বিভিন্ন ধর্মে কোরবানি
পবিত্র ঈদুল আজহা। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন নামে
হযরত ইসমাইল (আ.)কে কোরবানি করার ঘটনাটি সূরা ‘সাফফাত’ এ বর্ণিত হয়েছে। ইসমাইল (আ.) এর স্থলে পশু কোরবানি হয়ে যায়। সত্যি সত্যিই যদি হযরত ইসমাইল (আ.) জবাই হয়ে যেতেন, তাহলে দুনিয়ায় পুত্র কোরবানি করার প্রথা চালু হয়ে যেত, এমন বলেছেন কেউ কেউ। হয়নি যে, সেটা আল্লাহ রাব্বুল আলআমীনের অসীম মেহেরবাণী।
এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি প্রসিদ্ধ উক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। কোনো এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আনা ইবনুয-যাবিহাইনে’ অর্থাৎ আমি দুই জবাইকৃতের সন্তান। এক জবাইকৃত অর্থাৎ জবাই করার জন্য স্থিরকৃত হজরত ইসমাইল (আ.), তিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ (সা.) এর ঊর্ধ্বতন পুরুষ, শৈশবে কোরবানি হতে রক্ষা পেয়ে যান। দ্বিতীয় জবাইকৃত (কোরবানির জন্য মনোনীত) রসূলুল্লাহ (সা.) এর পিতা মহাত্মা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মোত্তালেব। লুপ্ত যমযম কূপ প্রাপ্তি সম্পর্কে আবদুল মোত্তালেবের ঘটনাটি ইতিহাস খ্যাত। সংক্ষেপে এতটুকু বলে রাখা দরকার যে, আবদুল মোত্তালেবের পুত্রদের মধ্যে কোরবানির জন্য লটারিতে বার বার আবদুল্লাহর নামই উঠেছিল। অবশেষে একশটি উটের পরিবর্তে আবদুল্লাহর নাম ওঠা বন্ধ হয় এবং তিনি বেঁচে যান। আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য প্রকাশের এ ত্যাগী আদর্শের জন্য রসূলুল্লাহ (সা.) গর্ববোধ করেছেন এবং দুই মহান পিতার সেই আত্মত্যাগের কথা তিনি বিস্মৃত হতে পারেননি, উম্মতকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
কোরবানির আদি ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, কোনো হালাল পশু আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করার প্রথা তখন থেকে শুরু হয়েছে, যখন থেকে আদম (আ.) দুনিয়ায় আগমন করেন এবং দুনিয়া আবাদ হয়। সর্ব প্রথম কোরবানি প্রদান করেন হযরত আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। তাদের বিয়েকে কেন্দ্র করে কোরবানির সূচনা হয়েছিল।
কোরআনের বিখ্যাত ভাষ্যকার ইবনে কাসির হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর বরাতে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বলা হয়েছে, হাবিল একটি মেশ কোরবানি হিসেবে পেশ করেন এবং কাবিল নিজের ক্ষেত খামারের উৎপাদিত শস্য ইত্যাদি হতে কিছু শস্য সদকা হিসেবে কোরবানি করে। আসমান হতে আগুন অবতীর্ণ হয় এবং হাবিলের মেষকে খেয়ে ফেলে এবং আগুন কাবিলের কোরবানিকে স্পর্শও করে না।
আম্বিয়ায়ে কেরামের যুগে কোরবানি কবুল হওয়া না হওয়ার পরিচয় ছিল এই যে, আল্লাহ যার কোরবানি কবুল করতেন, আসমান হতে একটি আগুন আসত এবং তাকে জ্বালিয়ে দিত। সেকালে জেহাদের মাধ্যমে গনিমত হিসেবে যে মাল কাফেরদের কাছ থেকে লাভ করা হত, আগুন এসে তাও খেয়ে ফেলত এবং তা জেহাদ কবুল হওয়ার লক্ষণ ছিল। আল্লাহ তাআলা উম্মতে মোহাম্মদির জন্য বিশেষ পুরস্কার দান করেছেন যে, কোরবানির গোশত এবং গনিমত (যুদ্ধলব্ধ মাল) তাদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। এ বিশেষ পুরস্কারের কথা রসূলুল্লাহ (সা.) একটি হাদীসে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার জন্য গনিমতের মাল হালাল করে দেয়া হয়েছে।’
আগুন এসে কোরবানির পশু খেয়ে ফেলত, এটি সূরা আলে ইমরানের ১৮৩-১৮৪ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। সূরা মায়েদার দ্বারা প্রমাণিত যে, হযরত আদম (আ.) এর যুগ হতে সর্ব প্রথম পশু কোরবানিকে এবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সূরা আলে ইমরানের বর্ণিত আয়াত হতে জানা যায় যে, কোরবানি কবুল হওয়ার বিশেষ পদ্ধতি ছিল আসমান হতে আগুন এসে তাকে জ্বালিয়ে দিত এবং এ পদ্ধতি পূর্ববর্তী নবীগণের যুগ হতে শুরু হয়ে সর্বশেষ নবী রসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগ পর্যন্ত চালু ছিল।
আদমপুত্রদ্বয় হাবিল-কাবিলের ঘটনার পর পশু জবাই বা কোরবানি করার ইতিহাস শুরু হয় সম্ভবত নূহ (আ.) এর যুগ হতে। হজের অংশ হিসেবে কোরবানির পশুকে বলা হয় ‘আল বুদনা, অভিধান বিশারদগণের মতে, শব্দটি গরু, বকরি বা উট সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোরআনে এর ব্যবহার দেখা যায়। বিভিন্ন হাদীসেও শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। সর্ব প্রথম যিনি ‘বুদনা’ কোরবানি করেছিলেন বায়তুল্লাহ শরীফে, তার নাম ইলিয়াস ইবনে মোযার। কথিত আছে যে, নূহ (আ.) এর তুফানের সময় খানা-ই কাবা লুপ্ত বা ধ্বংস হয়ে গেলে ইলিয়াস ইবনে মোযার তা অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করেন।
আল্লাহর আদি গৃহ খানা-ই কাবা এবং হজ ও কোরবানি এ তিনটি এলাহী নিদর্শন একটার সাথে একটার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ইলিয়াস ইবনে মোযার ছিলেন রসূলুল্লাহ (সা.) এর ঊর্ধ্বতন ১৮তম পুরুষ। তিনিই সর্ব প্রথম লুপ্ত খানা-ই কাবার সন্ধান করে কাবায় হজ করেন এবং ‘বুদনা’ পশু কোরবানি করেন। বলা হয়ে থাকে সে পশু নিদর্শন হিসেবে কাবার একটি কোণে স্থাপন করে রেখেছিলেন। এ কারণে আরবরা ইলিয়াস ইবনে মোযারের প্রতি অত্যন্ত সম্মান করতেন। ইমাম সোহেলী বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা.) একটি হাদীসে বলেছেন, ‘তোমরা ইলিয়াসকে মন্দ বলো না। কেননা তিনি মোমেন ছিলেন।’ তার সম্পর্কে এ কাহিনী প্রচলিত আছে যে, হজের সময় ইলিয়াস ইবনে মোযারের কবর হতে রসূলুল্লাহ (সা.) এর তালবিয়ার আওয়াজ শোনা গিয়েছে।
কোরবানি প্রত্যেক নবীর যুগে কোন না কোন প্রকারে চালু ছিল। হযরত মূসা (আ.) এর যুগে কোরবানির একটি ঘটনা এতই প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, সূরা বাকারায় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ঘটনাটি ছিল এই যে, ‘আমিল’ নামক এক ব্যক্তি নিহত হলে তার হত্যাকারী অজানা থেকে যায়। বিষয়টি হযরত মূসা (আ.) এর খেদমতে পেশ করা হলে, তিনি আল্লাহর দরবারে নিহত ব্যক্তির লোকদেরকে একটি গরু জবাই করতে বলেন। হুজ্জতি বনি ইসরাইল মূসা (আ.)কে বার বার জিজ্ঞাসা করতে থাকে গুরুটি কেমন হবে, তার রং কী হবে ইত্যাদি। আল্লাহর পক্ষ হতেও একটার পর একটা শর্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, শর্ত অনুযায়ী গরু পেতে চল্লিশ বছর সময় লেগেছিল। গরু পাওয়ার পর তা জবাই করে নিহত ব্যক্তির কবরে তার লেজ দ্বারা আঘাত করা হয় এবং নিহত ব্যক্তি জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেয়। হত্যাকারী ছিল তারই ভ্রাতুষ্পুত্র, সম্পত্তির লোভে সে আপন চাচাকে হত্যা করে। সে যুগে এটিও ছিল এক প্রকারের কোরবানি।
হজরত সুলায়মান (আ.) এর কোরবানি সম্পর্কে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে যে, তিনি যখন হজ উপলক্ষে মক্কা সফর করেন, তখন সেখানে অবস্থান কালে প্রতিদিন মক্কায় পাঁচ হাজার উটনি, পাঁচ হাজার গরু এবং বিশ হাজার বকরি, জবাই করতেন। মক্কা মোকাররমায় পশু কোরবানি করার এ প্রথা নতুন নয়, আদি কাল থেকে চলে আসছে।
কোরবানি এবাদত হিসেবে বিধিবদ্ধ হওয়া হযরত আদম (আ.) এর যুগ হতে প্রমাণিত হলেও তার একটি বিশেষ মর্যাদা হযরত ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আ.) এর একটি ঘটনা হতে শুরু হয় এবং তার স্মৃতি হিসেবে মোহাম্মদী শরীয়তে কোরবানি করা ওয়াজিব হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্ব ইতিহাসের এ বিস্ময়কর ঘটনা কোরআনের সূরা সাফফাতে বর্ণিত হয়েছে এবং বিশ্বস্ত বহু হাদীসে কোরবানির বিষয়ের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। এটি এমন ব্যাপক আলোচিত বিষয় যে, হজরত ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) হতে এ যাবত প্রত্যেকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে আসছে।
নবীর স্বপ্ন দ্বারা যেহেতু শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত হওয়া খোদায়ী বিধান। সুতরাং হযরত ইবরাহীম (আ.) এর পর পর একই স্বপ্ন দর্শন এবং তা বাস্তবায়নের সকল উদ্যোগ প্রয়াসের পরিণতি ছিল হযরত ইবরাহীম (আ.) এর পুত্র কোরবানি করার ঘটনা এবং শেষ পর্যন্ত পুত্র স্থলে দুম্বা/ভেড়া এসে কোরবান হয়ে যাওয়া। আর এ ইবরহিমী সুন্নতকে সমগ্র উম্মতের ওপর ওয়াজিব হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। এটি কেবল হাজীদের জন্য নির্দিষ্ট নয়, সকল মুসলমানের ওপর (বিধি সম্মতভাবে) ওয়াজিব। দেখা যায়, খোদ রসূলুল্লাহ (সা.) সকল সাহাবা, তাবেঈন এবং এবং সমগ্র উম্মত দুনিয়ার যে কোন প্রন্তেই অবস্থান করুক না কেন, সবাই কোরবানিকে ওয়াজিব কাজ হিসেবে পালন করে থাকে, এমনকি একে ইসলামের অন্যতম প্রতীকী নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘কোরবানির উট ও গরুকে তোমাদের জন্য আল্লাহর স্মৃতি নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি।’ (সূরা- হজ)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।