পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা দুর্যোগের মধ্যে আরেকটি কোরবানির ঈদ চলে গেল। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষ গত দেড় বছরের করোনা লকডাউনে আরো দরিদ্র হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আরো হাজার হাজার পরিবার অতি দরিদ্র শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। লকডাউনের সময় ট্রিপল থিতে ফোন করে লাখ লাখ মানুষ খাদ্য সহায়তা চাইলেও সাহায্য প্রাপ্তির সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম। দিনমজুর-কর্মহীন মানুষ পরিবারের সদস্যদের জন্য দুইবেলা ন্যুনতম ডাল-ভাত জোগাড় করা যেখানে কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে মহামারীকালে প্রয়োজনীয় আমিষ ও সুষম খাদ্যের নিশ্চয়তা তাদের জন্য অলীক কল্পনা হয়ে উঠেছে। এহেন বাস্তবতায় পবিত্র ঈদুল আজহায় কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ অন্তত দু’বেলা গোশত খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, এটাও কম প্রাপ্তি নয়। ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে গোরক্ষা আন্দোলনের নামে এক ধরণের জঙ্গি তৎপরতা চলছে। বিশ্বের শীর্ষ গরুর গোশত রফতানিকারক দেশ ভারতের মুসলমান, খৃস্টানসহ নানা জাতি গোষ্ঠির মানুষ শত শত বছর ধরে গরুর গোশত খাচ্ছে। এতে সেখানকার হিন্দুদের জাত চলে যায়নি, সেখানকার গোসম্পদেও টান পড়েনি। মানুষের প্রয়োজনে যেকোনো বস্তু বা প্রাণীর উপযোগিতার নিরিখে বস্তুর সম্পদমূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। গোমাংশ রফতানি করে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায় বলেই গোসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গরুর সাধারণ আয়ুষ্কাল ১৮ থেকে ২২ বছর। কসাইয়ের হাতে জবাই না হলে এ সময়ের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এসব প্রাণীর মৃত্যু ঘটবে। মরে গেলে মাটিতে পুঁতে ফেলাই হচ্ছে গ্রহণযোগ্য পন্থা। ধর্মীয় কারণে হিন্দুরা গরুর গোশতা খায়না, বৌদ্ধরা কোনো প্রাণী হত্যাকে সমর্থন করেনা। তবে চীন, কোরিয়া, মিয়ানমার বা জাপানে খাদ্যের জন্য প্রাণী হত্যা অন্য কোনো দেশ থেকে কম হয়, এমন কোনো পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। ভারতের হিন্দুদের মধ্যে এমন অসংখ্য মানুষ আছে যারা গরুর গোশত খেতে অভ্যস্থ। কিন্তু ভারতের বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা সে দেশের মুসলমানদের গরুর গোশত খাওয়া থেকে বিরত রাখতে ধর্মান্ধ হিন্দুদের বর্বরতার দিকে উস্কে দিয়েছে। ফ্রিজে গরুর গোশত রাখার মিথ্যা অভিযোগ তুলে মুসলমানদের পিটিয়ে মেরে ফেলার নজিরও তারা দেখিয়েছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, ওরা দেশের গ-ি পেরিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকেও গরুর গোশত খাওয়া থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেছে। প্রথমত বাংলাদেশে গরু রফতানী বন্ধ করে এবং ভারতীয় গো-রক্ষকদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে এ দেশের একশ্রেণীর মানুষ কোরবানির ঈদের সময় গরু, মহিষ জবাই করাকে নিষ্ঠুরতা ও প্রাণীহত্যার মায়াকান্না দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। যদিও তাদের এসব অসার আবেগী প্রচার হালে পানি পায়নি। তবে ঈদুল আযহায় দেশের মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকার কোরবানির সাথে দেশের কোটি কোটি অতি দরিদ্র মানুষের কয়েক বেলা গোশত খাওয়ার সুযোগের পাশাপাশি কোরবানির চামড়া বিক্রির শত শত কোটি টাকায় দেশের হাজার হাজার কওমি মাদরাসা, এতিম খানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকা এতিম, অনাথ ও দুস্থ শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় শিক্ষা ও থাকা-খাওয়ার যোগানের অনেকটাই আসছে। একদিকে বাংলাদেশে ভারতের গরু রফতানি বন্ধ করা, অন্যদিকে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি এক সময়ের অতি মূল্যবান চামড়াকে মূল্যহীন করে ফেলার মধ্য দিয়ে দেশের মাদরাসা শিক্ষা ও প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠির বার্ষিক অনুদান প্রাপ্তির সুযোগকে একেবারে সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় পেসিডেন্ট টমাস জেফারসন ১৮০১ সাল থেকে ১৮০৯ সালের ৪ঠা মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। কন্টিনেন্টাল আর্মির জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ১৭৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেডেন্স ঘোষিত হওয়ার ১৩ বছরের মধ্যে ১৩টি রাজ্যের মিলিশিয়া বাহিনী বৃটিশ ঔপনিবেশিক সামরিক বাহিনীকে পরাভূত করে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আধুনিক মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবক্তা এই মার্কিন মুল্লুক এখন কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে এর অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার আগে থেকেই মার্কিন অর্থনীতি রাষ্ট্রবহির্ভুত ব্যাংকার ও কর্পোরেট শক্তির গ্যাঁড়াকলে পড়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার মাত্র ২৫ বছরের মাথায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট জেফারসন উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেন, অনেক মূল্য দিয়ে অর্জিত আমেরিকা নামক রাষ্ট্রটির ভবিষ্যত খুবই অন্ধকার। বিশেষত দেশের অর্থব্যবস্থার উপর জনগণের কর্তৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় জেফারসন বলেছিলেন, ‘আই সিন্সিয়ারলি বিলিভ দ্যাট ব্যাংকিং এস্টাবলিশমেন্টস আর মোর ডেঞ্জারাস দ্যান স্ট্যান্ডিং আর্মিজ’। প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর চেয়ে অর্থনীতির উপর দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক বলে মনে করেছেন টমাস জেফারসন। জেফারসনের সেই আশঙ্কা ও ভবিষ্যদ্বানি এখন মার্কিন মুল্লুক থেকে পুঁজিতান্ত্রিক মুক্ত বাজার অর্থনীতি পুরো বিশ্বকেই গ্রাস করে নিয়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশের রাজনৈতি-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর একটি পুঁজিতান্ত্রিক কর্পোরেট আমলান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কর্পোরেট স্বার্থের আড়ালে জনগণের স্বার্থ খুবই গৌণ হয়ে পড়েছে। ধনতন্ত্রের কর্পোরেট অনুঘটকরা সবকিছুর উপর নিজেদেরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই গণমাধ্যম, প্রচারযন্ত্র ও বিভ্রান্তিকর প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজের উপর কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এসব প্রচারযন্ত্র যা কিছু প্রচার করছে তার সবই কর্পোরেট অর্থনৈতিক স্বার্থের অনুকূল। আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক আগ্রাসন ও তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের পেছনে মার্কিন জনগণের কোনো স্বার্থ ছিল না। মার্কিন সামরিক শক্তি ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য। গত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে এ অঞ্চলকে আরো অনিরাপদ ও অস্থিতিশীল করে তোলা হলেও মার্কিন জনগণের কোনো লাভ হয়নি। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে মার্কিন সৈন্যরা শূন্যহাতে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই টাকা দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার শতকোটি মানুষের শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব ছিল। শত বছরে প্রমানিত হয়েছে, কোনো দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিধ্বংসী মারনাস্ত্র পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের মাথাব্যথার কারণ নয়। সত্যিকারের স্বাধীনতা, স্বাধীন অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার যেকোনো দূরবর্তী সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করাই কর্পোরেট পুঁজিতন্ত্রের মূলনীতি।
শাসনতান্ত্রিক আইনী কাঠামো ও কর ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই কর্পোরেট পুঁজিবাদের মূল লক্ষ্য। জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ বা দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিনত করা তাদের লক্ষ্য নয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে সম্পদের উপর জনগণের ভোগের সুযোগ কিছুটা অবারিত থাকলেও ননওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলোতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর জনগণের অধিকার খর্ব করতে সম্ভাব্য সবকিছু করতে নেপথ্য ভূমিকা রাখছে কর্পোরেট পুঁজিবাদের পোষা আমলাতন্ত্র। আজকের বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহ, আঞ্চলিক বৈরিতা, একচেটিয়া বাণিজ্য, মহামারী-বিশ্বমন্দা ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে এইসব কর্পোরেট পুঁজিবাদের ধামাধরা রাজনীতিবিদ ও আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা বিদেশি স্বার্থের এজেন্টরাই দায়ী। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, গণতন্ত্র, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক সম্ভাবনাসহ সব কিছুই তাদের হাতে অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে জনগণের সম্পদের উপর জনগণের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ যেন ততই দূরুহ হয়ে পড়ছে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট জায়ান্টদের আধিপত্য কায়েম হওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা কর্পোরেট বাণিজ্যিক স্বার্থের হাতিয়ারে পরিনত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি যখন বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন দেশের ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা কখনো কখনো বিদেশি ক্রেতা ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রকদের ক্রীড়নকে পরিনত হতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে পরাশক্তিসমুহের আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি, কৌশলগত অবস্থান ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বৈশ্বিক করোনা মহামারীর আগে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনকেই বিশ্বের সব মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। করোনাভাইরাস অতিমারীর কারণে সেই চ্যালেঞ্জ বাতিল হয়ে যায়নি। ক্লাইমেট চেঞ্জের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ফসিল জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস, গ্রিন এনার্জি কনজাম্পশন বৃদ্ধি, পেট্টোলিয়ামজাত কৃত্রিম-সিনথেটিক তন্তুর বদলে পাট, তুলা, চামড়ার মত প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের প্রতি মানুষের সচেতনতা, আগ্রহ ও কদর বেড়ে চলেছে। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, এটাই অর্থনীতির সাধারণ প্রবণতা। এ হিসেবে বাংলাদেশের পাটশিল্পের সোনালী যুগ ফিরে আসার প্রত্যাশা জেগেছিল। কিন্তু যেসব পাটকলের উৎপাদনের উপর দাঁড়িয়ে এক সময় পাটশিল্প দেশের প্রধান রফতানি আয়ের খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, পাটখাতের বিদ্যমান সমস্যার নিরিখে সংস্কার, আধুনিকায়ন ও অস্বচ্ছতা দূর করার লোকসানের অজুহাতে সেসব পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়ে ভারতের পাটখাতকে চাঙ্গা করে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। যুগ যুগ ধুরে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর পাট উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাংলাদেশের পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার পর বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট ভারতে রফতানির মাধ্যমে মূলত ভারতীয় পাটকলগুলোর কাঁচামাল সরবরাহ করছে বাংলাদেশ। এখন ভারত বিশ্বের এক নম্বর পাট রফতানিকারক দেশ, দ্বিতীয় অবস্থান বাংলাদেশের। ভারতে চাহিদা অনুসারে পাট উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের পাটের উপর মোটা অংকের এন্টি-ডাম্পিং ট্যাক্স বসিয়ে দেয় ভারত। যেকোনো পণ্যের ভারত নির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, গত কয়েক বছরে তা বার বার প্রমানিত হয়েছে। চাল ও পেঁয়াজের পর এবার করোনাকালে অক্সিজেন এবং ভ্যাক্সিন চুক্তি করে অর্থ গ্রহণের পর বাংলাদেশে টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত সরকার।
নিউটনের সূত্র অনুসারে, প্রতিটা ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া থাকে। বাংলাদেশে ভারতের গরু রফতানি বন্ধ হলে এ দেশের মানুষের গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটাই ভেবেছিলেন ভারতের বিজেপি নেতারা। তারা ভুল প্রমানিত হয়েছেন। বাংলাদেশের কৃষক ও খামারিরা অল্পদিনের মধ্যেই দেশকে গোসম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। গত ৫ বছর ধরে ভারতীয় গুরু ছাড়াই দেশীয় গরুতে সারা বছরের গোশতের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি কোরবানীর ঈদে অতিরিক্ত অর্ধকোটির বেশি গরু-মহিষের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকছে। এ থেকে প্রমান হয়, ভারতের উপর নির্ভরশীল প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। দেশের নীতি নির্ধারণ ও আমলাতন্ত্রে লুকিয়ে থাকা বিদেশি ও কর্পোরেট স্বার্থের এজেন্টরাই এসব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। ধানের বাম্পার উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা কৃষকদের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিতে ওরা ধানের ভরা মওসুমে একশ্রেণীর আমদানিকারককে ভারত থেকে নি¤œমানের চাল আমদানির সুযোগ দিয়ে কৃষককে উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে। অথচ দেশের দরিদ্র মানুষকে সারাবছর উচ্চমূল্যে চাল কিনতে হয়। একইভাবে দেশে গোসম্পদ বা লাইভস্টকের বিপুল উন্নয়ন ঘটলেও বাজারে গরুর গোশতের মূল্য এখনো গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই রয়ে গেছে। লাইভস্টকে দেশ ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন সত্ত্বেও গরুর গোশতের বাড়তি মূল্যের জন্য গরু-মহিষের খাদ্যের ঊর্ধ্বমূল্য, পরিবহন খাতে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, হাট-ইজারাদারদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফাবাজি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে দায়ী করছেন দেশের গোশত ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এ খাতে বিপরীত চিত্রটি খুবই বিস্ময়কর। গত এক দশকে গরু-মহিষের উৎপাদন বেড়েছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চাহিদা বেড়েছে, গরু-মহিষের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে গোশতের দামও বেড়েছে। গরু-মহিষের চামড়ার উৎপাদন এবং রফতানি লক্ষ্যমাত্রার নিরিখে চাহিদা বাড়লেও কাঁচা চামড়ার দাম বাড়েনি। এটুকু বললে খুব কম বলা হয়, সত্য আড়াল করা হয়। গত এক দশকে কাঁচা চামড়ার মূল্য দশভাগের একভাগে নেমে এসেছে। একদশক আগেও এক লাখ টাকা দামের গরুর চামড়ার গড় মূল্য ছিল ৩ হাজার টাকা। এখন তা ৩০০ টাকায় নেমে এসেছে। অথচ এ সময়ে চামড়াজাত পণ্যের মূল্য বেড়েছে, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও উৎপাদন ও রফতানি বেড়েছে। চামড়াশিল্প এখন বিলিয়ন ডলার আয় করা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও সম্ভাবনাময় রফতানিখাত। গার্মেন্টস সেক্টর দেশের এক নম্বর রফতানিমুখী খাত হলেও তুলা, সুতা, ডাইং, এক্সেসরিজসহ এ খাতের কাঁচামাল ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাতের বড় অংশ এখনো আমদানি নির্ভর। কিন্তু পাট বা চামড়া শিল্পের প্রায় পুরোটাই নিজস্ব কাঁচামাল ও উৎপাদন ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সম্ভবত এ কারণেই এ’দুটি খাতের উপর দেশবিরোধী শক্তির এজেন্টদের শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে।
আমাদের রাজধানী ঢাকা নগরী এক সময় পরিবেশবান্ধব সবুজ শহর হিসেবে সুখ্যাত ছিল। এখন তা বিশ্বের অন্যতম নোংরা, বসবাসের অযোগ্য শহরের আন্তর্জাতিক তালিকায় স্থান পাচ্ছে। ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয়, সামান্য বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা, বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোর পানি বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ার পেছনে হাজারিবাগের টেনারিশিল্পের রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলাকে দায়ি করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। দুই দশক আগেই হাজারিবাগ থেকে টেনারিশিল্প সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে সিইটিপি সংযুক্ত সুপরিকল্পিত ও আধুনিক চামড়াশিল্প নগরীতে পুর্নবাসনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পে সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করেও এখনো চামড়াশিল্প নগরীকে পরিকল্পনা অনুসারে যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। রাজধানী শহর এবং চারপাশের নদীগুলোকে দুষণমুক্ত করার পাশাপাশি রফতানিমুখী চামড়াশিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করার এই পরিকল্পনাটি দুই দশকেও বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনেও দেশের আমলাতন্ত্রের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা বিদেশি স্বার্থের এজেন্টদের হাত থাকতে পারে। আমাদের চামড়াশিল্পের বিশেষত্ব এই যে, এর বেশিরভাগ কাঁচামাল সংগ্রহ হয় ঈদুল আজহায় লাখ লাখ মানুষের দেয়া কোরবানির পশুর চামড়া থেকে। সেই পশু ক্রয়ের টাকা দেশের হাজার হাজার খামারির অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা, কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের গোশত খাওয়া, চামড়া বেচা টাকায় গ্রামীন অতিদরিদ্রদের মধ্যে বন্টিত হওয়া, হাজার হাজার মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে লাখ লাখ দুস্থ, ছিন্নমূল শিশু-কিশোরের লেখাপড়ার সুযোগ এই চামড়ার মূল্যের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। চামড়ার মূল্য বাড়লে দেশের গ্রামীন অতি দরিদ্র এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হয়। এর মাধ্যমে একটি সামাজিক নিরাপত্তাচক্র গড়ে উঠে। দারিদ্র্য বিমোচন ও সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে সরকারের যে সাংবিধানিক দায়িত্ব রয়েছে, সে দায়িত্বের কিছুটা পূরণ হচ্ছে, লাখ লাখ কোরবানির পশুর চামড়া এবং স্বচ্ছল মানুষের জাকাত-ফেতরা ও দান-সদকার টাকায়। বর্তমানে দেশের চামড়া শিল্পে ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি পটেনশিয়াল রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। গত ১০ বছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আয় বেড়েছে, দেশে এবং বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের মূল্য এবং চাহিদা বাড়লেও কাঁচা চামড়ার মূল্য বাড়ার বদলে দশ ভাগের একভাগে নেমে এলো কেন? দেশের বাজারে যেখানে একটি চামড়ার মানিব্যাগ বা বেল্টের মূল্য ৫০০ থেকে হাজার টাকা, সেখানে দেড় লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম ৩০০-৪০০ টাকা হয় কি করে! একেকটি চামড়ার মূল্য যখন ৪-৫ হাজার টাকা ছিল তখনো রফতানিকারক ও উৎপাদকরা মুনাফা করেছে, এখন আরো বেশি করছে। মনে হচ্ছে, কোনো একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে কাঁচা চামড়ার মূল্যে ধস নামিয়ে দেশের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে চাচ্ছে। এর ফলে শুধু মাদরাসাশিক্ষা ও এতিম দুস্থতারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, গ্রামীণ অতি দরিদ্র লাখ লাখ পরিবার সামাজিকভাবে বার্ষিক অর্থসহায়তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের আরো কোনো রফতানিমুখী সেক্টরের সাথে তৃণমূল পর্যায়ের এমন সামাজিক-অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সংশ্লিষ্টতা নেই। রাষ্ট্রের বৃহত্তম স্বার্থেই কাঁচা চামড়ার মূল্য নিয়ে সিন্ডিকেটেড চক্রান্ত ও অস্বচ্ছতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমন্বয় ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।