পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে হেফাজত ইসলামসহ ইসলামিক দলগুলি প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছে। প্রতিবাদের কারণ হিসাবে প্রতিবাদকারীরা ঘোষণা করেছে যে, (১) মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় অনেক মুসলমানকে হত্যা করেছে, যার জন্য তিনি গুজরাটের কসাই হিসাবেও পরিচিত। (২) সম্প্রতি টি.আর.সি বিধিবিধান করার মাধ্যমে মোদি সরকার ভারত থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং এর প্রতিবাদ করায় অকাতরে ভারতে মুসলমান নিধন হয়েছে। (৩) পবিত্র কোরান শরীফের ২৬টি আয়াত সংশোধন করার জন্য ভারতের একটি হাইকোর্টে রিট হয়েছে, যার আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা ভারত সরকার। সর্বোপরি মোদি একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত। মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ভারত সরকার ও রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেসের যে ভূমিাকা ছিল, অনুরূপ ভ‚মিকা এখনকার বিজেপি পন্থীদের ছিল না। কোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান যদি বাংলাদেশে আগমন করে তবে তা গৌরবের বিষয় বটে, কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আছে, তাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জনগণ সাদর সম্ভাষণ জানাবে কোন কারণে?
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, তবে অসম্প্রদায়িক। মোট জনসংখ্যার ৯২% মানুষ মুসলমান এবং ইসলাম একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। ধর্মীয় বিবেচনায় কারো উপর অত্যাচার নির্যাতন করা বা ধর্মকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনীতে দেখা যায় না। বরং সংখ্যালঘু জনগণ সংখ্যাগুরুদের আমানত হিসাবে তিনি ঘোষণা করেছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাও নির্দেশনা রয়েছে। তবে ধর্মের উপর যদি কোনো আঘাত আসে বা শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে যদি বিনা বিচারে হত্যা করা হয়, সেখানে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ তো করতেই হবে এবং এটাই ধর্মীয় বিধান।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি কটাক্ষ করায় গোটা বিশ্ব প্রতিবাদ করেছে। ফলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং গোটা বিশ্ব তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছে। হেফাজত ইসলাম সহ ইসলামী দলগুলি এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই মোদির ঢাকায় আগমনের প্রতিবাদ করেছে, যারা ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুর ভয়ে বা সরকারি চাকরি হারানোর ভয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারেনি তারাও ঘৃণা পোষণ করেছে। তবে মুসলমান নামধারী, যারা নাস্তিক, তাদের কথা আলাদা।
বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান মোতাবেক, নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ও প্রতিবাদ করার অধিকার রয়েছে। দেখা মতে, মোদির আগমনের বিরুদ্ধে ইসলামী চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই বিশেষভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। গোটা বিশ্বে এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। পৃথিবীর ভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের দাওয়াতী মেহমানকে ‘ফিরে যাও’ পোস্টার, প্লেকার্ড, ব্যানার বিমান বন্দরে বা রেল স্টেশনে প্রতিবাদকারীরা প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিধায় মোদির বাংলাদেশে আগমনের নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার তার নাগরিকের রয়েছে। নতুবা বুঝা যাবে যে, সে দেশের নাগরিক কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও মন মানসিকতার প্রশ্নে বিবেকের স্বাধীনতা এখনো অর্জিত হয়নি।
মোদি বিরোধী অবস্থানের কারণে মুসল্লি-পুলিশ সংঘর্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৯ জন নিহত হয়েছে বলে হেফাজত ইসলাম দাবি করেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ‘ঢাকায় বায়তুল মোকারমের মুসল্লিদের সাথে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ত্রিমুখী সংর্ঘষে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে, আটক করা হয়েছে শতাধিক মুসল্লীকে।’ এ মর্মে পুলিশের সাথে অস্ত্র উঁচিয়ে সাদা পোশাকে সশস্ত্র ব্যক্তিদের একটি সচিত্র প্রতিবেদন জাতীয় দৈনিকে ২৭ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার ভাষ্যমতে, পুলিশের সাথের অস্ত্রধারীরা আওয়ামী ছাত্রলীগ-যুবলীগ। প্রশ্ন হলো, হেফাজত বা অন্য কারো মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্র বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি দলের ক্যাডারদের উপস্থিতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতটুকু যৌক্তিক? মোদির আগমনের বিরোধিতা করে প্রতিবাদকারীদের প্রতিবাদ কর্মসূচী বিনা বাধায় করতে দিলে সরকার কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হতো?
ইতোপূর্বেও সরকারের আমন্ত্রণে মোদি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তখনো প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, মোদি সরকারের সময়কালের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে। মোদি পুনরায় নির্বাচিত হলেও চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেও কয়েক দফা ভারত সফরে গিয়েছেন। প্রতিবারই তিস্তার পানি ছাড়াই তিনি ফেরৎ এসেছেন। এবারও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোদি বলেছেন, ‘তিস্তার পানি দেয়ার জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ’। কিন্তু কবে কখন তিস্তার পানি বাংলাদেশ পাবে, এ সম্পর্কে মোদি কোনো প্রতিশ্রুতি প্রদান করেননি। ওদিকে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন যে, ‘তিস্তার পানি দেওয়া সম্ভব নয়’। অথচ, এ দোটানার মধ্যেই ভারতের স্বার্থ জড়িত চুক্তিগুলি সম্পাদিত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থ সম্বলিত কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে কিনা তা আদৌ জনগণ জানে না। মমতা ব্যানার্জী দাবি করেছেন যে, মোদি তার দলীয় রাজনীতির ফয়দা হাসিলের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছেন। মমতার মতে, বাংলাদেশে গোপালগঞ্জে বসবাসকারী মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশ ভারতের নাগরিক বিধায় ভারতীয় মতুয়াদের সমর্থন লাভের জন্য বাংলাদেশে মোদির আগমন। এ কারণেই মমতা মোদির ভিসা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশে আগমনে মোদি কতটুকু লাভবান তা আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয়টি হচ্ছে, এ সফরে বাংলাদেশের জনগণ কী পেলো?
বিরোধী মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করার জন্য যে স্টিম রোলার সরকার চালাচ্ছে তার হাতিয়ার হিসাবে নগ্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুলিশ, প্রশাসন, আইন ও আদালত। পুলিশ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, যার ফায়দা পুলিশও নিচ্ছে। সরকার অনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার করছে বিধায় পুলিশের একটি অংশ নিজেরাও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। পত্রিকা খুললেই দেখা যায় মাদক, চাঁদাবাজি ও অপহরণমূলক অভিযোগে পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হচ্ছে। অথচ তাদের প্রমোশন হচ্ছে, যাদের আশ্রয়-প্রশয়ে পুলিশ সরকার বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য মিথ্যা মামলা সৃজন, গ্রেফতার, রিমান্ড ও চার্জশিট দেয়ার জন্য পেশাগত যুগান্তকারী কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ভোটে পুকুর চুরি হয়েছে, কিন্তু বর্তমান সরকার আমলে হচ্ছে ভোটার বিহীন ভোট, অর্থাৎ নির্বাচনে সমুদ্র চুরি। পুলিশ বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তারা পুলিশের পেশাদারিত্ব ও পেশার মান বৃদ্ধি করার জন্য প্রায়সই বাহিনীর নিম্নস্থ সদস্যদের নির্দেশাবলী জারিকরা সহ বক্তৃতা করে থাকেন, যা ফলাও করে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, কোথাও জনগণ বাহাবা দেয়, কোথাওবা কথা ও কাজের সমন্বয় কোথায়, তা খোঁজার চেষ্টা করে। আইনগতভাবে পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রধারী ও অস্ত্র ব্যবহারকারীদের গ্রেফতার করা, কিন্তু হেফাজতের ঘটনায় ঘটেছে বিপরীত ধর্মীয় ঘটনা এবং সরকার বিরোধীদের ঠেঙ্গানোর জন্য হরহামেশা পুলিশ এ ধরনের ভূমিকাই গ্রহণ করে থাকে। কার্যত পুলিশ এখন আইনের ঊর্ধ্বে। ২০১৩ সালে পুলিশ কাস্টডিতে নির্যাতন বন্ধ করার জন্য আইন পাশ হয়েছে, কিন্তু সে আইন সম্পূর্ণভাবে এখনো অকার্যকর। পুলিশকে জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য পেশাদারী করার জন্য সরকার দাবি করে এবং এজন্যই নৈতিকতার প্রশ্নে, প্রশ্ন জাগে বায়তুল মোকাররমে অস্ত্র হাতে পুলিশের সাথে এরা কারা?
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।