পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও দেশবাসী মুখামুখী অবস্থানে। এ অবস্থা সৃষ্টি করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। গত ১ ফ্রেব্রুয়ারি প্রত্যুষে ক্ষমতা দখল করেছে সেনা জান্তা। এ দিন নতুন পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল।নব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনেকেই পার্লামেন্ট ভবনের কমপ্লেক্সে এসে ছিলেন।কিন্তু সেনারা ক্ষমতা দখল করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেছে। সেনা অভ্যুত্থানের নায়ক সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইং। তিনি বলেছেন, ‘সুচির সরকারকে উৎখাত করা এবং দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো অনিবার্য ছিল ।কারণ,গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে’।সেনা অভ্যুত্থানের পর সেনাপ্রধান স্টেট লিডার হয়েছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনারেল(অব:) উ মিন্ট স্যুকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে।এছাড়া, স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে, যারা মন্ত্রীদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান হবে। সামরিক বাহিনীর ঘোষিত রোডম্যাপে বলা হয়েছে,’দেশে জরুরি অবস্থার মেয়াদ শেষে নতুন করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় জরুরি অবস্থা চলাকালে মিয়ানমার ফেডারেল নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানো হবে এবং গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। একই সাথে, করোনা মহামারি মোকাবিলায় এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ অব্যাহত রাখা হবে’। সেনা অভ্যুত্থানের পর সরকারি বেতার-টিভি, যানবাহন, ব্যাংক, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইয়াঙ্গুন বিমান বন্দর ও আকাশপথ ইত্যাদি বন্ধ এবং সুচি সরকারের ২৪ জন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নতুন ১১ জন মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা। কয়েকজন ইউএসডিপির সদস্যও রয়েছেন। স্টেট কাউন্সিলের অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উয়িন মিন্টকে আটক এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।এছাড়া, এনএলডির অনেক শীর্ষ নেতা এবং রাজ্য ও অঞ্চলের অনেক মন্ত্রীকে আটক করা হয়েছে।
সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সুচি প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন। এনএলডির ফেসবুকে সুচি ও প্রেসিডেন্টসহ অন্য নেতাদের মুক্তি দাবি করে বলা হয়েছে, আমরা একে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি কালো দাগ হিসেবে দেখছি। একই সাথে নভেম্বরের নির্বাচনের ফলকে স্বীকার করে নেয়ার আহবান জানাচ্ছি।এছাড়া,গত ৪ ফেব্রুয়ারি এনএলডির ৭০ জন সদস্য পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সের একটি ভবনে শপথ নিয়েছেন। বাকী এমপিরাও শপথ নিবেন বলে তারা জানিয়েছেন।উপরন্তু ৩০০ আইনপ্রণেতা এক যৌথ বিবৃতিতে সামরিক সরকারকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন । দেশটির প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছে। দেশের ভেতরেও সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভকারীরা ‘সামরিক স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক, সুচিসহ সব বন্দির মুক্তি চাই’ বলে গগনবিদারী স্লোগান দিচ্ছে। এএফপির খবরে প্রকাশ,গত ৭ ফেব্রুয়ারি ইয়াঙ্গুনে বিক্ষোভে প্রায় এক লাখ মানুষ জড়ো হয়। ২০০৭ সালের ‘স্যাফ্রন রেভ্যুলুশন’-এর পর এত বড় বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি। বিক্ষোভকারীদের কথা-‘যতদিন গণতন্ত্র ফিরে না পাব,ততদিন এই আন্দোলন চালিয়ে যাব’। আন্দোলন দমন করার জন্য সামরিক বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে। কোথাও কোথাও পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়েছে।তবুও দিন যতই যাচ্ছে ততই গ্রেফতার ও নির্যাতনও বাড়ছে। তাই দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে চরম আতংক সৃষ্টি হয়েছে।সর্বাধিক আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীরা।কারণ,তারা স্বাধীনতার পর থেকেই সেনাদের দ্বারা চরম নির্যাতনের শিক্ষার হয়ে আসছে। সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। আরাকানে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ইতোমধ্যে বিদেশি নাগরিক হিসেবে ‘এনভিসি’ কার্ড নিতে চাপ দেওয়া শুরু করেছে সেনারা। তাই বর্তমানে আরাকানে অবস্থানরত ৬ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরম ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশ ত্যাগ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাদের। তাই পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সীমান্ত সীল্ড করে দিয়েছে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।ফলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্য চরম উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গা মুসলমানের দুর্দশা আরো বাড়তে পারে। বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছে, মিয়ানমারের জনগণকে নিয়েই আমাদের চিন্তা। সামরিক অভ্যুত্থানের পর আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মিত্রসহ দেশটির লোকজনের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়টি বিশ্ব পর্যায়েও ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিতে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন । এছাড়া,জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে সব বন্দিকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছা, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করার আহবান জানিয়েছে। সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে বন্দীদের মুক্তি ও গণতন্ত্র বহাল রাখার আহবান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য,যুক্তরাষ্ট্র,ইইউসহ বিভিন্ন দেশ এবং বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ অবরোধের হুমকি দিয়েছে।ভারত উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে। থাইল্যান্ড অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের শান্তি-স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার প্রত্যাশা করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, চীন মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।মিয়ানমার চীনের বন্ধু ও সুপ্রতিবেশী। দেশটির সকল পক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং সংবিধান ও আইনি কাঠামোর আওতায় নিজেদের মতপার্থক্য দূর করতে সচেষ্ট হবে বলে বেইজিং আশা করেছে। আশিয়ানের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই জোট আশা করে জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান রেখে সংলাপের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। জি সেভেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অভ্যূত্থানের নিন্দা জানিয়ে সূচি ও অন্যান্য নেতাদের আটক রাখার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন চীনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জিয়েচির সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় চীনকে মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন। মিয়ানমারের সেনা অভুত্থানের বিষয়টি বিশ্ব মিডিয়ায় হাইলাইট হয়েছে।
মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে দ্বিতীয় ব্যাপক আলোচিত বিষয় হচ্ছে, কেন এই সেনা অভ্যুত্থান? সেনা কর্তৃপক্ষ এই অভ্যুত্থানের জন্য গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির কথা বলেছে।কিন্তু বিশেষজ্ঞ মহল সেটা বিশ্বাস করছেন না।কারণ,উক্ত নির্বাচনে ৯১টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দল অংশগ্রহণ করেছিল।কিন্তু ইউএসডিপি ছাড়া কেউই কারচুপির অভিযোগ তোলেনি।উপরন্তু মিয়ানমারের পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিবল ইলেকশন জানিয়েছিল, ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ছিল’। ইইউ , যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ অনেক দেশ এই নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছিল। কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন বাতিল ও সরকার উৎখাত করায় সেনা কর্তৃপক্ষকেই এখন অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত নির্বাচনে কারচুপি হয়ে থাকলে,তার দায়ভার সামরিক বাহিনীর ঘাড়েও পড়ে। কারণ, সংবিধান মতে, সরকারের অংশীদার সশস্ত্র বাহিনীও।
পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য পার্লামেন্টে যে ভোটের প্রয়োজন,সরকারী দল প্রায় তার কাছাকাছি েেপৗছেছিল।তাই সংবিধান সংশোধন হলে সেনাদের ভোগকৃত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং তাদের জমাকৃত সম্পদের হিসাব দিতে হবে, এমন আশংকা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই এ সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। এছাড়া অনেকের মতে, সুচির সরকার ভারত ও পশ্চিমাদেশগুলোর দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিল।সেটা রোধ করার জন্যই এই সেনা অভ্যুত্থান।
২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে যখন সামরিক বাহিনীর জন্য সংসদের মোট আসনের ২৫% ও মন্ত্রীসভার ৩টি মন্ত্রণালয় (প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রী) সংরক্ষণের বিধান করা হয়,তখন সুচিসহ এনএলডির সব এমপি সংসদে উপস্থিত ছিলেন। তারা এতে কোন আপত্তি করেননি। বরং তাদের সন্মতিতেই সংবিধান সংশোধিত হয়েছিল, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। কিন্তু গত ১০ বছর গণতান্ত্রিক সরকার দেশ শাসন করলেও গণতন্ত্র তেমন বিকশিত হয়নি। সামরিক বাহিনী ও এনএলডির মধ্যে মতপার্থক্য বেড়েছে। রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ করতে ও শরণার্থীদের দেশে ফেরত নিতে না পারা সুচি সরকারের বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা কবুল করে এবং আইসিজিতে সেনাদের পক্ষে বক্তব্য দিয়েও সুচি শেষরক্ষা করতে পারেননি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য কিছু প্রকট সমস্যাও আছে। যার অন্যতম হচ্ছে: ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা ওই অভিযানের সময় গণহত্যা, গণধর্ষণ, ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ঘটেছে বলে অভিযোগ এনেছেন।মিন অং লাইংসহ চারজন সামরিক নেতার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। অপরদিকে,দেশটির গণতন্ত্র প্রত্যাশী মানুষ হত্যা, জেল, জুলুম উপেক্ষা করে অভ্যুত্থান বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তাতে সংখ্যালঘুরাও সংশ্লিষ্ট হতে পারে। অর্থনৈতিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাতে দেশটির মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণ পিছিয়ে যেতে পারে। বস্তুত বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সমঝোতা, সৌহার্দ্য এবং বিভিন্ন সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানই উদ্ভূত পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন নিশ্চিত করতে পারে।
লেখক:সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।