Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হজ ও কোরবানি

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

নবী করীম সা. বলেছেন: আল্লাহর কাছে উত্তম কাজসমূহের মধ্যে পবিত্রতম এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে বড় আমল হলো ঐ আমল, যা যিলহজ মাসের প্রথম দশদিনে করা হয়। তিনি আরও বলেছেন: এই দশদিনের মর্যাদার সমতুল্য এবং এই দশদিনের আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয় আমল আল্লাহর কাছে নেই। (দারেমী ও আহমাদ)। পবিত্র হজের মূল অনুষ্ঠান কোরবানি এই দশদিনের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। হাজী সাহেবগণ ৮ যিলহজ মক্কা মোয়াজ্জমা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে মিনায় গিয়ে অবস্থান করেন। ৯ যিলহজ সূর্যোদয়ের পর সেখান থেকে রওয়ানা দেন আরাফাতের ময়দানের দিকে । সেখানে সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ বা অবস্থান করেন। (এটিই হজের প্রধান কাজ) সূর্যাস্তের পর সেখান থেকে পৌঁছান মুজদালাফায়। রাত্রে অবস্থান করেন সেখানে। ১০ যিলহজ সকালে সেখান থেকে রওয়ানা করে পৌঁছেন গিয়ে মিনা উপাত্যকায়। সেখানে শয়তানকে পাথর মেরে তারপর করেন কোরবানি। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিদিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু যবেহ করাকে বলা হয় কোরবানি। কোরবানির তাৎপর্য হলো ত্যাগ তিতিক্ষা এবং প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি করেন আদম আ. এর দুই পুত্র হাবীল ও কাবিল। প্রত্যেক জাতির জন্যই কোরবানির বিধান ছিল। আমরা যে কোরবানি করছি তা হযরত ইবরাহিম আ. এর অপূর্ব ত্যাগের ও বিস্ময়কর ঘটনার স্মারক।

হযরত ইবরাহিম আ. মা হাজেরা ও শিশু ইসমাইল আ.কে মক্কার মরু বিয়াবানে নির্বাসন দেন। হযরত ইবরাহিম আ. বাস করতেন ফিলিস্তিন এলাকায়। তার বড় সহধর্মিনী সারা বিবির স্বপত্নী বিদ্বেষের কারণে হাজেরা ও শিশু ইসমাইল আ.কে তিনি নির্বাসন দিতে বাধ্য হন। প্রায় হাজার মাইল দূরে উসর ধূসর পার্বত্য মরু উপাত্যকা মক্কা। জন মানবহীন, তরুলতা, ফলমূল, খাদ্যপানি শূন্য হাহাকার ভরা পার্বত্য এই মরু উপাত্যকায় হাজেরা ও ইসমাইল আ.কে রেখে গেলেন। আল্লাহর ভবিষ্যৎ মহাপরিকল্পনা তাৎক্ষণিকভাবে আমরা বুঝতে পারি না। সে পরিকল্পনায় তো ছিল, এখানে আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবাশরীফ পুনঃনির্মিত হবে, হজের আনুষ্ঠানিকতা প্রবর্তীত হবে, এখানে তাঁর হাবীব বিশ্বনবী সা. আবির্ভূত হবেন, নাযিল হবে পবিত্র কুরআন। এখানকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে প্রচারিত ও প্রসারিত হবে ইসলাম। এই স্থান পরিণত হবে বিশ্বাসীদের মহামিলন কেন্দ্রে। হাজেরা ও ইসমাইল আ.কে নির্বাসন দেয়ার মধ্য দিয়ে হলো যার সূচনা।

থাকলেন হাজেরা। পানি নেই, শিশু ইসমাইলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তেষ্টায় দিশেহারা হাজেরা উম্মাদিনীর মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। একবার দৌড়ে গিয়ে ওঠেন পার্শ্ববর্তী সাফা পাহাড়ে আর একবার মারওয়া পাহাড়ে। আশা, কোনো কাফেলা যায় নাকি এ পথ ধরে। দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান অতিক্রম করেন অতিদ্রুত। এভাবে ৭ বার। দৌড়াদৌড়ি করলেন। পানির দেখা পেলেন না। নিরাশ হয়ে ফিরলেন ইসমাইলের কাছে। এসে যা দেখলেন, তাতে বিস্মিত তিনি। দেখলেন, শিশু ইসমাইলের কচি পায়ের আঘাতে কঠিন পাথুরে যমিন ফেটে প্রবাহিত হচ্ছে পানির ফোয়ারা। ইসমাইলকে পান করালেন সেই পানি। নিজেও পান করলেন। স্বতঃস্ফূর্ত সেই জলধারাকে আটকে রাখার জন্য তার চার দিকে পাথরের টুকরা দিয়ে কূপাকৃতি করলেন। এই হলো যমযম, যা বিশ্ববাসী মহা নিয়ামত হিসেবে পান করে চলছে। পান করতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। এ পানি ফুরায় না, ফুরাবে না। আল্লাহপাক মা হাজেরার দৌড়াদৌড়িকে এতই পছন্দ করলেন যে, তা হজ ও ওমরাকারীদের ওপর ওয়াজিব করে দিলেন। আল্লাহর ফরমান: ‘সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে কেউ কাবা গৃহের হজ বা ওমরা সম্পন্ন করে তারা এই দুটির মধ্যে দৌড়ালে তাতে কোনো পাপ হবে না। বরং কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ নেক কাজ করলে আল্লাহ (তার) পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা: আয়াত ১৫৮)।

কোরবানির ঘটনা
বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে আছে, ইসমাইল আ. যখন কৈশরে উপনীত হলেন তখন হযরত ইবরাহিম আ. আল্লাহর নিকট থেকে স্বপ্নে নির্দেশ পেলেন হে, ইবরাহিম কোরবানি করো। প্রাতে উঠে তিনি একশত দুম্বা কোরবানি করলেন। দ্বিতীয় রাতে তিনি আবার কোরবানির নির্দেশ পেলেন। এবার নির্দেশ পালনার্থে তিনি একশত উট কোরবানি করলেন। তৃতীয় রাতে পুনঃ নির্দেশ পেলেন হে ইবরাহিম! তোমার সব চেয়ে প্রিয় বস্তুকে আমার রাহে কোরবানি করো। প্রাতে উঠে ভাবলেন, আমার সব চাইতে প্রিয় বস্তু তো একমাত্র পুত্র ইসমাইল। তাকেই আল্লাহ চাচ্ছেন। মনস্থির করে ফেললেন তিনি। উপস্থিত হলেন গিয়ে বিবি হাজেরা (আ.)-এর কাছে। বললেন, ইসমাইলকে সাজিয়ে দাও তাকে বন্ধুর বাড়ি যিয়াফতে নিয়ে যাব। খুশি হলেন মা হাজেরা। এত দিন পরে শাম থেকে পিতা এসেছেন পুত্রের কাছে, নিয়ে যেতে চান বন্ধুর বাড়ি যিয়াফতে। তিনি বসন-ভূষণে পুত্রকে সাজিয়ে রওয়ানা করিয়ে দিলেন।

পবিত্র কুরআনের ভাষায়: ‘সে যখন (পিতার সাথে) দৌড়াদৌড়ি করার মতো (বয়সে) তখন সে (ইবরাহিম ছেলেকে) বললো, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, আমি তোমাকে যবাই করছি, (বলো এ ব্যাপারে) তোমার অভিমত কী? (এ কথা শুনে) সে বললো, হে আমার আমার আব্বা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে (এ সময়েও) ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন। অতঃপর যখন তারা দুজনই (আল্লাহতালার) ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ করলো তাকে (যবাই করার জন্য) উপুড় করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি (আমার দেখানো) স্বপ্ন সত্য প্রমাণ করেছো, আমি তোমাদের উভয়কে মর্যাদাবান করবো। (মূলত) আমি এভাবেই সৎকর্মশীল মানুষদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। এটা ছিল (তাদের উভয়ের) জন্য একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার (ছেলের) পরিবর্তে (আমার পক্ষ থেকে) একটা বড় কোরবানির পশু (সেখানে) দান করলাম। (অনাগত মানুষদের এ কোরবানির বিধান চালু রেখে) তার স্মরণ আমি অব্যাহত রেখে দিলাম’ (সূরা আস সাফাফাত: ১০২)।

পিতা-পুত্র হাযির হলেন এসে মিনা ময়দানে। এবার ইবরাহিম আ. স্বপ্নাদেশ অবহিত করে এ ব্যাপারে জানতে চাইলেন ইসমাইলের মতামত। সে খুশি মনে বলল, ‘আব্বাজান! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের মাঝে পাবেন’। অতঃপর ইবরাহিম আ. ইসমাইল আ. এর হাত পা শক্ত করে বাঁধলেন, যমিনের উপর উপুড় করে শোয়ালেন, এবং তীক্ষ্ণধার ছুরি তার গলায় চালিয়ে দিলেন। বিশ্ব প্রকৃতি স্তব্ধ বিস্ময়ে, রুদ্ধশ্বাসে প্রত্যক্ষ করল আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনের ও ভালবাসার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। কিন্তু কী আশ্চর্য! ছুরি গলায় বসছে না, একটা পশমও কাটছে না, আরও জোরে চালালেন, কিন্তু না কাটছেই না। ইবরাহিম আ. বলছেন, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ছুরির তলে ইসমাইল আ. বলছেন আল্লাহু আকবার, আর জিব্রাঈল আ. লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে বেহেশত থেকে একটি দুম্বা নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন। গায়েব থেকে আল্লাহ রাববুল আলামীন আওয়াজ দিলেন, ‘হে ইবরাহিম তুমিতো স্বপ্নকে সত্য সত্যই বাস্তবায়িত করলে। জিব্রাঈল আ. বললেন, কোরবানি কবুল। ইসমাইলের পরিবর্তে আল্লাহ-প্রেরিত এই বেহেশতি দুম্বাকে যবেহ করুন। এভাবে বেহেশতি দুম্বা কোরবানি হলো এবং রক্ষা পেলেন ইসমাইল আ.। উভয়ে লাভ করলেন আল্লাহর পরম সন্তুষ্টি।

সাহাবায়ে কেরাম একদা রাসূলুল্লাহ সা.কে প্রশ্ন করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোরবানি কী? তিনি বললেন: তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ. এর সুন্নাত। তারা বললেন: এ দ্বারা আমরা কী পাবো? তিনি বললেন: এ পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে তোমরা একটি করে নেকী পাবে। (ইবনে মাজাহ)। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: ‘আদম সন্তান কোরবানির দিন যে সব নেকীর কাজ করে থাকে তন্মধ্যে আল্লাহপাকের নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় আমল হলো কোরবানি করা। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানির রক্ত যমীনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ পাকের নিকট কবুল হয়ে যায়।’ (ইবনে মাজাহ)। কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন কোরবানিকারীর জন্য পুলছিরাতে সওয়ারী হবে।

রাসূলুল্লাহ সা. প্রতি বছরই কোরবানি করেছেন। সোলেহ হোদায়বিয়ার সময় তিনি নিজ হাতে কোরবানির উট যবেহ করেছন। বিদায় হজের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একশত উট কোরবানি করেছেন। তন্মধ্যে ৬৩টি উট নিজ হাতে যবেহ করেছেন। বাকী ৩৭টি উট তার নির্দেশে হযরত আলী রা. যবেহ করেন। কোরবানি করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। আল্লাহপাক বলেন, ‘আপনি বলে দিন, আমার নামায, আমার কোরবানি তথা আমার সমগ্র ইবাদত, আমার জীবন ও মরণ সবকিছু বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আল আনআম: আয়াত ১৬২)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হজ ও কোরবানি

৯ জুলাই, ২০২২
১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন