Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

হিন্দুদের পবিত্রতম নদী গঙ্গায় উপচে পড়ছে লাশ, মাছ নিয়েও আতঙ্ক

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০২১, ৬:৪৩ পিএম

ভারতের পবিত্রতম নদী গঙ্গায় যেন গত কিছুদিন ধরে লাশ উপচে পড়ছে। শত শত লাশ গঙ্গার স্রোতে ভেসে এসেছে অথবা এর তীরে বালিতে চাপা দেয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। উত্তর প্রদেশের যেসব জায়গায় নদী তীরে এই দৃশ্য দেখা গেছে, সেখানকার মানুষের ধারণা এগুলো কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া মানুষের লাশ।

বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে করোনায় মৃতদের দেহ গঙ্গা দিয়ে ভেসে মালদহের মানিকচক ঘাটে আসতে পারে। এই নিয়ে মালদা সহ সমগ্র রাজ্যে জোর আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। আর তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। বলা যায়, ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছে মানিকচক সহ সমগ্র মালদা জেলার মাছ ব্যবসায়ীদের।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারত প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভারতে এ পর্যন্ত আড়াই কোটি মানুষের সংক্রমণ ধরা পড়েছে এবং মারা গেছে ২ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে এই ভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আসলে এর কয়েকগুণ বেশি। নদী তীরে খুঁজে পাওয়া মৃতদেহ, দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জ্বলতে থাকা চিতাগুলো এবং শ্মশানগুলোতে জায়গার অভাব- এসব কিছু থেকে ভারতে মোট মৃত্যুর এমন একটি সংখ্যার আভাস পাওয়া যায় যেটি সরকারী পরিসংখ্যানে স্বীকার করা হচ্ছে না।

বিবিসি উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে বেশি সংকটজনক অবস্থা যেসব জেলায়, সেখানকার স্থানীয় রিপোর্টার, সরকারী কর্মকর্তা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছে। গঙ্গায় ভেসে আসা এসব লাশের পেছনে লুকিয়ে আছে সনাতনী বিশ্বাস, দারিদ্র আর এমন এক ভয়ংকর মহামারীর গল্প- যা এখন বিদ্যুৎ গতিতে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। চাউসা গ্রামটি বাক্সার জেলায়, সেখানকার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট নীরাজ কুমার সিং বিবিসিকে বলেন, পচে যাওয়া এসব লাশের ময়না তদন্ত করা হয়েছে, এগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এরপর নদী তীরের গর্তে এগুলো কবর দেয়া হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, নদীতীরে লাশ দাহ করার পর যেসব দেহ খণ্ড পড়ে ছিল, সেগুলোই হয়তো নদীতে ভেসে গিয়েছিল, কিছু দেহাবশেষ হয়তো এরকম কিছু। তবে তাদের সন্দেহ লাশগুলো হয়তো নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এরকম ভেসে আসা আরও লাশ আটকানোর জন্য পুলিশ নদীতে একটি জালও পেতেছে। এর একদিন পর, চাউসা গ্রাম হতে ছয় মাইল দূরে উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলার গাহমার গ্রামের কাছে নদী তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায় একেবারে পচে যাওয়া কয়েক ডজন বিকৃত লাশ। বেওয়ারিশ কুকুর এবং কাকের খাদ্য হয়ে উঠেছিল এসব মৃতদেহ।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কয়েকদিন ধরেই নদী তীরে এরকম লাশ ভেসে আসছিল, এখান থেকে যে পচা গন্ধ ছড়াচ্ছিল সেটির ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অভিযোগ আমলে নেননি। এরপর যখন গঙ্গার ভাটিতে বিহারে অনেক লাশ পাওয়ার খবর সংবাদ শিরোনাম হলো, তখনই কেবল কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসলো। পাশের জেলা বালিয়াতেও ঘটলো একই ঘটনা। সেখানে গ্রামবাসীরা যখন গঙ্গায় সকালে স্নান করতে গেলেন, তখন দেখলেন ডজন ডজন পচে ফুলে ওঠা লাশ নদীতে ভাসছে। ভারতের হিন্দুস্থান পত্রিকার খবর অনুযায়ী পুলিশ ৬২টি লাশ উদ্ধার করে।

কান্নাউজ, কানপুর, উন্নাও এবং প্রয়াগরাজে নদীর তটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু অগভীর কবর। কান্নাউজের মেহন্দি ঘাটের তীর থেকে বিবিসির কাছে পাঠানো এক ভিডিওতে দেখা যায়, মানুষের শরীরের আকৃতির সমান বহু ঢিবি। অনেকগুলো দেখতে নদীর চড়ায় ফুলে উঠা কিছুর মতো, কিন্তু এগুলোর প্রতিটিতেই লুকিয়ে আছে একটি করে মৃতদেহ। কাছের মাহদেভি ঘাটে অন্তত ৫০টি দেহ খুঁজে পাওয়া গেছে।

ভারতে হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে সাধারণত মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘জল প্রবাহ’ বলে একটি রীতিও প্রচলিত। শিশু, অবিবাহিত মেয়ে কিংবা সংক্রামক রোগে বা সাপের কামড়ে মারা যাওয়া কোন ব্যক্তির লাশ নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় এই রীতিতে। অনেক দরিদ্র পরিবার লাশ দাহ করার আর্থিক সামর্থ্য রাখে না। কাজেই তারা প্রিয়জনের দেহ সাদা মসলিন কাপড়ে মুড়ে নদীতে ফেলে দেয়। অনেক সময় লাশের সঙ্গে পাথর বেঁধে দেয়া হয় যাতে এটি পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু অনেক লাশ এমনিতেই পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। স্বাভাবিক সময়েও গঙ্গায় লাশ ভেসে আসার ঘটনা বিরল কোন দৃশ্য নয়।

তবে যেটা বিরল, তা হলো এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি সংখ্যায় লাশ ভেসে আসার ঘটনা। কানপুরের একজন সাংবাদিক বিবিসিকে জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ এ মৃতের সরকারি সংখ্যার সঙ্গে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যায়ে একটা বিরাট গরমিল আছে, এসব মৃতদেহ তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, সরকারি হিসেবে কানপুরে ১৬ এপ্রিল হতে ৫ মে পর্যন্ত ১৯৬ জন মারা গেছে, কিন্তু সাতটি ক্রিমেটোরিয়ামের হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে, সেখানে ৮ হাজার লাশ দাহ করা হয়েছে।

প্রয়াগরাজের একজন সাংবাদিক বলেন, তার বিশ্বাস বেশিরভাগ লাশ সেরকম মানুষের, যারা ঘরে কোভিড-১৯ এ মারা গেছেন কোন রকমের পরীক্ষা ছাড়া, অথবা যারা গরীব, লাশ দাহ করার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। ‘এটা খুবই হৃদয়বিদারক’, বলছেন তিনি। ‘এরা কারও সন্তান, কন্যা, ভাই, বাবা কিংবা মা। মৃত্যুর পর এতটুকু শ্রদ্ধা অন্তত তাদের প্রাপ্য। কিন্তু তারা মৃত্যুর পরিসংখ্যানে পর্যন্ত জায়গা পাননি। তারা অজ্ঞাতসারে মারা গেছেন, তাদের লাশ চাপাও দেয়া হয়েছেন অজ্ঞাতসারে।’ নদী তীরে এসব কবর এবং তার মধ্যে পচা লাশ যখন খুঁজে পাওয়া গেল, সেটা যেন নদী বরাবর গ্রামগুলোতে বিরাট আতংক ছড়িয়ে দিল। কারণ তাদের আশংকা এসব লাশ থেকে হয়তো তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে।

গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয়ে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর একটি। হিন্দুদের কাছে এই নদী খুবই পবিত্র। তাদের বিশ্বাস এই নদীর পানিতে স্নান করলে তাদের পাপ ধুয়ে যায়। এই নদীর পানি তারা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্যও ব্যবহার করে। কান্নাউজের ৬৩ বছর বয়সী জগমোহন তিওয়ারি স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলকে বলেন, তিনি নদীর চড়ায় দেড়শ-দুশো কবর দেখেছেন। ‘সকাল সাতটা হতে রাত এগারোটা পর্যন্ত সেখানে কবর দেয়া হচ্ছিল। এটা ছিল হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো একটা দৃশ্য।’ এসব কবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজনের ভয় ছিল, নদী তীরে কোনরকমে মাটি চাপা দেয়া এসব লাশ যখন বৃষ্টি হবে বা নদীর পানি বাড়বে, তখন স্রোতে ভেসে যাবে।

গত বুধবার রাজ্য সরকার এরকম ‘জল প্রবাহ’ নিষিদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে যেসব গরীব পরিবার লাশ দাহ করার সামর্থ্য রাখে না, তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। অনেক জায়গাতেই পুলিশ নদী হতে লাঠি দিয়ে লাশ টেনে তুলছিল এবং নদীতে মাঝিদের সাহায্য নিয়ে এসব লাশ তীরে টেনে আনছিল। সেখানে এসব লাশ খাদে ফেলে কবর দেয়া হয় অথবা চিতায় তুলে দাহ করা হয়। বালিয়া জেলার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ভিপিন টাডা বলেন, তারা গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন যেন নদীতে লাশ ভাসিয়ে না দেয়ার জন্য তাদের সচেতন করা যায়। যাদের লাশ দাহ করার সামর্থ্য নেই, তারা যেন আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করে।

গাজিপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মঙ্গলা প্রসাদ সিং বিবিসিকে বলেন, পুলিশের দল এখন নদীতীরে এবং শ্মশানঘাটে টহল দিচ্ছে। যাতে কেউ নদীতে লাশ ফেলতে না পারে বা নদীতীরে কবর দিতে না পারে। কিন্তু তার দল এখনো প্রতিদিন নদীতে দুই একটা লাশ খুঁজে পাচ্ছেন। আমরা তাদের শেষকৃত্য পালন করছি, রীতি অনুযায়ী যেভাবে করার কথা, বলছেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে খবর, এই লাশগুলো গঙ্গানদী দিয়ে মানিকচকে ভেসে আসতে পারে বলে আশঙ্কিত রাজ্যবাসী। খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মানিকচক সহ সমগ্র মালদা জেলার মাছ ব্যবসায়ীদের উপর। জেলাবাসীর আশঙ্কা, গঙ্গার পানি দূষিত হয়ে গিয়েছে। ওই নদীর মাছ খেলে রোগ হবে। করোনা সংক্রমণও হতে পারে। আর এই আতঙ্কে মাছ বাজারে কমেছে ভিড়। করোনা সংক্রমণের ভয়ে মাছ খাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। ফলে মাছ ব্যবসায়ীরাও আর গঙ্গার মাছ বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে মাছ মজুত করেছেন, তাদের মাথায় হাত পড়েছে। কেননা মাছের ক্রেতাদের দেখা নেই। মানিকচক থেকে মালঞ্চ বাজার- সর্বত্র একই ছবি। সূত্র: বিবিসি, টিওআই।



 

Show all comments
  • Sayeedul ২১ মে, ২০২১, ২:৫২ এএম says : 0
    ............ra Koronar bodole masjid vangate besto. Allahor gozob to matro shuru.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ