পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমারের সেদিনের সামরিক অভ্যুত্থানে মোটেই অবাক হইনি। ঐ দেশটিতে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হবে এবং সেটি অব্যাহত থাকবে সেটিই বরং সাধারণ চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আসে না। কারণ, যখন অত্যন্ত ছোট ছিলাম, খবরের কাগজ পড়ারও বয়স হয়নি, তখনই গুরুজনদের মুখে শুনতাম দুটি নাম। একটি বার্মা। আরেকটি হলো জেনারেল নে উইন। তখন বগুড়ায় পড়াশোনা করতাম। তারপর কলেজ-ইউনিভার্সিটি শেষ করলাম। তখনও জেনারেল নে উইন বার্মার ক্ষমতায়। ১৯৮১ সালে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। একটানা ২৩ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। বস্তুত: ১৯৫৮ সালেই তিনি ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৬০ সালে নির্বাচন হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী উ নুর নিকট থেকে ১৯৬২ সালে ক্ষমতা কেড়ে নেন জেনারেল নে উইন। ১৯৪৫ সালে জাপানী দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হলেও ১৯৪৮ সালে দেশটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। যথার্থ অর্থে স্বাধীনতার পর ১০ বছর পর্যন্ত দেশটিতে বেসামরিক প্রশাসন ছিল। তারপর থেকেই সেনাশাসন। ১৯৮৭ সালে প্রচন্ড সরকার বিরোধী বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক বাহিনী নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। ফলে ছাত্র সহ হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হয়। শুরু থেকেই দেশটির নাম ছিল বার্মা। রাজধানী রেঙ্গুন। পরবর্তীতে রেঙ্গুন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইয়াঙ্গুন। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সন্নিহিত প্রদেশটির নাম রাখাইন। আগে নাম ছিল আরাকান। মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক ছিলেন অং সান সু চির পিতা অং সান। ১৯৮৯ সালে সেনাবাহিনী অং সানের মেয়ে অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করে। তারাই দেশটির নাম বার্মা থেকে মিয়ানমার করে। সূচী ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৯০ সালে দেশটিতে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে সু চির দল জয়লাভ করে। কিন্তু সেনাবাহিনী সেই ফল উপেক্ষা করে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর থেকে বিরত থাকে।
সু চির রাজনৈতিক দলের নাম ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। মিলিটারী সমর্থিত রাজনৈতিক দলের নাম ইউএসডিপি (ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি)। ২০১২ সাল থেকে দেশটি সামরিক শাসনের কবল থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। ২০১৩ সালে প্রথম বেসরকারি পর্যায়ে ৫ টি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৬২ বছর পর প্রাইভেট সেক্টর দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি পায়। ২০১৫ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সু চির এনএলডি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
মিয়ানমারের সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি বিদেশীকে বিয়ে করলে তিনি রাষ্ট্র প্রধান হতে পারবেন না। সেজন্য সু চি একজন বিদেশিকে বিয়ে করায় প্রেসিডেন্ট না হয়ে তাঁকে স্টেট কাউন্সিলর হতে হয়।
গত বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালের নভেম্বরে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়। মোট ৪১২ টি আসনের মধ্যে সু চির দল এনএলডি পায় ৩৪৬ টি আসন এবং মিলিটারী সমর্থিত ইউএসডিপি পায় মাত্র ৩৩ টি আসন। গত ১ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্ট সদস্যদের শপথ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৩১ জানুয়ারি রাতেই সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। অভিযোগে নির্বাচনে নাকি ব্যাপক কারচুপি হয়েছে।
দুই
জনগণের ভোটের প্রতি বর্মী সেনাবাহিনীর অবজ্ঞা প্রদর্শন এই প্রথম নয়। ১৯৯০ সালেও তারা জনগণের রায়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিল। সেবারও সু চির দল জয়লাভ করেছিল। এখানে একটা কথা বলা দরকার। অং সান সু চির প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমার বা ‘দৈনিক ইনকিলাবের’ কোনো দুর্বলতা নাই। সু চি যখন স্টেট কাউন্সিলর, অর্থাৎ ডি ফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট, তখন তাঁর নাকের ডগার ওপর দিয়ে সে দেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নারকীয় জুলুম করেছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করেছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করেছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর এই ভয়াবহ জুলুমকে সু চি প্রশ্রয় দিয়েছেন। হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে যখন রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে বিচার শুরু হয় তখন সেই আদালতে সামরিক জান্তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সু চি। আরো অবাক ব্যাপার হলো, সেখানে তিনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করেননি। কাজেই একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী হিসাবে সু চির প্রতি বিন্দুমাত্র সমর্থন বা দুর্বলতা থাকার কোনো অবকাশ নাই।
তিন
বার্মার সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ একটি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেতে চেয়েছিল। কিন্তু চীন সেই প্রস্তাব বøক করে দিয়েছে। রাশিয়া মৌন ছিল। সেও সামরিক জান্তাকে ক্ষেপাতে রাজি নয়। ভারত সামরিক জান্তার নিন্দা করেনি। তবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে। চীন দেশটিতে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের আবেদন জানিয়েছেন। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, মিয়ানমারকে নিয়ে ভ‚রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে আমেরিকা, অন্যদিকে চীন। সোজা কথা, চীন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পক্ষে। রুশ মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। ভারতও মোটামুটি সফ্ট।
দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগর ছিল ব্যাক ওয়াটারে। অর্থাৎ কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারও নিজেকে প্রকাশ করেনি। কিন্তু ৯০ দশক থেকে চীন যখন মিয়ানমারকে তার প্রভাব বলয়ে আনতে শুরু করে তখনই বিশ্বের অন্যান্য শক্তি নড়েচড়ে বসে। বিশ্বের বড় শক্তিগুলি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলির কাছে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। নীল পানির সম্পদ অর্থাৎ সাগর তলের এনার্জি সম্পদের সম্ভাবনায় মিয়ানমার প্রস্ফুটিত হতে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগর। কিন্তু মিয়ানমারের তটরেখা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড় এবং বিস্তৃত। তার ওপর চীন এখানে অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। ধারণা করা হয় যে, মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার তলদেশে রয়েছে বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস। অর্থনীতিবিদরা এটিকে বলেছেন ব্লু ওয়াটার ইকোনমি। পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা এবং আধিপত্য নিয়ে জাপানের সাথে চীনের বিরোধ। এই সমুদ্র এলাকার আধিপত্য নিয়ে মাঠে নেমেছে আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাথে নিয়েছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়াকে। এছাড়াও উপক‚লবর্তী ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া- এসব নিয়েও চীনের বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে চাচ্ছে আমেরিকা।
ঠিক এই স্থানে এসে অকস্মাৎ অসাধারণ গুরুত্ব বেড়েছে মিয়ানমারের। উত্তর পূর্ব ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এই দেশটির ভৌগলিক অবস্থান খুব স্পর্শকাতর। মালাক্কা প্রণালী এবং হরমুজ প্রণালীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ায় মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূল তথা বঙ্গোপসাগর দুই মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। একটি হলো ভারত মহাসাগর, অপরটি হলো প্রশান্ত মহাসগর। এছাড়া আঞ্চলিকভাবেও রয়েছে মিয়ানমারের গুরুত্ব। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংযোগ স্থলে অবস্থান মিয়ানমারের। উপকূলের পশ্চিম অংশে রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা। আর পূর্বাঞ্চলে রয়েছে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এমন ভূস্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে বঙ্গোপসাগর এখন বৃহৎ শক্তি সমূহের রাডারে এসেছে।
এই কারণেই চীন এবং ভারত উভয়ই মিয়ানমারকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চায়। বস্তুত আপন আপন প্রভাব বলয়ে রাখার জন্য চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে।
মিয়ানমারের গুরুত্ব বৃদ্ধির ওপরে যেসব কারণ উল্লেখ করা হলো সেই সব কারণ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তার কূটনৈতিক তাস সফলভাবে খেলতে পারেনি। শুধুমাত্র ভারতনির্ভর হওয়ার করণে চীনকে বাংলাদেশ ততখানি আকর্ষণ করতে পারেনি, যতখানি করতে পেরেছে মিয়ানমার। এই গেমে আরেকজন খেলোয়াড় হলো পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা। সেই একই ভূরাজনৈতিক কারণে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব প্রকাশ্যে সামরিক জান্তার বিরোধিতা করছে এবং অং সান সু চির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলছে। আবার সেই একই কারণে চীন সামরিক জান্তাকে সমর্থন করছে। আসলে এটি মর্কিনী ক‚টনীতির ভাষায় একটি ‘গ্রেট বল গেম’। এখানে ন্যায় নীতির কোনো স্থান নাই। একমাত্র নীতি হলো, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।