Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদুল আজহার অর্থনীতি

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব দু’টি: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের উৎসবাদির থেকে মুসলমানদের এই উৎসবের রয়েছে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট পার্থক্য। অন্যান্য ধর্মের লোকদের উৎসবের লক্ষ্য নিতান্তই আনন্দ-ফুর্তি করা। এর মধ্যে ইন্দ্রিয়স্পৃহা বা ভোগ-লালসা চরিতার্থ করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। আধ্যাত্মিক-সামাজিক কোনো উদ্দেশ্য তেমন একটা দেখা যায় না। পক্ষান্তরে মুসলমানের উৎসবের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা যেমন আছে, তেমনি আছে সামাজিক কল্যাণের নানা দিক। ইসলামের উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। উৎসবের দিন প্রত্যুষে নামাজের মধ্য দিয়ে ওইদিনের কার্যক্রম শুরু হয়। ইসলামে নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। নামাজ প্রতিটি মুসলমানের আধ্যাত্মিক উন্নতি বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় হিসেবে গণ্য। তাই নামাজ দিয়েই শুরু হয় মুসলমানদের উৎসব। দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের দুই উৎসবেই দান-সদকা ও অর্থনৈতিক কিছু কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়, যার লক্ষ্য থাকে গরিব-দুঃখী মানুষের উপকারের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ সাধন করা। শুধু তাই নয়, উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রত্যেকটি মুসলিম দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে, গতিশীল করে।

সব উৎসবেরই অন্যতম লক্ষ্য নির্মল আনন্দ উপভোগ করা। সেটা ইসলামের উৎসবে যেভাবে হয়, অন্য কোনো ধর্মের উৎসবে সেভাবে হয় না। ইসলামে পারিবারিক সম্মেলন, সামাজিক সম্মেলনের ব্যবস্থা বা রেওয়াজ আছে। প্রতিটি মুসলিম পরিবারের সদস্যরা সারাবছর যাই হোক, অন্তত ঈদের সময় একসঙ্গে মিলিত হয়। এটা তাদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ তো বটেই, একই সঙ্গে পারিবারিক সখ্য ও বন্ধন দৃঢ় করার প্রকৃত উপায়ও। উৎসবের দিন মুসলমানেরা যে নামাজে মিলিত হয় সেখানে সব বয়সী সবাই শামিল হয়। এই নামাজ সামাজিক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঈদুল আজহায় কোরবানির গোশত বিতরণের যে নির্দেশনা আছে, তাতে আত্মীয়তার বন্ধন, সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী হয়। গরিব ও সামর্থ্যহীন পরিবারের উৎকৃষ্ট খাদ্য খাওয়ার সুযোগ ঘটে। এটা বড় ধরনের সামাজিক কল্যাণ।

ঈদুল আজহার সঙ্গে হজের সম্পর্ক ওতপ্রোত। হজের সঙ্গে কোরবানির সম্পর্কও। হজের নির্ধারিত কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর কোরবানি করেন হাজীরা। হাজীরা ছাড়াও দুনিয়ার সর্বত্র সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি ওয়াজিব। হজের সময় তাই গোটা বিশ্বের মুসলিম দেশ ও জনপদে কোরবানি হয়ে থাকে। হজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়েছে সেই ঘটনাকে, হযরত ইব্রাহীম আ. তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরা ও শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল আ.-কে মক্কায় রেখে আসার পর যা ঘটেছিল। উষর মরুভূমিতে পানি ছিল না। পানির অভাবে বিবি হাজেরা ও শিশু হযরত ইসমাইল আ.-এর জীবন সংশয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে, মা হাজেরা তার পুত্রের জীবন নিয়ে অতিশয় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পানির জন্য ছোটাছুটি করতে থাকেন। একবার সাফা পর্বতে যান আর একবার মারওয়া পর্বতে যান। এভাবে সাতবার যাওয়ার পর হতাশ হয়ে পুত্রের কাছে ফিরে আসেন। এসে দেখতে পান হযরত ইসমাইল আ.-এর পায়ের নিচ দিয়ে একটি ঝরনা প্রবাহিত হচ্ছে। এই ঘটনাকে আল্লাহপাক এতই পছন্দ করেন যে, তা হজের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। অন্যদিকে কোরবানির সঙ্গে সেই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে, যে ঘটনায় আল্লাহপাকের নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম আ. স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইল আ.-কে নিজ হাতে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। হযরত ইসমাইল আ.-এর স্থলে আল্লাহর ইচ্ছায় দুম্বা কোরবানি হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে হযরত ইব্রাহিম আ. ও হযরত ইসমাইল আ.-এর এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগের ঘটনাকে কোরবানির মাধ্যমে অমর করে রাখা হয়েছে। কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধি এবং পাষব প্রবৃত্তিকে কোরবানি করা। পশু কোরবানি এর প্রতীকী প্রকাশ মাত্র।

ঈদুল আজহায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে। আমরা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা আলোচনা করতে পারি। তাতে ঈদুল আজহার অর্থনীতি জাতীয় অর্থনীতিকে কীভাবে সমৃদ্ধ করছে তা সম্যক বোঝা যাবে। ঈদুল আজহায় অর্থনীতিতে প্রচুর পরিমাণে মুদ্রা সরবরাহ হয়ে থাকে। মুদ্রার চলমানতায় গতি সঞ্চারিত হয়। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এর বিস্তার লক্ষ করা যায়। এ উপলক্ষে শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য জমজমাট হয়ে ওঠে। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মতে, কয়েকটি খাতে আর্থিক লেনদেনসহ বহু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, যা গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রভাব রাখে।

হজে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়। প্রতি বছর লাখ লাখ বাংলাদেশি হজে যায়। তাদের প্রতিজনের পেছনে কয়েক লাখ টাকা করে ব্যয় হয়। হজের খরচ হিসেবে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়, তেমনি দেশি মুদ্রাও যথেষ্ট ব্যয় হয়। হিসাব করলে দেখা যাবে এ খাতে সাকুল্য যে ব্যয় হয়, তা বিশাল।

প্রতি বছর লাখ লাখ গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া কোরবানি হয়। এদের লালন-পালন সারাবছর ধরেই হয়। এতে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। গত বছর সারাদেশে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদি পশু কোরবানি হয়। এর মধ্যে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ, ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৭১৫টি। এই তথ্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। এ বছর কোরবানিতে গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজারের মতো। আর এবার কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর মোট সংখ্যা রয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮৩টি গবাদি পশু বেশি রয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, এক সময় কোরবানির পশুর জন্য আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো। ভারত-মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ গবাদি পশু আমদানি করতে হতো। চোরাপথেও আসত প্রচুর। ক’বছর আগে ভারত বাংলাদেশে গরু রফতানি, এমনকি চোরাচালানও বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায়, ঈদের সময় গবাদি পশুর সঙ্কট দেখা দেয়। সঙ্কট মোকাবিলায় গবাদি পশু পালনের ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়। এর ফলে অচিরেই গবাদি পশুর উৎপাদন বেড়ে যায়। ঈদের চাহিদার অতিরিক্ত লাখ লাখ গবাদি পশু, ওই পদক্ষেপেরই সুফল। আমদানি ও চোরাই পথে আসা গবাদি পশুর জন্য প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতো, যা এখন হয় না। গবাদি পশুর ক্ষেত্রে দেশ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। শুধু গোশতে না, দুধেও দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে। এটা অবশ্যই একটা বিরাট অর্জন। গবাদি পশু লালন-পালনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে একটা নতুন প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। যাহোক, লাখ লাখ কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর আর্থিক মূল্য কত, সেটা গড় হিসাব করলেও যা দাঁড়াবে। তাতে যে কারো চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। আমাদের চামড়া শিল্প মূলত চলে কোরবানির সময় সংগৃহীত চামড়া দিয়ে। চাহিদার অন্তত ৭৫ শতাংশ আসে ঈদের সময়। কাঁচা চামড়া রফতানি হয়। পাদুকাশিল্পে চামড়া প্রধান উপকরণ। চামড়া হস্তশিল্পেরও অন্যতম উপাদান। তাছাড়া চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ইত্যাদি কাজে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান রয়েছে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত।

কোরবানির গোশতের বেশিরভাগই আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এর গভীর সামাজিক ও মানবিক গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া এই গোশত আরো একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টিচাহিদা পূরণ করে। যাদের পুষ্টির অভাব, তাদের পুষ্টির জোগান দেয়। পুষ্টিবান নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে কোরবানির এই ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এমন লোক বা পরিবার আমাদের দেশে যথেষ্ট রয়েছে, যারা সারা বছরেও গোশত কিনে খেতে পারে না। তাদের জন্য কোরবানি গোশত খাওয়ার উপলক্ষ।

ঈদ উপলক্ষে লাখ লাখ মানুষ কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ছুটে যায়। এটা আমাদের দেশের রেওয়াজ ও ঐতিহ্য। খবরে প্রকাশিত হয়েছে, এবার শুধু রাজধানী থেকেই ৮০ লাখ মানুষ গ্রামে যাবে। অন্যান্য শহর থেকেও বহু মানুষ গ্রামে যাবে। ঈদযাত্রার প্রস্তুতি, নানাবিধ কেনাকাটা, যাতায়াত খরচ ইত্যাদিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। পরিবহন ব্যবসা এ সময় রমরমা হয়। অতিরিক্ত ভাড়াও পরিবহন মালিকরা আদায় করে থাকে।

ঈদ উপলক্ষে গোশতসহ বিভিন্ন উপাদেয় খাবার রান্না করা হয় প্রায় প্রতিটি পরিবারে। ফলে তেল-মশলাসহ নানা উপকরণ কিনতে হয়। এসব পণ্যের ব্যবসাও জমজমাট রূপ নেয়। জানা গেছে, এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার মশলাই আমদানি হয়েছে।

এভাবে আলোচনা করলে আরো বহুদিক বেরিয়ে আসবে, যার সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ঈদুল আজহায় প্রতি বছর সব মিলে অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার কারবার বা লেনদেন হয়, জাতীয় অর্থনীতিতে যার ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম। কথায় বলে, টাকার যত হাতবদল ও লেনদেন হবে, ততই মানুষ উপকারভোগী হবে এবং অর্থনীতিও জোরদার হবে। একথার সত্যতা আমরা ঈদুল আজহার সময় বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারি। পরিশেষে বলতে চাই, ইসলামের উৎসবে আধ্যাত্মিক, মানবিক ও সামাজিক দিক যেমন প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনি প্রাধান্য পেয়েছে অর্থনৈতিক দিকও। ইসলাম যে একমাত্র ও সম্পূর্ণ জীবনবিধান, তা বলাই বাহুল্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদুল আজহার অর্থনীতি
আরও পড়ুন