মোসাহেবরাই স্থান পাবে। এ ধরনের ‘খ-িত জাতীয় ঐক্য’ কতোটা ফলপ্রসূ হবে বা এ ধরনের জাতীয় সঙ্কট থেকে উত্তরণে কতোটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে সবারই ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য গড়তে সরকার আগ্রহী নয়। বিএনপি মহাসচিবের এ বক্তব্য যে অমূলক নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের বক্তব্য থেকে সো ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়- এমন জাতীয় সঙ্কটেও আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্ব উঠতে পারলো না। এটা দেশবাসীর জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কী হতে পারে?
একটি দেশে রাজনৈতিক বিভেদ বিসম্বাদ থাকবেই। দলগুলো যার যার মতাদর্শ নিয়ে কাজ করবে, কথা বলবে। নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। তাদের কথা, কাজ ও চিন্তাভাবনায় ভিন্নতা থাকাটা অস্বাভাবিক কিংবা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এমন কিছু সময় আসে যখন প্রয়োজন দেখা দেয় দেশের সব রাজনৈতিক দলের একত্রিত হওয়ার। যখন মতাদর্শ, কর্মসূচি কিংবা রাজনৈতিক লাইনের ভিন্নতার কথা ভুলে যেতে হয়। জাতীয় কোনো সঙ্কটে যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একতাবদ্ধ হতে না পারে, তাহলে সে দেশের জনগণের মতো দুভার্গা আর কারা আছে?
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জনগণকে তাদের ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। জনগণ তো তাদের ওপর আস্থা রাখতেই চায়। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি কি সে কথা বলে? সরকার যদি সন্ত্রাস বা উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে একাই সক্ষম হতো,তাহলে এতোদিনে তার প্রতিফলন জনগণ দেখতে পেত। কিন্তু তারা যে সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ সেটা কি অস্বীকার করা যাবে? প্রধানমন্ত্রী এদেশ থেকে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের শিকড় উপড়ে ফেলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তার অপর এক বক্তৃতায়। কিন্তু তিনি কি এটা উপলব্ধি করতে পারছেন যে, ওদের শিকড় উপড়াতে হলে, দেশ তথা সমাজের প্রতি মানুষের অংশ গ্রহণ প্রয়োজন সে আন্দোলনে। দেশের প্রায় অর্ধেক জনগগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে যে সন্ত্রাস নির্মূল সম্ভব নয় সেটা তাদের বুঝতে হবে।
উগ্রবাদ বলেন, জঙ্গি বলেন অথবা সন্ত্রাসবাদ যাই বলেন না কেন, এর শিকড় উৎপাটন করতে হলে যেতে হবে অনেক গভীরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা কতিপয় অস্ত্রধারীকে ঘটনাস্থলে মেরে ফেললেই এর শেষ হবে না। যেতে হবে মূলে। কেন সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
এতদিন একটি মহল থেকে অনবরত বলা হতো যে, দেশের মাদরাসাগুলো জঙ্গি পয়দা করছে। কিন্তু গুলশান ট্রাজেডির পর সে কথা অনেকাংশেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, সেনা কমান্ডোদের হাতে নিহত যে পাঁচজন হামলাকারীর পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা সবাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান। এদের মধ্যে একজন আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির এক বড় নেতার সন্তান। সুতরাং, এটা এখন পরিষ্কার যে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন জঙ্গি পয়দা হয়। শুধু তাই নয়, খোদ আওয়ামী লীগের ঘরেই জঙ্গি সৃষ্টি হতে পারে। ফলে এখনও যদি সবাই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসার উপায় উদ্ভাবনে সচেষ্ট না হয়, তাহলে বলতেই হয় সামনে আরো দুর্ভোগ আছে।
হলি আর্টিজানের রক্তাক্ত ঘটনার পর দেশের বিশিষ্টজনেরা প্রায় অভিন্ন সুরে কথা বলেছেন। তারা এ প্রশ্নে রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। তারা এটাও বলেছেন যে, অতীতের মতো ব্লেম গেইম দিয়ে যেনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের দায়িত্ব শেষ না করেন। কারণ জাতি এ সংকট থেকে পরিত্রাণ চায়। এ দেশ এ সমাজকে সন্ত্রাসমুক্ত দেখতে চায়। আর এ ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই তারা সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ও পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে। কিন্তু কিন্ত বিএনপি চেয়ারপার্সনের জাতীয় ঐক্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে সরকারপক্ষ দেশবাসীর মনে জ্বলে ওঠা আশার প্রদীপ এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়েছেন। তাদেরকে ঠেলে দিয়েছেন হতাশার নিঃসীম অন্ধকারের দিকে।
যে কোনো কাজে সফলতার জন্য প্রয়োজন ‘কমিটমেন্ট’ বা ওয়াদা। আর সে কমিটমেন্ট তখনই আসে যখন কাজটি করার দৃঢ় প্রত্যয় হৃদয়ে থাকে। আর ইতিবাচক সে কাজ করতে হলে একা চলার পথ পরিহার করে সবাইকে সঙ্গী করেই এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো-বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আচরণ কথাবার্তা এবং মনোভাবে সে ইতিবাচক ধারার অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত। তারা একাই সব করতে চান। যদিও করতে পারেননি কিছুই। তাদের ভুল নীতি ও পদক্ষেপের কারণে জঙ্গি বা উগ্রবাদ আজ তার শিকড় বেশ খানিকটা প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে। যে কোনো ঘটনার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেই তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেন। প্রকৃত সন্ত্রসীদের চিহ্নিত করার বা ধরার কোনো চেষ্টাই তারা করেননি। গত ৫ জুলাই একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরের পর বছর পালিয়ে থাকা জঙ্গিদের গ্রেফতারে পুলিশের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যথাযথ তদারকির অভাবে জামিনে বেরিয়ে আসা জঙ্গিরা সক্রিয় হয়ে আবারো তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পলাতক জঙ্গিদের ধরে হাজির করার জন্য আদালতের নির্দেশনা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাতে সাড়া দিচ্ছে না। এর নেপথ্য কারণ কারো অজানা থাকার কথা নয়। পুলিশ তো ব্যস্ত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরে জেলখানা ভরে ফেলার কাজে। জঙ্গি ধরতে গিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় তাদের কোথায়!
ক্ষমতাসীন মহল সন্ত্রাস-জঙ্গি প্রতিরোধ কমিটি করবে সারা দেশে, এ কমিটি কতোটা কার্যকর অবদান রাখতে পারবে সে বিষয়ে সবারই কমবেশি সংশয় রয়েছে। কারণ এ কমিটি জাতীয় কমিটি না হয়ে হবে দলীয় কমিটি। আর জাতীয় সঙ্কট থেকে উত্তরণে জাতীয় কমিটিই দরকার, দলীয় নয়। আর দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি কখনো জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে না। বরং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য, দলীয় সংকীর্ণতা থেকে জন্ম নেয়া খ-িত ঐক্য নয়। ক্ষমতাসীন মহল এ সত্যটি যত দ্রুত উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, ততোই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সড়যড়হ৯১@ুধযড়ড়.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।