পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে ৪৯টি সরকারি ও ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে, যদিও দীর্ঘ করোনা অতিমারী সারা বিশ্বের মতো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনেকটা স্থবির করে দিয়েছে। গতবছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী চিহ্নিত হবার পর শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখে একই মাসের ১৭ তারিখ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যার মেয়াদ অনেকবার বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত চলমান আছে। বারবার সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেয়া হলেও তা বাস্তবে সত্যে পরিণত হয়নি। গত ১৩ জুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পূর্বঘোষণা থাকলেও সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চোখ রাঙানির ফলে তা আর সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জোরালো হবার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, একবছর পরীক্ষা না হলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। অথচ, যারা ভুক্তভোগী তারা বলছেন, তারা সেশন জটে পড়ছে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু চাকরিতে আবেদন করার বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানো না হলে প্রকৃত অর্থেই শিক্ষার্থীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
জীবন-জীবিকা, শিল্প-বাণিজ্য, উৎপাদন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, কৃষি ও শিক্ষা সচল রাখতে হলে টিকাকরণই হলো এখন একমাত্র উপায়। তাই টিকা আমদানির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশেই দ্রুত টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও কাজটি সহজ নয়, তা সত্ত্বেও আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশের শিক্ষাক্ষেত্র স্থবির। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চাবি এখন করোনা টিকার হাতে। দিন দিন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি শিক্ষার গুণগত মান। গত দুই দশকে শিক্ষার গুণগত মানের নিম্নমুখীধারা দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা কিছুদিন আগে পর্যন্ত গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির ওপর ন্যাস্ত ছিলো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা তাদের মনোনীত ব্যক্তিরাই ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন আর তা সম্ভবপর নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন ব্যক্তিরা শিক্ষার উন্নয়নে যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আগ্রহী ছিলেন অনিয়ম, দুর্নীতি ও সীমাহীন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ প্রদানে। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট মেধাবী নয় বরং নিয়োগ পেয়েছেন তুলনামূলকভাবে অনেক কম মেধাবী ব্যক্তি। একজন শিক্ষক ৩০/৪০ বছর শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান করে থাকেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে এমন মেধাহীন শিক্ষক জাতি গঠনে অবদান রাখা তো দূরের কথা বরং মেধাহীন উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরি করতে ভূমিকা রাখবেন। আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রশিক্ষণখাতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত হলেও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক তৈরি করার ক্ষেত্রে বরাবরই আমরা অনিহা প্রকাশ করে আসছি। শহরের চেয়ে গ্রামীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষকদের অবস্থা আরো শোচনীয়।
গত দুই দশকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেধাহীন ও অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের একটা ধারা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভাগের প্রথম স্থান অধিকারীকে বাদ দিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আবেদন করার যোগ্যতাই নেই এমন ব্যক্তিকেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। যে ছেলেটি মেধাতালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন ভর্তি হতে পারেনি সে কিনা কোনো এক আলাদিনের চেরাগের স্পর্শ পেয়ে আজ সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! অনেকের আবার আবেদন করার যোগ্যতাই ছিলো না। তাতে কী? আত্মীয়-স্বজন, ছেলেমেয়ে, মেয়ের জামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের জন্য অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে কাঙ্খিত মার্কস বা সিজিপিএ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে মেধাবীদের। এখন তো আবার ফেল করা দ্বিতীয় শ্রেণি প্রাপ্তকেই রাতের আঁধারে মানবিক করণে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। যে কিনা ছাত্র জীবনে মেধার ভিত্তিতে ভর্তিই হতে পারেনি।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সরকারের পক্ষ থেকে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার সিংহভাগই ব্যয় করা হয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদী খাতে আর দালান কোঠা নির্মাণে। গবেষণা খাতের বরাদ্দ শুধু কমই নয়, অপ্রতুলও বটে। সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। একসময় বিদেশি স্কলারশিপ মেধার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বণ্টন করার প্রচলন থাকলেও এখন তা সরকারি আমলারা নিজেরাই ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। যা তাদের পেশাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে তেমন কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। উন্নত বিশ্বে গবেষণা খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হলেও আমাদের ক্ষেত্রে তা একেবারেই নগন্য।
দেশের মাদরাসা শিক্ষার অবস্থা আরো শোচনীয়। যোগ্য ও মেধাবী আলেম শিক্ষকের অভাব এই মুহূর্তে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকারি তিনটি মাদরাসার অবস্থা তো আরো সংকটাপন্ন। মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ অধিকাংশ কর্মকর্তার মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে সম্যক কোনো ধারণা নেই। অথচ তাঁরা মাদরাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছেন। মাদরাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে আলাদা মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর চালু হলেও তার প্রধানসহ অধিকাংশ হর্তাকর্তা মাদরাসাবহির্ভূত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আগত। ফলে মাদরাসা শিক্ষার মৌলিক জ্ঞান না থাকার কারণে আজ এ শিক্ষা ব্যবস্থা মাঝিহীন নৌকার মতো ভরা নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সকল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল-কলেজ পরিচালনার জন্য স্থাপিত শিক্ষা অধিদপ্তর পরিচালিত হয় কলেজের একজন অধ্যাপক দ্বারা। বলতে গেলে মাউশি’র সকল কর্মকর্তা কলেজ শিক্ষক। অথচ, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অধিকাংশ কর্মকর্তা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। আমরা সবাই জানি যে, সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম স্তর হলো প্রাথমিক শিক্ষা, যা সরকারে একটি অগ্রবধিকার খাত। আর মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর হলো এবতেদায়ী শিক্ষা, যা আজ চরমভাবে অবহেলিত। মাদরাসা শিক্ষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবতেদায়ী শিক্ষার আধুনিকায়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে কাওমি মাদরাসা বলে আরেক ধরনের ধর্মীয় শিক্ষা চালু রয়েছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক তাদের ‘দাওরায়ে হাদিস’কে মাস্টার্স সমতুল্য মান দেয়া হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু তাদের কোন ডিগ্রি এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতকের সমতুল্য তা কিন্তু কেউ জানে না। এ এক অদ্ভুত ধরনের স্বীকৃতি।
স্বাধীনতার পর দেশে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। সঙ্গতভাবেই শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের কলেজগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এবার আসি দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রমাবনতিশীল মানের দিকে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) ২০২২ সালের জন্য বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে। তাতে প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালল বা বুয়েটের অবস্থান নেই। গত বছরের মতো এই বছরের তালিকাতেও দেশের শীর্ষ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে রয়েছে। কিউএস তাদের তালিকায় ৫০০ এর পরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করে না। প্রতিষ্ঠানটি একাডেমিক খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতের ভিত্তিতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং করে থাকে। ২০১২ সালে কিউএস’র তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১ এর মধ্যে। ২০১৪ সালে তা পিছিয়ে ৭০১তম অবস্থানের পরে চলে যায়। ২০১৯ সালে তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও পেছনের দিকে চলে যায়। দেশের শীর্ষ দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কিউএস’র তালিকায় ১০০১ থেকে ১২০০তম অবস্থানের মধ্যে রয়েছে। গত ১০ বছরের মতো এবারও তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। এ ছাড়া ২০২২ সালের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ ও হার্ভাড ইউনিভার্সিটি। গত বছরের মতো এবারের তালিকাতেও বিশ্বের ১০০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এশিয়ার ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এশিয়ার শীর্ষ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো: সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ও নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি। তালিকায় এদের অবস্থান যথাক্রমে ১১তম ও ১২তম। এ ছাড়া, শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের আটটি ও পাকিস্তানের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এ চিত্র আমাদের জন্য হতাশাজনক। দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের এই ক্রমাবনতি আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ, মেধার পরিবর্তে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগই এমন ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া গবেষণাখাতে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। একটা কথা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। দেশ বাঁচলে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।