পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমারে সেনাশাসনের দীর্ঘ পরিক্রমায় বেশ কয়েকবার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দেখা গেলেও সেখানে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব কখনোই খর্ব হয়নি। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, মিয়ানমারের স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি জেনারেল অং সানের কন্যা সুচির গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হলে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মিয়ানমারের নাগরিকরার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদার্পণ করতে সক্ষম হবে। আদতে তা হয়নি। গণতন্ত্রের জন্য দেড় দশক ধরে কারাগারের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ডি-ফ্যাক্টো নেতা হিসেবে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও অং সান সুচি মূলত একজন পাপেট নেতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছেন। স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে তার দুর্বল নেতৃত্ব এবং নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর কমিটমেন্টের অভাবে শুরু থেকেই তার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বের সমস্যা প্রথমে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি অত:পর মিয়ানমারের সেনা শাসকদের সৃষ্ট একটি কৃত্রিম সংকট। নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের আওতায় এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানই ছিল অং সান সুচির কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা। যে গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাকে সামনে রেখে কারাবন্দী অবস্থায় তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল, সে প্রত্যাশা পুরণে তিনি চরমভাবে শুধু ব্যর্থই হননি, তার শাসনামালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালিত হয়েছে। মিয়ানমারে দু:শাসন এবং সাম্প্রদায়িক সামরিক অভিযানের প্রধান ভুক্তভুগী হয়েছে বাংলাদেশ। তবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার হটিয়ে মিয়ানমারে আবারো সেনা শাসনের এই অভ্যুত্থান সমর্থনযোগ্য নয়।
গত নভেম্বরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বড় জয় পায়। এরপর থেকেই সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। সেনাবাহিনী ও সেনাসমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনের পর থেকেই ভোটে কারচুপির অভিযোগ করে আসছিল। গত বৃহস্পতিবার দেশটির নির্বাচন কমিশন এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার চার দিনের মাথায় সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল। বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতা, সামরিক বাহিনীর সাম্প্রদায়িক অভিযান এবং রোহিঙ্গা গণহত্যা এ উপমহাদেশে বড় ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এটি আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কানেক্টিভিটি ও সম্প্রীতির প্রত্যাশাকে চরমভাবে ব্যহত করেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি’র নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নতুন সম্ভাবনার কথাই ভাবা হয়েছিল। চীনা মধ্যস্থতায় যে মুহূর্তে একটি ইতিবাচক অগ্রগতির প্রত্যাশা জেগে উঠেছিল, ঠিক সে মুহূর্তে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং সংবিধান স্থগিত করে জরুরী অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে সে প্রত্যাশা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহŸান এবং চাপ তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারলেও চীন এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটে চীন বরাবর মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করলেও শেষ পর্যন্ত প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতাকারির ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে এসেছে। পক্ষান্তরে ভারত কখনোই বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়নি। অং সান সুচিকে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট দেখা গেছে। ভারতের প্রচ্ছন্ন ইন্ধনে তিনি রোহিঙ্গা নির্যাতন ও বিতারণ বন্ধে উদ্যোগ নেননি। তার আচরণে চরম মুসলমান বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও করেছেন। তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পেলেও তার শাসনামলেই রোহিঙ্গাদের উপর ইতিহাসের বর্বরতম হামলা হয়েছে। এ বর্বরতা বন্ধে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। বরং ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার পক্ষাবলম্বন করেছিলেন।
রোহিঙ্গা সংকটে চীন ও ভারত মিয়ানমারের সাথে যার যার সুবিধাজনক অবস্থান বজায় রেখেছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও দায়সারা ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে অং সান সুচি ও ভারতের নরেন্দ্র মোদির অভিন্ন অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকেও নিজস্ব বাস্তবতার আলোকেই নিজেদের অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অং সান সুচির তথাকথিত গণতন্ত্রের মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক সহাবস্থান ও আইনের শাসন নিশ্চিত হয়নি। সামরিক শাসনে সে প্রত্যাশা আরো দূরে সরে গেল। মিয়ানমার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি ও বানিজ্যিক সম্পর্কের প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা ও সুসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তরফ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। একইভাবে চীন সরকারের প্রাথমিক সতর্ক প্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্রের কথা না বললেও সাংবিধানিক ও আইনী কাঠামোর মধ্যে সব পক্ষের মতভেদ দূর করে সামাজিক-রাজনৈতিক সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়েছে। অং সান সুচির দুর্বল শাসন, তথাকথিত গণতন্ত্রের লেবাস এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি, সামাজিক সম্প্রীতি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুণগত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প সেনাশাসন নয়। মিয়ানমারের মানুষ ভোট দিয়ে যাদেরকে নির্বাচিত করেছে, সেনাবাহিনী সেই ম্যান্ডেটের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং দেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।