Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

আফগান সেনাদের এত দ্রুত পরাজয়ের কারণ কী?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৮ এএম

তালেবানের কাছে এত দ্রুত গতিতে আফগানিস্তানের ক্ষমতা চলে যাওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোও বিস্মিত হয়েছে। কারণ, কেউই আশা করেনি যে, আফগান বাহিনী যুদ্ধ করবে না এবং এত দ্রুত হাওয়ায় মিলেয়ে যাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সোমবার জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে তালেবানের ক্ষমতায় আসার বিষয়ে তার বক্তব্য জানিয়েছেন। বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এবং তালেবানের অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ না করার জন্য আফগান নেতৃত্বকেই দায়ী করেন।
বাইডেন বলেন, ‘সত্য হলো, ঘটনা আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে ঘটেছে। তাহলে কী ঘটেছে? আফগানিস্তানের রাজনীতিবিদেরা হাল ছেড়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আফগান সামরিক বাহিনী হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমনকি কখনো কখনো যুদ্ধ করার চেষ্টাও করেনি’। তিনি আরো বলেন, “যে যুদ্ধে আফগান বাহিনী নিজেদের জন্য যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়, সে যুদ্ধে অ্যামেরিকান সৈন্যরা মারা যাচ্ছে। তারা এমন যুদ্ধ করতে পারে না, করা উচিত নয়। যে আফগান সেনাবাহিনী দুই দশক ধরে অ্যামেরিকার প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রে সজ্জিত ছিল, কীভাবে এত দ্রæত তারা তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে? এটা ভেবে এখনো অনেক পর্যবেক্ষক অবাক হচ্ছেন। তালেবানের প্রায় ৮০ হাজারের কাছাকাছি যোদ্ধা রয়েছে, অন্যদিকে আফগান সরকারের সৈন্যসংখ্যা তিন লাখের কাছাকাছি। তবুও জঙ্গি গোষ্ঠীটি মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরো দেশ দখল করে ফেললো। এ পরাজয়ের পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে।
ন্যাটোর বিমান বাহিনীর অনুপস্থিতি : কাবুলভিত্তিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শফিক হামদাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, আফগান নিরাপত্তা বাহিনী আর্থিক ও সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সেসব সমর্থন প্রত্যাহার শুরুর পর তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আতিকুল্লাহ ওমরখাইল বলেন, ‘গত বছর দোহায় মার্কিন-তালেবান চুক্তি এবং এই বছর আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সেনাদের নিঃশর্ত প্রত্যাহার তালেবানের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে’। তিনি আরো বলেন, তালেবান নেতারা জানতেন যে, আফগান সৈন্যরা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সহায়তা না পেলে কাবুলে সরকার উৎখাত করা সম্ভব।
আফগান সৈন্যদের হতাশা : ওয়াশিংটন আফগান সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রে সুসজ্জিত করা বাবদ প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। তালেবান মোকাবিলায় সৈন্যদের অন্তত কাগজে-কলমে হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া উচিত ছিল। বিশ্লেষকরা আফগান সেনাবাহিনীর পতনের পিছনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে মনে করেন- হতাশা এবং দুর্নীতিগ্রস্ততাকে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে ২০২০ সালে কাতারের দোহায় মার্কিন-তালেবান চুক্তি হয়। সেটির পরই আফগানদের কাছে এই বার্তা পৌঁছায় যে, ওয়াশিংটন আর আফগানিস্তানে আগ্রহী নয়। এর ফলে আফগান বাহিনী হতাশ হয়ে পড়ে।
জানুয়ারিতে যখন ট্রাম্পের জায়গায় জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন আফগান কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আরো কিছুটা সময় পাবেন। কিন্তু ২০২১ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাইডেন দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো মিত্ররাও তা অনুসরণ করে। আফগান প্রশাসন এত দ্রæত সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য প্রস্তুত ছিল না তা স্পষ্ট। তালেবান দেশব্যাপী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়নি এবং আন্তঃআফগান আলোচনাও ঝুলে ছিল। ইউএস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স এর-একটি প্রতিবেদন অনুসারে, আফগান সামরিক বাহিনীর ‘সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চৌকিগুলোতে খাদ্য এবং গোলাবারুদের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও সরবরাহ করার ক্ষমতা ছিল না’।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আদতে কোনো লাভ হবে না, এটা বুঝতে পেরেই বেশিরভাগ সৈন্য জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে তালেবানের সঙ্গে বোঝাপড়া, আত্মসমর্পণ করা বা প্রতিরোধ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে’। প্রতিবেদনে আরো যোগ করা হয় যে, ‘কিছু আফগান ইউনিট, বিশেষ করে অভিজাত কমান্ডোরা প্রায় শেষ পর্যন্ত কঠোর লড়াই করেছে’।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান বরাবরই আশরাফ গনির সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে আসছে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের আফগানিস্তান পেপার্স প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, সেনা ও পুলিশ মিলিয়ে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর তিন লাখ ৫২ হাজার সদস্য থাকলেও সাবেক সরকার কেবল দুই লাখ ৫৪ হাজার সদস্যের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছে। পত্রিকাটি জানায়, কমান্ডাররা অর্থ লোপাটের জন্য কেবল ‘ভুয়া সৈনিকই’ তৈরি করেননি, সৈন্যদের বেতন এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ নিয়েও দুর্নীতি করেছেন। যুদ্ধের খরচ পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছে যে ‘জবাবদিহিতা ছাড়া খরচের’ সুযোগই এই ধরনের দুর্নীতিকে উসকে দিয়েছে এবং এটি বন্ধ করার চেষ্টাতেও মনোযোগ ছিল না।
মতাদর্শের অনুপস্থিতি : আফগান সেনাবাহিনীর পতনের আরেকটি কারণ ছিল উদ্দেশ্যহীনতা। অনেকেরই নিজের গোত্র বা অঞ্চলের প্রতি আনুগত্য কাবুলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে বেশি ছিল। অন্যদিকে তালেবান জঙ্গি ইসলামপন্থি আদর্শে ঐক্যবদ্ধ। ২০০১ সালে যখন অ্যামেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করে ক্ষমতা থেকে তালেবানকে উৎখাত করে, তালেবান বলেছিল যে, তারা ইসলামী আদর্শ ছাড়বে না এবং আফগানিস্তান থেকে ‘পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী’ এবং হানাদারদের উৎখাত করতে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পাকিস্তানী গণমাধ্যমের ভাষ্যকার নাদিম ফারুক পরাচা মনে করেন, কাবুলে সরকারের প্রতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আফগান বাহিনীর আনুগত্য ছিল একেবারেই ভঙ্গুর। পরাচা উল্লেখ করেন, ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর দেশটির সাবেক সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ নজিবুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মুজাহিদিনের তিন বছর লেগেছিল, কিন্তু গনির বাহিনী এক মাসও টিকতে পারেনি। সূত্র : ডয়েচে ভেলে।

 



 

Show all comments
  • Md Shahajalal Khan ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১:২২ এএম says : 0
    কারন একটাই অরাও তালেবান কে সমরথন করে আর কিছু না
    Total Reply(0) Reply
  • নজরুল ইসলাম ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১:২২ এএম says : 0
    তারা চাই আফগানিস্তান তালেবান রাষ্ট্রের অধিকারী হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • Sarson Nasir Uddin ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১:২৬ এএম says : 0
    খনিজ সম্পদের লোভে জঙ্গিবাদ আর একনায়কতন্ত্রের দোহাই দিয়ে আমেরিকা আর তার মিত্ররা গোটা মধ্যে প্রাচ্যকে ধ্বংস করেছে ।
    Total Reply(0) Reply
  • Nur Nurani ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১:২৭ এএম says : 0
    আল্লাহ তাদের নেক কাজের সহায় হোক। জনগণের রক্ষক হয়ে যেন ভক্ষক না হন।
    Total Reply(0) Reply
  • Monirul Ekbal ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১:২৮ এএম says : 0
    রাজাকার রা পালাবে,এটাই স্বাভাবিক! ২০ বছর ভিন্ন দেশের হয়ে দালালী করছে, এটার সুযোগ এখন ইউরোপ আমেরিকা গিয়ে পেতে চাই। প্রকৃত জনগণ দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দ করছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Moshiur Rahman ১৯ আগস্ট, ২০২১, ৭:৪২ এএম says : 0
    আল্লাহর এভাবেই সাহায্যে করেন
    Total Reply(0) Reply
  • Mominul+Hoque ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০০ পিএম says : 0
    আফগান সমরিক বাহিনীতে যারা যোগ দিয়েছে, তারা পেটের দায়েই যোগ দিয়েছে। মুলত তারাও ছিলো মুসলমান আফগান জাতি। কোন প্রকৃত মুসলমান ভিন্ন দেশের প্রতি অনুগত হতে পারে না। তাই তালেবানরা অতি সহজেই কাবুল নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না।
    Total Reply(0) Reply
  • jack Ali ১৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ পিএম says : 0
    ও আল্লাহ তুমি আমাদেরকেও সাহায্য করো স্বাধীনতার 50 বছর হয়ে গেল কিন্তু আমরা স্বাধীনতা পাইনি পেয়েছি শুধু সন্ত্রাসী আমাদের দেশটা এখন সন্ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হয়েছে আমাদের জানমালের কোন নিরাপত্তা নাই কোথায় কোথায় হত্যা গুম চাঁদাবাজি লক্ষ হাজার কোটি টাকা লুটপাট মারামারি সেকেন্ডে সেকেন্ডে হয়ে যাচ্ছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগানিস্তান


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ