বাংলাদেশের জন্মকথা
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই
খুব ভোরেই এলো টেলিফোনটা। তখনো কারো মুখ ধোয়া হয়নি। নাস্তা খাওয়া হয়নি। বড় ভাবী রিসিভারটা হাতে ধরেই চিৎকার করে উঠলেন-
: ওগো শুনছো-
এবং এর কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়ির সবাই জেনে গেল দুঃসংবাদটা।
যে যেভাবে ছিল, গাড়ীতে গিয়ে উঠলো।
কিন্তু-
আমি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে পারলাম না। মায়ের একটা বিকট চিৎকার কানে এলো। সব যেন কেমন এলো মেলো হয়ে গেল। একসময় গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল পুরানা পল্টনের পথে।
আমি তখনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজায়। ওদের সবার সাথে গাড়ীতে উঠতে পারলাম না। অনেক অনেক পরে যখন পুরানা পল্টন পৌছলাম, তখন খোকনের লাশটা গোসলের পর খাটিয়ায় নতুন কাপড়ে সাজানো হয়েছে।
খোকন বড় আপার ছেলে। এবং একমাত্র ছেলে।
পরিবারের মাথার মণি।
সেই খোকন।
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
সে শুধু আমার বোন-পো বলে নয়, খোকনের মতো ছেলেকে নিয়ে এটা ভাবা যায় না।
সেই খোকন!
যে নাকি মাত্র বছর কয়েক আগেও শীতের সকালে ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে ভয় পেতো। আমাকে বলতো-
: মিষ্টি খালা-সাহস হচ্ছে নারে, তুই এক ঘটি পানি আমার গায়ে ঢেলে দিয়ে ভয়টা কাটিয়ে দে।
বাড়িতে আমার নাম ছিল চিনি। কিন্তু আমার চেয়ে বছর খানেকের ছোট খোকন ডাকতো মিষ্টি।
মিষ্টি খালা।
এ ডাকের অধিকার শুধু খোকনেরই ছিল। আমি ছিলাম ওর ছোটখালা।
কিন্তু-
খোকনের সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের।
ছেলে বেলা থেকেই আমরা একসাথে মানুষ।
বড় আপা বলতেন-
: চিনি যে তোর মুরুব্বি, সেটা কি তুই ভুলে যাস খোকন? ওকে যে মানতেই চাস না।
: মুরুব্বি!
চোখ বড় বড় করতো খোকন।
তারপর প্রচন্ড হেসে ফেলে বলতো-
: তাইতো, ঠিক আছে- মিষ্টি খালার বিয়েটাতো আগে হোক। তারপর না হয় খুব করে সম্মান-টম্মান করা যাবে।
আমি কপট চোখে বলতাম-
: বাঁদরামো হচ্ছে!
কিন্তু তারপরেই আমরা বড়পা’র চোখের আড়াল হয়ে ছাদে গিয়ে কুলের আচার খেতাম।
মা বলতেন -
: কে বলবে খালা-বোনপো! একটুও জ্ঞানগম্যি নেই। দু’টোই সমান।
খোকন ছিল ভীতু।
রাতে একা ছাদে পর্যন্ত যেতো না।
কোন কারণে আমি ওর সাথে আড়ি দিলে ঘুম আসতোনা খোকনের। বড়পা’র পাশে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। টের পেয়ে বড়পা জিজ্ঞেস করতেন-
: কি হয়েছে? পেট ব্যথা করছে?
: না-
: তবে? ঘুমুচ্ছিস না কেন?
বড়পা খোকনকে কাছে টেনে আদর করতেন।
: বল কি হয়েছে?
খোকন ঠোঁট ফুলিয়ে বলতো -
: মিষ্টি খালা শুধু শুধু আমার সাথে আড়ি দিল কেন?
: ও-সে জন্যে এতো দুঃখ। বেশ তো কাল সকালে কেমন ভাব করিয়ে দিই দেখিস। এখন ঘুমো।
পরদিন সকালে বড়পা আমায় সব বললে-জেদ বেড়ে যেতো আমার। বলতাম-
: আহা, বাঁদরটার সাথে কথা বলতে বয়েই গেছে আমার। কথা শেষ হবার আগেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো খোকন। চুল টেনে-খামচে রাখতো না।
আমিও শেষে চড় লাগাতাম। আমার সাথে কোনদিনই পেরে উঠতো না।
চড় খেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো খোকন।
সবার চোখের আড়ালে বাবলা তলায় গিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলাতো খোকন। বড়পা, মা কেউ ওকে ডেকে খাওয়াতে পারতেন না।
ওদিকে বকুনি খেতে খেতে আমার অবস্থা কাহিল হতো।
বেলা গড়িয়ে যেতো।
কেউ খোকনকে ঘরে আনতে পারতো না।
আমারও কান্না পেতো।
শেষ পর্যন্ত আমাকেই যেতে হতো।
আমার আত্মসম্মান জ্ঞান চিল টনটনে। ওর কাছে গিয়ে বলতাম-
: কেন তুই অমন করছিস? চুলে বুঝি লাগে না আমার!
কিন্তু খোকন চুপ।
হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জিতে ধুলোমাটি। চোখে মুখে ময়লা।
বলতাম-
: চল-মা তোর জন্যে ক্ষীরের পায়েশ করেছেন। নীরু-বিরু টের পেলে সব শেষ করে দেবে। তবু উঠতো না খোকন।
এবার আমি ওর হাত ধরলাম।
এবং সেই মুহূর্তে অশ্রু ভেজা চোখ দু’টো ওর হেসে ফেলতো।
হাসতাম আমিও।
এমনি করে কেটেছে আমাদের শৈশব আর কৈশোর।
এসেছে বসন্ত। টের পাইনি।
এরই মধ্যে বড়পাও পুরানা পল্টনে নতুন বাড়ি করেছে।
চলে গেছে খোকন।
কিন্তু তবুও ওদের বাড়িতে আমার সময় কেটেছে অজস্র।
প্রায় দিনই কলেজ শেষে চলে গেছি বড়পা’র বাড়ি।
খেয়ে দেয়ে বিকেলের দিকে খোকনের সাথে ঘুরে ফিরেছি।
কলেজ জীবনেই বিয়ে হয়েছিল আমার।
খোকন আমার বধুবেশ দেখে ঠাট্রা করেছিল, বলেছিল-
: তোকে এই বেশে কিন্তু মোটেও মানাচ্ছে না মিষ্টি খালা।
বলেছিলাম-
: তাই?
: ঠিক তাই।
কিন্তু কপাল পুড়েছিল আমার। বছর না ঘুরতেই বিধবা হয়ে আবার ফিরে এলাম বাপের বাড়িতে। দুঃখ পেয়েছিল খোকন।
আমাকে কখনো একটা চুপ করে থাকতে দেখলেই বলতো-
: খালুকে তুই খুব বেশি ভালোবাসতিস না?
আমি ওর প্রশ্নের উত্তরে চোখ তুলে চাইতাম শুধু।
খোকন গভীর কণ্ঠে বলতো-
শুধু শুধু একটি মানুষকে ভালবেসে কষ্ট পেয়ে কি লাভ? উদাস কণ্ঠে বলতাম-
: সে তুই বুঝবি নে।
খোকন বলতো -
: কাজ নেই আমার বুঝে। তোদের সবাইকে নিয়ে খুব ভালো আছি রে! মনের দিক থেকে খোকন ছিল একেবারে ছেলে মানুষ।
সেই খোকন-
হঠাৎ আমাকে চমকে দিল।
শুধু তাই নয়।
ভয়ে, শঙ্কায় আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। দুঃশ্চিন্তায় ঘুম আমার হারাম হয়ে গেল।
আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে খোকনের গর্বিত তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্য আর চাঞ্চল্য অন্যকে নিঃসন্দেহে আকর্ষণ করবার মতো।
কিন্তু ও যে এখনো শিশুর মতো সহজ-সরল।
রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি হতে সে এখনো জানে না। আর সেই জন্যেই ওর জীবনের এই গতি পরিবর্তন আমাকে ভাবিয়ে তুললো। শেষ পর্যন্ত একদিন ওর যন্ত্রণার সহযোগী হয়ে বললাম-
: তোকে নিয়ে সবার অনেক আশা।
খোকন আমার চোখে চোখ রাখলো।
বলল-
: জানি।
: তোকে ফার্স্ট ক্লাস পেতে হবে।
: জানি।
পরীক্ষার মাত্র এক মাস বাকি।
: আমার মনে আছে।
: তাহলে ...?
: তাহলে কি?
হঠাৎ অস্থির কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো খোকন।
আমি চমকে উঠলাম।
ভীষণভাবে চমকে উঠলাম।
একি চেহারা খোকনের...।
একি কণ্ঠ!
ওর যন্ত্রণাময় মুখের ছবি আমি সহ্য করতে পারলাম না।
বেরিয়ে বারান্দার এক কোণে এসে দাঁড়ালাম।
বুক ফেটে কান্না এলো আমার।
সামনের জানালাটায় ঘন অন্ধকার। সেই দিকে চেয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম।
কিছুক্ষণ পর পাশে খোকনের উপস্থিতি বুঝতে পেরেও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এক সময় খোকনের কম্পিত কণ্ঠ আমার হৃদয় স্পর্শ করলো।
: এর নাম ভালোবাসা।
আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। আমার বিস্মিত চোখ দেখলো-খোকনের মুখে সেই যন্ত্রণার ছবি কেমন ম্লান হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম খোকন বহুদুর এগিয়ে গেছে এবং এত বুঝতে পারলাম ওর এই এগিয়ে যাওয়ার পথটা আমার জানা দরকার। শেষ পর্যন্ত খোকনের কাছেই সব জানতে পারলাম। টিএসসিতে দেখলামও নীপাকে এবং দেখেই বুঝলাম খোকনকে রাহুর মতো গ্রাস করে নিয়েছে নীপা নামের মেয়েটি। খোকনের সম্ভাবনাময় পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিয়েছে সে। বোবা করে দিয়েছে।
খোকন যেন মন্ত্রমুগ্ধ।
নীপার অক্টোপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করবার পথ জানা নেই খোকনের। নীপাই ওর পৃথিবী।
খোকন জানে না ওর অবচেতন মন ওকে কোন অন্ধকার গহবরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
নীপা সে অন্ধকার রাজ্যের রাণী।
খোকন তার আজ্ঞাবহ দাস মাত্র।
আমি ওকে কি করে বোঝাব, এর নাম ভালোবাসা নয়। খোকন জানে না। এর নাম মোহ। এর নাম ছলনা।
কিন্তু অবুঝ খোকন বলে, এর নাম ভালোবাসা।
পরীক্ষার মাত্র কদিন আগে ঘটলো সেই অবাঞ্ছিত ঘটনা।
ছাত্রীহলের ন্যাক্কারজনক ঘটনার অন্যতম নায়িকা নীপা ধরা পড়লো হাতেনাতে এবং বেপরোয়াভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেললো সহজ সরল খোকনকেও। খোকন পুলিশের সামনে চিৎকার করে বলেছিল-
: সব চক্রান্ত। সব মিথ্যে। নীপা নিষ্পাপ। নীপা শুধু আমার।
কিন্তু নীপা কঠিন কণ্ঠে বলেছিল, শুধু আমাকে কেন ধরা পড়তে হবে? আমার মতো আরো অনেকেই এই হলে আছে যারা এই করে নিজের ষ্টাটাস ঠিক রেখেছে। ভার্সিটির খাতায় নাম লিখিয়েছে।
: দোষ শুধু আমার? যারা আমার কাছে আসে তাদের নয়? এই খোকনকেই জিজ্ঞেস করা হোক।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল খোকন।
ওর বন্ধুরা বলেছিল কদিন বাড়িতে থাকতে।
বুকে খুব লেগেছিল ওর।
আমি সব জানতাম। জানতো না বড়পা। ইচ্ছে করে কদিন ওদের বাড়িতে যাইনি আমি। টেলিফোনও করিনি।
আমি তো ভেবেই ছিলাম এখন না হোক, অশোভন একটা কিছু ঘটবেই।
খবর পেয়েছিলাম, কদিন ধরে নিজের ঘরে ধুম হয়ে বসে থাকে খোকন। কারো সাথে কথা বলে না। কি যেন ভাবে।
বড়পা ফোন করে বলেছিলেন-
: তুই একবার আয় চিনি। খোকনকে নিয়ে বড় ভাবনায় পড়েছি।
বড়পা ভাবনায় পড়েছেন খোকনের এই বদলে যাবার ইতিহাস না জেনেই। আর আমি?
আমি ভাবনায় পড়েছি সব জেনে, খোকনের ক্ষয়ে যাওয়া তরুন্যের মুখোমুখি কিভাবে দাঁড়াবো তাই ভেবে।
আমি বুঝতে পারছিলাম নীপা নামের সেই মেয়েটি খোকনের সম্ভাবনাময় তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্যকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেছে।
দেহ-মন দুদিক দিয়েই খোকন রিক্ত-নিঃস্ব।
বড়পাকে উত্তরে আসব বলে ছাদের চিলে কোঠায় এসে ভীষণ কাঁদলাম।
অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে একা একা ঘুরে বেড়ালাম।
বারবার চোখ দু’টো ভিজে আসছিল। মনে মনে কঠিন হতে চেষ্টা করছিলাম।
ঠিক করলাম-
কাল খুব ভোরেই যেতে হবে খোকনের কাছে।
ওকে নতুন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখাতে হবে।
বলতে হবে-
জীবনকে গড়বার জন্যে সংঘাতময় ঘটনার প্রয়োজন আছে বৈকি!
জীবন মানেই উত্থান-পতন। জীবন মানেই সংগ্রাম। জীবন মানেই..।
অসহ্য যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল মাথাটা।
ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। খোকনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
কাঁচা সোনার রঙের সেই মুখ, মাথা ভর্তি একরাশ এলো মেলো চুল। ঘনকালো দু’টো আয়ত চোখ-ঈষৎ ম্লান।
গলায় দুলছে মায়ের দেয়া সেই সোনার চেনটা। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
জেগে উঠলাম খুব ভোরে। তখনো দরজা খোলা হয়নি। বাসি মুখ ধোয়া হয়নি!
এমনি সময় এলো দুঃসংবাদটা। আমি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলুম।
খোকনকে আমার আর কিছু বলা হলো না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।