বিভিন্ন ধর্মে কোরবানি
পবিত্র ঈদুল আজহা। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন নামে
৬২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (স.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। অনেক নবী-রাসূলই আল্লাহর আদেশে হিজরত করেছেন। আর হিজরতের সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল সুসংবাদ ও বিজয়। নবীজির হিজরতের পর অতি অল্প সময়ে সহজেই মক্কাসহ গোটা আরবের বিজয় নিশ্চিত হয়। তাঁর তিরোধানের পর বিজয়ের এ ধারাবাহিকতা ছিল অব্যাহত। চার খলিফার যুগ শেষ হওয়ার পর উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের (র.) নেতৃত্বে এ বিজয় দুর্বার গতিতে বিস্তৃত হতে থাকে। ৬৯৮ সালে মুসলিম সেনাদের রণনিপুণতায় উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকা মুসলিম সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় আফ্রিকা ছিল অন্ধকারের মহাদেশ হিসেবে পরিচিত। দুর্গম পাহাড়-পর্বত, জন্তু-জানোয়ার আর জঙ্গলের দেশ বলা হতো আফ্রিকাকে। এই জঙ্গলের দেশে মুসলিমগণ জ্ঞানের আলো জ্বালালেন। সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হলো তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মৌরতানিয়া ও মরক্কো। উত্তর আফ্রিকার দুর্র্ধর্ষ, অদম্য ও যুদ্ধে অজেয় ‘বারবার’ জাতি ইসলামের সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হলো। তারা মুসলিমনেতাদের চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো। সত্যের এ আলোর ঝলক ছড়িয়ে পড়লো পার্শ্ববর্তী স্পেনে। এ সময়ে স্পেনের রাজা ছিলেন রডারিক। তিনি ছিলেন গোঁড়া খ্রিস্টান। ছিলেন স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। তার নির্যাতনে মানবতা হয়ে উঠেছিল নিষ্পেষিত। এসময় চার্চের ক্ষমতা ছিল রাজাদের চেয়ে অনেক বেশি। রাজারা ছিলেন পুরোহিতদের হাতের পুতুল। রাজা ও পুরোহিত-এই দুই শ্রেণির মানুষই ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ, সীমাহীন বিলাসী ও চরিত্রহীন। রাজাদের রাজপ্রাসাদ আর পুরোহিতদের মঠ ও গির্জাগুলো পরিপূর্ণ থাকতো সুন্দরী যুবতী নারী দিয়ে। তাদের শোষণে শোষিত জনগণের আর্তনাদে ভারী হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। কিন্তু তাদের এই আর্তনাদ আর চিৎকার দেয়ালের বাইরে আসতো না। মুসলিম গভর্নর যেন তাদের এ কান্নার আওয়াজ দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলেন। মরক্কোর অদূরে ছিলো স্পেন শাসিত সিউটা দুর্গ। এ দুর্গের গভর্নর ছিলেন কাউন্ট জুলিয়ান। তিনি একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে হাজির হলেন মুসা বিন নুসাইরের দরবারে। তিনি মুসা বিন নুসাইরকে স্পেনের রাজা ও পুরোহিতদের অপকর্মের সব কথা জানিয়ে দিলেন। আর মজলুম মানবতাকে উদ্ধারে স্পেনে আক্রমণ করতে আবেদন করলেন। মুসা তার তলোয়ার কোষমুক্ত করলেন। তিনি বয়সে তরুণ তারেক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ৩০ এপ্রিল ৭১১ সাল। মুসলিমগণ অভিযানের নিমিত্তে জাহাজে আরোহণ করলেন। স্বল্প রসদ আর অল্প সৈন্য নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। ইউরোপের মাটিতে মুসলিম বাহিনীর প্রথম পদক্ষেপ। এ এক নতুন অনুভূতি। সৈন্যদের নিয়ে তিনি একটা পাহাড়ের কাছে অবতরণ করলেন, যা পরবর্তীতে ‘জাবালুত তারেক’ বা তারেকের পাহাড় নামে পরিচিতি পায়। স্পেনে পৌঁছে তারেক জাহাজগুলো পুড়িয়ে দিলেন। মুসলিমবাহিনীর সামনে এখন বিজয় কিংবা মৃত্যু ছাড়া কিছুই রইলো না। এমতাবস্থায় তারেক সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দিলেন। যে ভাষণটি পৃথিবীতে হয়ে আছে স্মরণীয়। ভাষণটির মর্মার্থ ছিলো এমন: ‘হে সাহসী যুবক ভাইয়েরা! হে আমার যোদ্ধাগণ! তোমরা পালাবে কোথায়? এখন পিছু হটবার কোনো সুযোগ নেই। তোমাদের সামনে শত্রু আর পিছনে সমুদ্র। না পারবে পিছনে পালাতে আর না সামনে। এখন তোমাদের সামনে বিজয় অথবা শাহাদাত ছাড়া তৃতীয় কোনো পথ নেই। আর জেনে রেখো, আমরা এসেছি এদেশকে স্বদেশভূমিতে পরিণত করতে। আমরা তো সেই আল্লাহর বান্দা, যিনি বদর, হুনায়ন, কাদিসিয়া, আজনাদাইনের রণক্ষেত্রে বিপদের সময় সাহায্য করেছিলেন। আমরা যুদ্ধ করি সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে; পার্থিব ধন-দৌলত লাভের জন্য নয়। আমরা তো অদ্বিতীয় আল্লাহতে বিশ্বাসী। তিনি অবিশ্বাসীদের দেশে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সাহায্য করেছেন। আর কুতাইবাকে সাহায্য করেছেন সুদূর তুর্কিস্তানে। আমরা সেই কুতাইবা ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের একই উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধ করি। সুতরাং, আমাদের উদ্দেশ্য যদি ঠিক থাকে আমরাও পাব জয়মাল্য। এসো আমরা সত্যের পথে হই গাজী অথবা শহীদ।’ জ্বালাময়ী এই ভাষণে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হৃদয়ে যেন আগুন প্রজ্জ্বলিত হলো। তাঁরা শপথ নিলেন জয়ের অথবা শহীদের। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো স্পেনের আকাশ বাতাস। অতঃপর সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বেজে উঠলো রণশিঙ্গা। সাত হাজার সৈন্যের ছোটো বাহিনী এগিয়ে চললো সম্মুখপানে। তাদের চোখে মুখে ছিল দৃপ্ত শপথ। কিন্তু চলনে বলনে ছিলো না কোনো অহংকার এবং ঔদ্ধত্য। বিনয়াবনত ছিল তাদের চিত্ত বিচরণ। উদ্দেশ্য ছিলো মানবিক ও মহৎ। তারেকের বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছিল স্বগতিতে। তারেক পথিমধ্যে কয়েকবার বাধার সম্মুখীন হলেন। বাধা অতিক্রম করে তিনি সরাসরি রাজা রডারিকের মুখোমুখী হলেন। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মুসলিম সেনাবাহিনী।
ওদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে সমহিমায় হাজির রডারিকবাহিনী। ইস্পাতের বর্মদ্বারা আচ্ছাদিত তার ত্রিশ হাজার সৈন্য। শুরু হলো ইউরোপের মাটিতে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম বড় যুদ্ধ। দুই লাখ খ্রিস্টানবাহিনীর সাথে ক্ষুদ্র মুসলিমবাহিনীর অসম যুদ্ধ চললো সাতদিন ধরে। যুদ্ধ গড়ালো অষ্টম দিনে। সুশৃংঙ্খল মুসলিম বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেলেন রডারিকের সৈন্যরা। তৃণের মতো উড়ে গেলো খ্রিস্টানবাহিনী। তারেকের সম্মুখ হামলায় রাজা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। পালাতে শুরু করলো তার সৈন্যরা। নদীতেই সলিল সমাধি ঘটলো অনেকের। রাজা রডারিকও পানিতে ডুবে মারা গেলেন। হাজার হাজার খ্রিস্টান সৈন্যের লাশ পড়ে থাকলো মাটিতে। ৭১২ সালে মুসলমানদের করতলগত হলো স্পেনের সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর।
৭১১ থেকে ১৪৯২ সাল। সুদীর্ঘ ৭৮২ বছর। মুসলিমরা স্পেনকে পরিণত করলো সমগ্র ইউরোপের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে। ৭০০ মসজিদ, ৮০০ শিক্ষাকেন্দ্র, ৭০টি সুবিশাল লাইব্রেরি ও কর্ডোভাতে গড়ে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয়। নির্মিত হলো ৯০০ পাবলিক গোসলখানা ও ৬০০০০ প্রাসাদ। সংস্কার ও নির্মাণ করা হলো অসংখ্য রাস্তাঘাট। প্রভূত উন্নতি সাধিত হলো এখানে জ্ঞানগবেষণার বিভিন্ন শাখার। গণিত, ত্রিকোণমিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শল্যচিকিৎসা, কৃষি, ব্যবসা ও ওষুধ তৈরিসহ বিভিন্ন গবেষণাকর্মের ব্যাপক উন্নতি ঘটলো। এখানেই জন্ম নেন ইবনে রুশদ, ইবনে ফিরনাস, ইবনে তোফায়েলসহ অসংখ্য মুসলিম বিজ্ঞানী। ফলে বিশ্ববাসীর কাছে স্পেন হলো বিস্ময়কর ও দৃষ্টিনন্দন এক দেশ। গোটা ইউরোপে স্পেন পরিচিত হলো একটি তীর্থস্থান হিসেবে। কিন্তু স্পেনের এ মুসলিম উন্নয়ন বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টশক্তি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। পরাজিত ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা জেগে উঠলো তাই ক্রুসেডীয় চেতনায়। জাগিয়ে তুললো তারা খ্রিস্টান রাজা ও পুরোহিতদের। সমগ্র ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ হলো তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে। আর এ ঐক্যের নাম দেয়া হলো ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। এ মুহূর্তে মুসলিমদের মাঝে থাকা দরকার ছিল ঐক্য। প্রয়োজন ছিল সুশৃংখল বন্ধনের। কিন্তু তখনই তারা হলো বিভিন্ন তরিকায় বিভক্ত। সুতরাং, যা হবার তাই হলো। ক্রুসেডের ধ্বংসযজ্ঞে স্পেনের সকল শহর পদানত হলো খ্রিস্টানদের হাতে। বাকি থাকলো শুধু গ্রানাডা। নিঃসঙ্গ গ্রানাডার ঔজ্জ্বল্যও ম্লান হতে শুরু করলো। গ্রানাডার শাসক তখন আবুল হাসান (১৪৬৫-১৪৮২)। হাসানের পুত্র আবু আব্দুল্লাহ পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হলেন। বাদশা হাসান ১৪৮৫ সালে তার ভাই আল জাগালের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আবু আব্দুল্লাহ চাচা জাগালের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্বের সুযোগে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা গ্রানাডার বিভিন্ন এলাকা দখল করতে থাকলেন। এমনি এক দখলদারী যুদ্ধে আল-জাগাল ১৪৮৭ সালে আত্মসমর্পণে বাধ্য হলেন। অতঃপর বাদশা আল জাগাল গ্রানাডা ত্যাগ করলেন। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন: ‘বাদশা আল জাগাল ছিলেন গ্রানাডার সর্বশেষ শাসক। ছিলেন সাহসী যোদ্ধা, যথার্থ শাসক ও খ্রিস্টশক্তির বিরুদ্ধে অটল প্রতিদ্বন্দ্বী। চাচা আর ভাতিজা যদি দ্বন্দ্বে না জড়াতেন তাহলে গ্রানাডা তাবৎ কাল ধরে জাগালের হাতেই থাকতো।’ (The Moors in Spain, Page- 248)
এবার শুরু হয় ভাতিজা আবু আব্দুল্লাহ-এর উপাখ্যান। ১৪৯০ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবিলা আবু আব্দুল্লাহকে গ্রানাডা ছেড়ে দিতে আদেশ করে। আবু আব্দুল্লাহ তা অস্বীকার করেন। ক্ষেপে যান ফার্দিনান্দ। তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। ৪০ হাজার পদাতিক আর ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে গ্রানাডা অভিমুখে রওনা দেন। আবু আব্দুল্লাহ প্রতিরোধ করার প্রবল প্রচেষ্টা চালান। আরব ও আরবের বাইরে আন্তঃকলহে নিমজ্জিত মুসলিমদের কেউই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। সর্বশেষ মুসলিম শাসক আব্দুল্লাহ অবশেষে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন ২৪ নভেম্বর ১৪৯১। মুসলিমশূন্য হয়ে যায় ঐতিহাসিক গ্রানাডা। এরই মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের চির অবসান হয় স্পেনে। অর্ধচন্দ্রের জায়গায় মিনারগুলোতে শোভা পেতে থাকে ক্রুশ। নির্যাতনের ভয়ে অনেক মুসলিম খ্রিস্টান হয়ে যায়। খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া মুসলিমদের নাম দেয়া হয় মরিসকো। এরপরও মরিসকোদের রক্ষা হয়নি। ৪,৬৭,৫০০ জন মরিসকোকে স্পেন ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এদের সকলকে সমুদ্রপথে নির্বাসিত করা হয়। এদের সকলেই সমুদ্রের অতল তলদেশে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। এরপরও যারা অবশিষ্ট ছিলো তাদেরকে মসজিদে আশ্রয় নিতে বলা হয়। কিন্তু হায়! এদের অবস্থা ছিলো আরো করুণ! মসজিদগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। দিনটি ছিল ১ এপ্রিল। মুসলিম নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু নিষ্ঠুর ফার্নান্দেজ বাহিনীর অট্টহাসির সাথে মুসলিমদের আহাজারি বিলীন হয়ে যায়। মসজিদেই মৃত্যুবরণ করেন হাজার হাজার নিরীহ অসহায় মুসলিম শিশু, নারী ও পুরুষ। এভাবেই মুসলিম আন্দালুসিয়া পরিণত হয় খ্রিস্টান স্পেনে। চিরতরের জন্য মুসলিম জাতি সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হয় স্পেন থেকে। এটাই মুসলিম ইতিহাসে গ্রানাডা ট্রাজেডি হিসেবে পরিচিত। পরিশেষে বলতে হয়, স্পেনে মুসলিমদের প্রবেশ ছিলো অন্ধকার কক্ষের দরজা দিয়ে সূর্যের আলোর প্রবেশের মতো। আর এ আলোর প্রবেশ ছিলো রোমাঞ্চকর ও ঈমান-উদ্দীপক এক উপাখ্যান। আর এ উপাখ্যানের যবানিকাতে ছিলো দুঃখ, বেদনা, অনুশোচনা আর আফসোস!
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয, কুষ্টিয়া
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।