Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানুষ অজ্ঞান হয় কেন : কারণ এবং করণীয়

| প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২১, ১২:০৮ এএম

দৈনন্দিন জীবনে চেনা জানা কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলো, এমন দেখা কিংবা শোনা, সবার জীবনে কম বেশি থাকে। কখনো ঘরের লোক, বয়সী বাবা মা, কখনো পথচারী কেউ, এমনকি কখনো আমরা নিজেরাও এর শিকার হতে পারি। এমন কাছের কারো অজ্ঞান হওয়ার কথা শুনলে কেউ কেউ নিজেরাই অজ্ঞান হয়ে যায়। অজ্ঞান হওয়া শুনলে একদিকে আমরা যেমন ভীত হয়ে পড়ি, তেমনি অনেক সময় অবহেলাও করি। দুটোর কোনটাই করা উচিত নয়।

দুই কারণে অজ্ঞান হই আমরা :
প্রথমত : শরীরের কোন সাময়িক কারণে, যা গুরুতর কিছু নয়।
দ্বিতীয়ত : শরীরের মধ্যে ঘটছে মারাত্মক কোন সমস্যার চূড়ান্ত লক্ষণ হল এমন ফেইন্ট বা অচেতন হয়ে যাওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় কারণেই মানুষ বেশি অজ্ঞান হয়। এমন পরিস্থিতিতে কি করবেন, তা জানা থাকা আমাদের সবার জন্যে যেমন ভালো, তেমনি এমন পরিস্থিতি কেন হয়, কিভাবে হয়, সেসব জানা থাকলে সতর্ক থাকা সহজ হয়।

যে কোন হসপিটালের ইমারজেন্সিতে গড়ে ১০% রোগী এমন অচেতন বা অজ্ঞান হওয়ার কারণে ভর্তি হয়। অর্থাৎ হসপিটাল রোগীদের প্রতি ১০ জনের একজন এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে হাসপাতালে আসেন।

অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মূল কারণটি ঘটে মস্তিষ্কে। সত্তর কেজি ওজনের একজন মানুষের মস্তিষ্কের ওজন দেড় কেজির বেশি নয়। শরীরের মাত্র দুই ভাগ। প্রতি মিনিটে আমরা ৭ থেকে ৮ লিটার বাতাস গ্রহণ করি এবং ছাড়ি। এই হিসাবে সারা দিনে আমরা প্রায় ১২ হাজার লিটার বাতাস বিনিময় করি।

এই বাতাসের ২০ ভাগ অক্সিজেন, প্রায় দেড় লিটার, যা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করি আমরা। কিন্তু নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় যে বাতাস ছাড়ি, তাতে ১৫ ভাগ অক্সিজেন থাকে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মিনিটে ৫ ভাগ অক্সিজেন শরীরের ভিতর থেকে যায়, যা শরীরের বিভিন্ন কাজে লাগে। এক হিসেবে দেখা গেছে দৈনিক আমাদের ৬০০ লিটার এর মত অক্সিজেন দরকার পড়ে।

যাই হোক, এই অক্সিজেন রক্তের মধ্যে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া এবং কাজে সাহায্য করে। আবার শরীরের এই অক্সিজেনের ২০ ভাগ অর্থাৎ এক পঞ্চমাংশ একাই মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়। যেহেতু মস্তিষ্ক শরীরের মূল কাজগুলো করে, বিশাল পরিমাণের অক্সিজেনের সরবরাহের কোথাও সামান্য ঘাটতি ঘটলেই শরীরের অন্য কোন জায়গায় সমস্যা তাৎক্ষণিক তৈরি না হলেও মস্তিষ্কে তাৎক্ষণিক সমস্যা দেখা দেয়। আর ঠিক এই কারণেই মস্তিষ্কে যথাযথ অক্সিজেনের অভাবে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। মস্তিষ্ক যদি এমন আধা মিনিটের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এর ঘাটতিতে ভোগে, সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতামূলক অংশ হিসেবে মস্তিষ্ক তার সার্কিট বন্ধ করে দেয়। এটাই অচেতন হয়ে যাওয়া। মানুষ সামগ্রিক ভাবে সর্বোচ্চ তিন মিনিট বাতাস ছাড়া থাকতে পারে। তবে মস্তিষ্কে কোনভাবে ৪ মিনিটের অধিক প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন এর ঘাটতি হলে মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শুরুতেই বলেছিলাম দুই ধরনের কারণে এই অচেতন হওয়া ঘটতে পারে।

প্রথমে আসি দৈনন্দিন কোন কারণে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ততটা মারাত্মক নয়। তাৎক্ষণিক ঘটে এবং খুব অল্প সময়ে রিকভারি করে। এটি কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট থাকতে পারে। যেমন কোন একটি খারাপ খবর শুনলেন বেহুঁশ হয়ে পড়া, অনেকেই আছে- রক্ত দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায়, অনেককে দেখা যায় ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ঢুকানোর আগেই সুই দেখেই হুঁশ হারিয়ে ফেলে ভয়ে, এমনকি হঠাৎ করে অতি আনন্দে হাসতে হাসতে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যায়। এমনটা কেন হয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুব স্পষ্ট নয়। তবে কিছু কিছু কারণকে চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করতে পেরেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন হওয়ার পিছনে একটি নার্ভকে দায়ী করা হয়। ভেগাস নার্ভ। ওইসব মুহূর্তগুলোতে এটি মুহূর্তে ব্লাড প্রেশার এবং হার্ট রেট কমিয়ে দেয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রক্রিয়াটিকে বলে ভেসোভেগাল সিনকোপ।

আরেকটি প্রক্রিয়ায় অচেতন হওয়া ঘটে। হঠাৎ করে গ্র্যাভিটির কোন কারণে পায়ে অথবা শরীরের নিচের অংশের রক্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কে না পৌঁছাতে পারলে মস্তিষ্কে তখন অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। কোন একটি জায়াগায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন । চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই প্রক্রিয়াটিকে বলে অর্থস্টাটিক হাইপোটেনশন ।

কখনো কখনো কিছু ওষুধের কারণেও এমন অচেতন যেতে পারে। বিশেষ করে ডাইইউরেটিক জাতীয় ব্লাড প্রেশার মেডিসিন যারা খেয়ে থাকেন, সাময়িক এমন সমস্যায় পড়তে পারেন। কারণ, ওষুধের কারণে হঠাৎ করে ব্লাড প্রেশার ওই পরিমাণ কমে যায়, যা মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও পানিশূন্যতা, থাইরয়েড জাতীয় সমস্যা, পারকিনসন ডিজিজ, এবং এপিলেপসি জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত থাকলে তারা এমন অচেতন হয়ে যেতে পারেন মাঝে মাঝে।

এবার আসি গুরুতর সমস্যাগুলোতে। কোন কারণে অজ্ঞান হয়ে গেলে তার পিছনে কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে - হৃদপিন্ডে কোন গোলযোগ এর প্রধান কারণ। হার্ট ফেইলিউর, হার্ট ব্লক, হার্টের ভাল্বের সমস্যা, ওসব অনেক কারণেই হৃদপিন্ড তার পাম্পিং ক্ষমতা হারালে মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্তের অভাবে অক্সিজেন শূন্যতা দেখা দেয়। হঠাৎ করে কোন কারণে পালপিটেশন বা হার্ট রেট বেড়ে গেল সেটাও মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় পরিমাণ রক্ত সরবরাহ ব্যাঘাত ঘটিয়ে অচেতন করে দিতে পারে।

দ্বিতীয় গুরুতর সমস্যার মধ্যে পড়ে একসাথে অনেক পরিমাণ রক্ত শরীর থেকে কোন কারণে, বিশেষ করে দূর্ঘটনা, কিংবা রক্ত আমাশয় বা অন্য কোন কারণে বের হয়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তের ঘাটতির কারণে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।

খুব গরম পড়লে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন মূলত অধিক পরিমাণ ঘামে পানিশূন্যতা অন্যতম একটি কারণ, এর বাহিরে গরমে শরীরের রক্তবাহী নালীগুলো স্ফীত হয়ে গেলে বেশি পরিমাণ রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে মস্তিষ্কের পরিবর্তে পৌঁছাতে থাকে, এবং তাতে মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্তের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।

এমন অজ্ঞান হয়ে গেলে কি করবেন ঃ
যেহেতু অচেতন হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হল মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহের ঘাটতি, কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে, এমন কিছু করা উচিত যাতে মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহের ঘাটতিটুকু কমতে পারে। এতে স্থায়ী সমস্যার সমাধান না হলেও তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধান হতে পারে।

এক. তাকে চিত করে শুইয়ে রাখুন, পায়ের গোড়া ধরে উপর দিকে তুলে রাখুন। গোড়ালীর অংশ নিজের কাঁধে ঠেস দিয়ে রাখুন। এতে শরীরের নিচের দিক থেকে রক্ত সহজ মস্তিষ্কে যেতে পারবে।

দুই. শরীরের কাপড় চোপড় ঢিলা করে দিন, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে কিনা লক্ষ্য করুন। সহজে বাতাস যাতে নিতে পারে ঘরের জানলা দরজা খুলে দিন।

তিন. যদি তাৎক্ষণিক কয়েক মিনিটের মধ্যে জ্ঞান না ফিরে, ইমারজেন্সি নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান।
ডাক্তার বা এম্বুলেন্স আসার আগে যদি কারো জানা থাকে পালস দেখার চেষ্টা করুন, এমন অচেতন হয়ে গেলে পালস রেট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যায়, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়, মাথা উঠিয়ে বসার চেষ্টা করেও বারবার পড়ে যায়, কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে শরীর ঘামায়।

যেকোনো পরিস্থিতিতেই হোক, এমন ফেইন্ট বা অচেতন বা অজ্ঞান হয়ে গিয়ে তাৎক্ষণিক সুস্থ হয়ে উঠলেও পরবর্তীতে এ নিয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন, যাতে তিনি এর কোন কারণ খুঁজে বের করে স্থায়ী চিকিৎসা করতে পারেন।

ডা. অপূর্ব চৌধুরী
ইমেইল: [email protected]



 

Show all comments
  • Emu ৬ নভেম্বর, ২০২২, ১২:২০ এএম says : 0
    ঘুমের মধ্যে নয় তবে চোখে ঘুমঘুম ভাব এমন সময় কি অজ্ঞান হয় কখনও?
    Total Reply(0) Reply
  • Emu ৬ নভেম্বর, ২০২২, ১২:২০ এএম says : 0
    ঘুমের মধ্যে নয় তবে চোখে ঘুমঘুম ভাব এমন সময় কি অজ্ঞান হয় কখনও?
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ এমদাদুল হক ২৬ মার্চ, ২০২১, ৯:৫৯ এএম says : 0
    ধন্যবাদ স্যার এমন সুন্দর একটি লেখা আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে এমন স্বাস্থ্য মুলক উপদেশ আমাদেরকে দিবেন যাতে এ থেকে সবাই জ্ঞান অর্জন করতে পারে ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ এমদাদুল হক ২৬ মার্চ, ২০২১, ১০:০০ এএম says : 0
    অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ মোজাম্মেল ২৯ মার্চ, ২০২১, ১১:৫৭ এএম says : 0
    জাঝাআল্লাখাইরান
    Total Reply(0) Reply
  • বিশ্বজিত কুমার ১০ জুন, ২০২২, ৮:৫৮ পিএম says : 0
    হঠাৎ করে অামার স্ত্রী অঞ্জান হয়ে যে কোন জায়গায় পড়ে যায় পরে ঞ্জান ফিরলে কিছুই বলতে পারে না। এজন্য এক ডাক্তার কে দেখিয়েছি তিনি টেকরোটল সিঅার দিছে দিনে ২ টা করে খেতে হবে ২০০ পাওয়ার।তবুও মাছে মাঝে হয়।তবে গরমের সময় বেশি হয়। এখন কি করব বুঝতে পারছি না কোন উপদেশ থাকলে জানাবেন দয়া করে।এছাও কি অন্য কোন ঊষধ খেতে হবে জানাবেন দয়া করে।
    Total Reply(0) Reply
  • MD.MASUM MIAH ১১ জুলাই, ২০২২, ২:১৪ পিএম says : 0
    আমি ফোন টিপ্তেছিলাম,পানি খাওয়ার জন্য একটু উঠেছিলাম,কিন্তু হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে জাই,এর কারণ জানি না
    Total Reply(0) Reply
  • ALOMGIR HUSSEN ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১০:১৩ পিএম says : 0
    আমি যখন কোনো টেনিং করায় বা পেজেনটেশন দেই তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পরি, এখন আমি কি করতে পারি? দোয়া করে সাহায্য করবেন, প্লিজ, আমি অনেক লজ্জায় পরি সবার সামনে,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মানুষ

২৭ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন