চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ফলে ফ্লাস্কে করে রক্ত সংগ্রহ করে তা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। মূলত চল্লিশের দশকে মেট্রোপলিটন শহরে এবং পঞ্চাশের দশকে জেলা শহরগুলোতে বøাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সব বøাড ব্যাংকগুলোই পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বলে অনেক বেসরকারি বøাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কলকাতায় প্রথমবারের মতো তিন দিনব্যাপী ন্যাশনাল সেমিনার এন্ড ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তখন থেকে ‘গিফট অফ বøাড’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। জনস্বার্থে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে সকল প্রকার রক্তের কেনাবেচা বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং স্বেচ্ছা রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে স্টেট বøাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল গঠনের জন্যে সরকারকে নির্দেশ প্রদান করে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ১০ই জুন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের সূচনা করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্রের উদ্যোগে সন্ধানী নামে প্রথম রক্তদান সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৮১ সনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ১৯৮২ সালে অরকা, ১৯৯৬ সনে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, ১৯৯৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন ‘বাঁধন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পথ ধরেই ৫ মে ২০০৫ সালে বøাড-ফ্রেন্ড সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম নতুন মাত্রা যোগ করে। দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় রক্তের সরবরাহের অভাবে পেশাদার রক্ত বিক্রেতার দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি বা এইডসের মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দূষিত রক্তের পরিসঞ্চালন থেকে মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষার জন্য নিরাপদ ও সুস্থরক্তের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠেছে।
রক্তদান ও পরিসঞ্চালন সম্পর্কিত প্রচলিত আইনঃ বাংলাদেশে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সরকার ‘নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন, ২০০২’ শিরোনামে ২০০২ সনের ১২ নং আইন পাশ করে। আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে, নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং রোগীর দেহে পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রণীত আইন। এই আইন ২০০২ সনের ১০ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই আইনে রক্ত বলতে পরিপূর্ণ মানব রক্ত এবং রক্তদানকে একটি সেবামূলক কাজ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আইন অনুসারে অনুমোদিত ব্যক্তি নিরীক্ষিত রক্ত অনুমোদিত পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও পরিসঞ্চালন করতে পারবে। ডাক্তার কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন চিকিৎসা প্রদানকালে প্রদেয় রোগীর বা রক্ত গ্রহীতার রক্তের সঠিক চাহিদা, রক্তের উপাদানের প্রকৃতি, রোগী বা রক্ত গ্রহীতার বিদ্যমান শারীরিক অবস্থা এবং রক্ত পরিসঞ্চালনের ধরন বা পদ্ধতি ব্যবস্থাপত্রে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এমবিবিএস বা সমমানের ডিগ্রিধারী এবং রক্ত পরিসঞ্চালন মেডিসিন বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিবিএসএন্ডটি, এমটিএম, এমডি, পিএইডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তারগণ ‘রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ’ বলে বিবেচিত হবেন। এই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকার এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করবেন এবং তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেবেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীর সভাপতিত্বে একুশ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কাউন্সিল’ রয়েছে। এতদসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্ভূত আনুষঙ্গিক বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদান এই কাউন্সিলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ‘হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস অর্থাৎ এইচআইভি’, ‘হেপাটাইটিস বি ভাইরাস’, ‘হেপাটাইটিস সি ভাইরাস’, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিসসহ সর্বপ্রকার রক্ত বাহিত রোগ থেকে মানব দেহকে রক্ষার জন্য; নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিসঞ্চালনের পদ্ধতি নির্ধারণ; রক্তদাতাদেরকে স্বেচ্ছায় রক্তদান, স্বজনকে রক্তদান এবং রক্তের বিনিময়ে রক্তদানকে উৎসাহিত করা; পেশাদার রক্তদাতাদেরকে রক্তদানে পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব উক্ত কাউন্সিলের। এই কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতে বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত; রক্তদাতাদের পরিসংখ্যান সংরক্ষিত ও সরকারী হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র পরিচালিত হয়ে থাকে।
লাইসেন্স ব্যতীত বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা; ভুল ব্যবস্থাপত্র প্রদান; অননুমোদিত পদ্ধতিতে রক্ত পরিসঞ্চালন; বিনষ্টযোগ্য উপকরণ বিনষ্ট না করা এবং তা পুনরায় ব্যবহার করা; অনিরীক্ষিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা; অননুমোদিত উপায়ে রক্ত, রক্তের উপাদান ও রক্তজাত সামগ্রী সংগ্রহ, উৎপাদন ও বিতরণ করা’ অননুমোদিত ব্যক্তি কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন করা; রক্তদাতার ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করা এবং অতিরিক্ত সেবা ফিস আদায় করা এই আইন অনুসারে দন্ডনীয় অপরাধ। উল্লিখিত অপরাধসমূহের যে কোন একটি বা একাধিক অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারান্তে দোষী সাব্যস্ত হলে সশ্রম কারাদন্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত সকল অপরাধ অআমলযোগ্য (ঘড়হ-পড়মহরুধনষব), জামিনযোগ্য, আপোষযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মামলা দায়ের করতে হবে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। এই আইন অনুসারে কৃত অপরাধের বিচারের জন্য মামলা করতে পারবেন (ক) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং তার অবর্তমানে মহা-পরিচালকের দায়িত্ব পালনরত কোন কর্মকর্তা অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা এবং (খ) ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধি। এরা ছাড়া আর কেউ এসব বিষয়ে মামলা দায়ের করতে পারবে না। অভিযোগ দায়ের করতে হবে লিখিতভাবে।
এছাড়া নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন ২০০২-এর আলোকে ২০০৮ সালে প্রণীত হয় রক্তদান বিধিমালা। এতে সরকার অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রক্তবাহিত রোগ নির্ণয়, রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রক্ত সংরক্ষণ এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট, রক্তের ব্যাগ ইত্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করা বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
রক্তদান ও পরিসঞ্চালনের শরয়ী বিধানঃ কোন বিশেষ মুহুর্তে স্বেচ্ছায় সুস্থ রক্তদাতার দেহ থেকে রক্ত সরবরাহ করে গ্রহীতার দেহে পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে রোগীর জীবন রক্ষা করা অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা নিরাপদ বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। রক্তদান প্রসঙ্গে আলিমদের মধ্যে দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। নিম্নে তাদের মত দুটি প্রমাণসহ বিশ্লেষণ করা হলো-
এক. রক্তদান বৈধ নয়: অনেক আলিমের মতে, ইসলামে রক্তদান বৈধ নয়। তাঁদের দলীল ও যুক্তিগুলো হলো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।