Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে আমলার পদায়ন কতটা যৌক্তিক

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

অবশেষে আশংকাগুলো সত্যি প্রমাণ হতে শুরু করেছে। গত সেপ্টেম্বরে যখন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার শেখ রেজাউল করিমকে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন অনেকেই এতে ভবিষ্যতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ডেপুটেশনে আমলাদের পদায়নের সংকেত খুঁজে পাচ্ছিলেন। একারণে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কিন্তু, মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের এই ক্ষোভ-বিক্ষোভকে নীতিনির্ধারক মহল খুব একটা গুরুত্ব সহকারে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। এর প্রমাণ, গত ৬ মে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের পিআরএল ভোগরত অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানকে জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দান।

স্বভাবতই, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারেননি। ইতোমধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনসহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এ নিয়োগের প্রতিবাদ জানিয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষক সমাজের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। প্রশ্ন হল, এটা কি নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত কিছু লোকের খাম-খেয়ালিপনা, নাকি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে একটি মৌলিক পরিবর্তনের আভাস? এটা কি কেবলই শিক্ষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পারফরম্যান্সের উপর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে? এ ধরণের পলিসি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও অনুসৃত নীতির সাথেও বা কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ?
একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে উচ্চাঙ্গের দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। এর পাশাপাশি যে গুরু দায়িত্বটি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ পালন করে থাকে, তা হল গবেষণার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন পরিমন্ডলে বিদ্যমান সমস্যাদি চিহ্নিত করে এসবের কারণ নির্ণয় ও সমাধান নির্দেশ করা। ধর্ম, বিজ্ঞান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি তথা মানব জীবনের সকল দিক ও আঙ্গিক নিয়ে এখানে সুসংবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা পরিচালিত হয়। এভাবে নিত্য-নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হয়, সমাজ ও সভ্যতা সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা পায়। বিশ্ব সভ্যতা আজ যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তাতে দেশে দেশে গড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহই মূল ভূমিকা রেখেছে। আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, যে সব দেশ আজকের বিশ্বে উন্নতির শিখরে অবস্থান করছে, তাদের এগিয়ে নিতে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও প্রযুক্তি।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের এই বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন লেভেলে একদল লোককে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে বিভাগীয় প্রধান, অনুষদ পর্যায়ে ডীন এবং সবার উপরে উপাচার্য মহোদয় এবং এক বা একাধিক সহ-উপাচার্য। আর্থিক বিষয়াদি দেখ-ভালে উপাচার্য মহোদয়কে সহযোগিতা করতে একজন কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ পেয়ে থাকেন। হোস্টেলগুলো পরিচালনার কাজ করেন প্রাধ্যক্ষগণ। এছাড়া, সিন্ডিকেট, সিনেট ও শিক্ষা পর্ষদ সহ বেশ কিছু বডি সামগ্রিক কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধনে নিজ নিজ জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করে। পুরো বিষয়টিতে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকেন শিক্ষক সমাজ, তবে তাঁদের পাশাপাশি দাপ্তরিক ও করণিক সহযোগিতা দেয়ার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি দল নিয়োজিত থাকেন। এ দিকটার সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার।

দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগের কারণে আমাদের দেশে বরাবর সরকারি চাকুরির বিশেষ কদর আছে। একটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের জনগণের প্রতি যে দায়িত্ব, তা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্যে একটি অভিজ্ঞ ও দক্ষ আমলাতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই। আমলারা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন, তা দেশের জন্য সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনে। কেউ যদি সৎভাবে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন, তাহলে আর্থিক মানদন্ডে সিভিল সার্ভিস তার কাছে একটি আকর্ষণীয় অপশন হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। কিন্তু, এখানে দেশ ও জাতিকে সেবা দেয়ার যে অনন্য সুযোগ রয়েছে এবং সমাজের সর্বস্তরে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বিশেষ সম্মান ও সমীহ পেয়ে থাকেন, তার প্রেক্ষিতে এ দেশে তরুণ-যুবাদের একটি বড় অংশ পড়াশোনা শেষে সিভিলে সার্ভিসকেই তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করে।

একটি তীব্র প্রতিন্দ্বিতাপূর্ণ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে দেশের সিভিলে সার্ভিসে সুযোগ পেতে হয়। ধাপে ধাপে কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এক একজন প্রার্থীকে চূড়ান্ত পর্যায়ে মনোনীত করা হয়। ভবিষ্যতে যাদের উপর দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হতে যাচ্ছে, তাদের এভাবে ছেঁকে বের করে আনা হবে, এটাই স্বাভাবিক নয় কি? চাকরিতে যোগদানের পরেও বিভিন্ন ফিল্ড অ্যাসাইনমেন্টের পাশাপাশি নানাবিধ প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে তাঁদের উপরের দিকে উঠতে হয়। প্রতিটি পদে পদে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার গন্ডিতে আবদ্ধ থেকে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। ফলে, একজন সিভিলে সার্ভেন্ট যখন তাঁর ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হন, তখন কর্মজীবনের সুদীর্ঘ পরিক্রমায় নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা তাঁরা অর্জন করেন, এক অর্থে তা অতূলনীয়।

একারণে এদেশে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন আধা-সরকারি/ স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে নিয়োগের রেয়াজ রয়েছে। তাঁদের সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অর্জিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাঁদের এ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজে আসতে পারে? আজকের এ ক্রান্তিলগ্নে নির্মোহভাবে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে খামখেয়ালিপনা কিংবা এক্সপেরিমেন্টেশনের সুযোগ নেই। দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনসমূহ এমনিতেই শতবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে খেয়ালের বশে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নন এমন ব্যক্তিদের এনে বসালে এটি আদৌ কোন উপকার বয়ে আনবে কিনা, নাকি নতুনতর উপসর্গ যোগ করে একটি হযবরল অবস্থা তৈরি করে দেশের উচ্চ শিক্ষার বারটা বাজিয়ে ছাড়বে তা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগদানের পর বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে একজন শিক্ষক যখন অধ্যাপকের পদে উন্নীত হন, তখন এ দীর্ঘ পরিক্রমায় পঠন-পাঠন, গবেষণাকর্ম, শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যা, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সহ উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন আঙ্গিকের নাড়ি-নক্ষত্রের সাথে তাঁর যে পরিচিতি ঘটে, তাঁর মধ্যে যে সামগ্রিক বোধ জন্মে, তা প্রত্যক্ষভাবে এ কর্ম-পরিক্রমার মধ্য দিয়ে না গেলে কিছুতেই অর্জিত হতে পারে না। কেউ হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন, হতে পারে দেশ বা দেশের বাইরের কোনো নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি পিএইচডি ডিগ্রিও হাসিল করেছেন, কিন্তু যতক্ষণ না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে একটি দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাচ্ছেন, তখন তিনি আসলে মুদ্রার একটি পিঠই কেবল দেখেছেন। অন্য পিঠ সম্পর্কে পুরোটাই অন্ধকারে আছেন। আমাদের দেশে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ও, মুক্ত চিন্তা ও মননের পাদপীঠ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পরষ্পরের মধ্যে, ছাত্রদের সাথে এবং বাইরের জগতের সাথে যে ধরণের স্বাধীন ও উন্মুক্ত মিথস্ক্রিয়া ঘটে, সিভিলে সার্ভিসে সে ধরণের কালচার প্র্যাকটিস হয়ে থাকে কি?

সুতরাং, একজন উচ্চপদস্থ সিভিল সার্ভেন্টের দীর্ঘ কর্মপরিক্রমায় অর্জিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অবশ্যই দেশ ও জাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ। তবে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার প্রশ্নে এটা কোন গুরুত্ব বহন করে না। ভাইস চ্যান্সেলর কিংবা প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর মতো পদের জন্য তো নয়ই, এমনকি ট্রেজারার পদের জন্যও নয়। কারণ, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন খাতে কি পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়ি-নক্ষত্রের সাথে যার পরিচয় নেই তিনি তা কি করে বুঝবেন? এটা স্রেফ বই-খাতা নিয়ে বশে অংক কষা বা হিসাব মিলানোর বিষয় নয়।

দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন, অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে যেন মুক্ত মনন ও পান্ডিত্যের চর্চা হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর দেয়া এ উপহারের কতটুকু সদ্ব্যবহার বা অপব্যবহার করেছি তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু আমরা যদি চাই উচ্চ শিক্ষাঙ্গন দেশ ও জাতির প্রয়োজনে যথার্থ ভূমিকা রাখুক, তাহলে ওটাই একমাত্র ও সঠিক পথ। সব অর্গল খুলে দিতে হবে। বিশ্ব আঙ্গিকে বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চার জন্য মুক্ত বাতায়ন অপরিহার্য। এটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়, যার সাথে পুরো জাতির ভাগ্য জড়িত। এটা অ্যাডভেঞ্চারিজমের বিষয় নয়।
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।



 

Show all comments
  • Md. Abdul Matin ১০ মে, ২০২১, ১০:৫৬ এএম says : 0
    Necessity knows no law. In my view, govt has taken a timely and needed decision.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্ববিদ্যালয়


আরও
আরও পড়ুন