বিভিন্ন ধর্মে কোরবানি
পবিত্র ঈদুল আজহা। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন নামে
বিশ্ব মুসলিমের নিকট অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও মহাআনন্দের উৎসব হিসাবে প্রতিবছর সাড়ম্বরে পালিত হয় ঈদুল আজহা। ঈদ অর্থ খুশি। এ শব্দটি শুনলেই মনে হয় চারপাশে শুধু খুশি আর হাসি, শুধু আনন্দ আর উল্লাস। কিন্তু শুধু খুশিতে মেতে ওঠা আর উল্লসিত হওয়াই ঈদের প্রকৃত সার্থকতা নয়। বছর শেষে ঈদ আসে শুধু ভালো ভালো খাবার খাওয়া, দামি দামি কাপড় পরিধান করা আর বিত্তশালী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বল্গাহীন আনন্দ-উল্লাস আর যা খুশি তাই করে বেড়ানোর নাম ঈদ নয়। ঈদ আসে ধনি-গরিব, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো সবার মধ্যে আনন্দ-ভালোবাসা বিলানোর জন্য। নিজের খাবার থেকে ক্ষুধার্তকে ভাগ দেওয়ার জন্য। পথের ভুখা-নাঙ্গা ফকির ইয়াতিম মিসকিনকে ঘরে ডেকে এনে আদর আপ্যায়ন করানোর জন্য। ঈদ উৎসব শুধু বিত্তবানদের জন্য নয়, তা সর্বান্তকরণে অনুধাবন করে ঈদের আনন্দ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ভাগাভাগি করে দেওয়ার জন্যই ঈদ।
মহাকবি কায়কোবাদ (কাজেম আল কুরাইশি কায়কোবাদ) তাঁর ‘অশ্রুমালা’ কাব্যগ্রন্থে ‘ঈদ আবাহন’ কবিতায় ঈদ উপলক্ষে কামনা করেছেন জাগৃতি:
‘আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মনঃপ্রাণ
জাগায়ে মোশ্লেমে সবে গাহ আজি মিলনের গান।
ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিষ্মান রবি
জীবন সার্থক হবে, ধন্য হবে এ দরিদ্র কবি।’
ঈদ বছরে দু’বার আসে। শাওয়াল মাসে আসে ঈদুল ফিতর, আর যিলহজ্জ মাসে আসে ঈদুল আয্হা বা কোরবানির ঈদ। ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ্ পরম ত্যাগের নিদর্শনস্বরূপ জিলহজ্জ মাসের ঐতিহাসিক ১০ তারিখ মহাসমারোহে পশু জবেহের মাধ্যমে কোরবানির যে আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকেÑ তা-ই ঈদুল আজহা। বস্তুতঃ হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ্ তা’য়ালার নির্দেশ পালন করতে প্রাণপ্রিয় একমাত্র পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করার মতো যে ঐতিহাসিক নযির স্থাপন করে গেছেন, সে সুন্নাত পালনার্থে মুসলিম জাতি আজো কোরবানি করে থাকে।
ঈদুল আয্হার দিন মুসলিম মিল্লাতের কতিপয় কাজ করা সুন্নাত। আর তা হলো,- (১) খুব প্রত্যুষে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (২) উত্তমরূপে মিস্ওয়াক করা। (৩) সকাল সকাল উত্তমরূপে গোসল সম্পন্ন করা। (৪) সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করা ও চোখে সুরমা লাগানো। (৫) সাধ্যমতো নতুন, পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা। (৬) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রত্যুষে ঈদগাহে গমন করা। (৭) সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম খাবারের বন্দোবস্ত করা ও আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি, ইয়াতিম-মিস্কিন, গরিব-দুঃখিকে পানাহার করানো। (৮) ঈদগাহে গমন করার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা। (৯) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই সাদ্কায়ে ফিতর আদায় করা। (১০) ঈদগাহে এক পথ দিয়ে গমন করা এবং নামায শেষে অন্য পথে ফিরে আসা। (১১) যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। (১২) ঈদের নামায মসজিদে আদায় না করে ঈদগাহে আদায় করা উত্তম। (১৩) ঈদগাহে যাবার পথে তাক্বিরে তাশ্রিক- আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ (মহান আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহ্রই জন্য সকল প্রশংসা) উচ্চ স্বরে পাঠ করতে করতে যাওয়া। (১৪) দুপুর পর্যন্ত অন্য কোন খাবার গ্রহণ না করে কোরবানির গোশ্ত দিয়ে আহার করা মুস্তাহাব। (১৫) ঈদের নামায সকাল সকাল আদায় করে যথাসম্ভব প্রথম প্রহরেই কোরবানি করা উচিত। (১৬) ঈদুল আয্হার পূর্বে ৯ জিলহজ্জ হতে ঈদের পর ১৩ জিলহজ্জ পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামায আদায়ের পর উচ্চস্বরে উপরিউক্ত তাক্বিরে তাশ্রিক পাঠ করা। (১৭) ঈদুল আয্হার খুৎবায় কোরবানির বিভিন্ন মাস’আলা সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।
ঈদুল আয্হার সালাত শেষে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কোরবানি করা ওয়াজিব। সর্বোত্তম পন্থা হলো কোরবানির গোশ্ত নিজে খাওয়া, নিজের পরিবারবর্গকে খাওয়ানো, আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া দেওয়া এবং গরিব-মিসকিনকে সাদ্কা দেওয়া। গোশ্ত বিতরণের মুস্তাহাব তরিকা হলো সমস্ত গোশ্ত তিনভাগ করে একভাগ নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজনের মাঝে এবং আরেক ভাগ গরিব-মিস্কিনদের মাঝে বিতরণ করা। এভাবে ঈদের খুশিতে সবাইকে শরিক করতে পারলে নিঃসন্দেহে আমাদের সমাজে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হবে। ঈদের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭ সংখ্যায় তার ‘ঈদ’ কবিতায় লিখেছেন,Ñ
‘মুসলেমের আজ ঈদ শুভময়
আজ মিলনের দিন
গলায় গলায় মাখামাখি
আমির ফকির হীন।
আজ সবারি হস্ত পূত
ধোওয়া স্বরগ নীরে
তাই তো চুমোর ভিড় লেগেছে
নম্র নত শিরে।’
ঈদুল আজহার নামাযের পূর্বে কোরবানি করা দুরস্ত নয়। নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতে জবেহ্ করা মুস্তাহাব। যদি নিজে জবেহ্ করতে না পারে তবে অন্যের দ্বারা যবেহ্ করালে দোষের কিছু নাই। এমতাবস্থায় কোরবানি দাতা নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম। জবেহ্ করার সময় কোরবানির পশু কিবলামুখি করে শোয়ানো জরুরি। ইচ্ছাকৃত বিস্মিল্লাহ্ পরিত্যাগ করলে জবেহ্কৃত পশু হারাম বলে গণ্য হবে। আর যদি ভুলক্রমে বিস্মিল্লাহ্ ছেড়ে দেয় তাহলে তা খাওয়া জায়িজ আছে (হিদায়া, খণ্ড ৪, পৃ. ৪৩৫)। কোরবানির সময় মুখে নিয়্যত করা জরুরি নয়। অবশ্য মনে মনে নিয়্যত করতে হবে যে, আমি শুধুমাত্র আল্লাহ্ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার উদ্দেশ্যে কোরবানি করছি। তবে মুখে দু’আ পড়া উত্তম। আর যবেহ্ করার পূর্বে ছুরি ভালভাবে ধার দিয়ে নেওয়া তথা ধারালো অস্ত্র দ্বারা কোরবানি করা মুস্তাহাব (শামী, খণ্ড ৫, পৃ. ২৭২)।
কয়েক ব্যক্তি একসাথে শরিক হয়ে যদি একটি গরু কোরবানি করে তবে মাপযন্ত্র (দাঁড়িপাল্লা) দিয়ে মেপে সমানভাবে গোশ্ত বণ্টন করা উচিত। অনুমান করে বণ্টন করা জায়িজ নেই। কেননা ভাগের কমবেশী হলে তা সুদ বলে গণ্য হবে এবং গুনাহ্গার হতে হবে। কোরবানির গোশ্ত অমুসলিমকে দেওয়াও জায়িজ। কিন্তু মজুরি বাবদ দেওয়া জায়িজ নেই। অবশ্য মুসলিমকে দেওয়াই উত্তম। কোরবানির গোশ্ত কোরবানি দাতার জন্য বিক্রি করা মাক্রূহ্ তাহ্রীমি। যদি কেউ বিক্রি করে তাহলে ইহার মূল্য সাদ্কা (দান) করা ওয়াজিব। কসাইকে গোশ্ত বানানোর মজুরিস্বরূপ গোশ্ত, চামড়া, রশি প্রভৃতি প্রদান করা জায়িজ নেই। পারিশ্রমিক দিতে হলে অন্যভাবে অন্য খাত হতে তা প্রদান করতে হবে (শামী, খণ্ড ৫, পৃ. ৪৭৮)।
গরু, মহিষ বা উটের মধ্যে কয়েক ব্যক্তি শরিক থাকলে তারা নিজেদের মধ্যে গোশ্ত ভাগ করে নেওয়ার পরিবর্তে যদি সমস্ত গোশ্ত একত্রে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে অথবা রান্না করে তাদের খাওয়ায় তবে তাও জায়েজ। কিন্তু শরিকদের কোন একজন ভিন্নমত প্রকাশ করলে জায়িজ হবে না। কোরবানির গোশ্ত তিনদিনের বেশি সময় জমা করে রাখা জায়িজ তবে দীর্ঘদিন জমা করে রাখা দুরস্ত নয়। কোরবানির পশুর রশিও সাদ্কাহ করা মুস্তাহাব (মাসাইলে ঈদাইন, পৃ. ১৮৩)।
কোরবানির চামড়া দান করা উত্তম। আর বিক্রি করলে তার মূল্য গরিব-মিস্কিনদেরকে দান করতে হবে। চামড়ার বিক্রিত অর্থ নিজে খরচ করে যদি অন্য অর্থ দান করে তবে আদায় হবে তবে মাক্রূহ্ হবে। কোরবানির চামড়ার মূল্য মাদ্রাসা, মসজিদ মেরামত কাজে অথবা মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন প্রমুখের বেতন হিসাবে প্রদান করা জায়িজ নেই। কোরবানির পশু যবেহর পর চামড়া ছাড়ানো, গোশ্ত কাটা ইত্যাদি কারণে যথোচিত মূল্যের কমে কসাই’র নিকট চামড়া বিক্রয় করাও দুরস্ত নয় (মাসাইলে ঈদাইন, পৃষ্ঠা ১৯২)।
বিখ্যাত হাদিস সংকলন আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি কোরবানি করার ইচ্ছা রাখে তার জন্য মুস্তাহাব হলো জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটা নখ না কাটা। আর যার কোরবানি করার সামর্থ্য নেই, তার জন্য উত্তম হলো কোরবানির পরিবর্তে চুল ও নখ কাটা। ‘হিদায়া’ গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডের ৪৩৪ নং পৃষ্ঠায় বর্ণনা করা হয়েছে,- কোরবানির পূর্বে কোরবানির পশুর দ্বারা কোন কাজ করে নেওয়া, যেমন হাল চাষ করা, তার উপর আরোহণ করা, দুগ্ধ দোহন করে পান করা কিংবা কোরবানির জন্তুর পশম কেটে বিক্রয় করা মাকরূহ্।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পবিত্র ঈদুল আয্হা মুসলিম জাতির কোরবানি উৎসর্গ-বিসর্জনের দিন, অথচ এ দিনই আবার প্রকৃত ঈদের আনন্দ-উৎসবের দিন। ত্যাগেই সুখ, ভোগে নয়; বিসর্জনেই প্রতিষ্ঠা, উৎসর্গেই সাফল্য, নিবেদনেই আনন্দ।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও বিসিএস (সা. শি) ক্যাডার কর্মকর্তা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।