পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আবারো গণতন্ত্রের পথ থেকে জাতিকে বিচ্যুত করে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পথ বেছে নিল। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। তবে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর তরফ থেকে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে ঈপ্রসিডেন্ট উ উইন মিন্ট এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে অভিযোগ দায়ের করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছিল সেনাবাহিনী। তখন থেকেই সেখানে আবারো সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। মিয়ানমারে সুদীর্ঘ তিন দশকের সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিয়ানমারের স্বাধীনতার স্থপতি জেনারেল অং সানের কন্যা সু চি গণতন্ত্রের প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৮৯ সালে থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্রের লড়াইয়ে সুচি কে ১৫ বছর কারাবরণ করতে হয়েছিল। বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিপুল সমর্থন ও জনপ্রত্যাশার কারণে সুচি কে মুক্তি দিয়ে ২০১০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল সামরিক সরকার। নির্বাচনে সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তাদের সে আশায় গুঁড়ে বালি নয়, হতাশা মিশে গিয়েছিল। অং সান সুচির দল ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত সহিংসতা পরিকল্পিত গণহত্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, নারীদের ধর্ষণ করা এবং উগ্রবাদী বৌদ্ধদের উস্কে দিয়ে সহিংস রক্তাক্ত দাঙ্গায় শিশু ও যুবকদের নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর এথনিক ক্লিনজিং শুরু করে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসা মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেতা অং সান সুচি উগ্রবাদী বৌদ্ধ ও সামরিক বাহিনীর সেসব বর্বরতা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা ও আহŸান উপেক্ষা করে পরোক্ষ ও মৌন সমর্থন দিয়ে সু চি সেনা বাহিনীর বর্বরতার পক্ষেই কথা বলেছেন। এভাবেই মিয়ানমারের সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্ব গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবিক মর্যাদা ব্যর্থ হয়ে এক নতুন অন্ধকারকেই আবাহন করেছে। বিশ্বসম্প্রদায় আবারো মিয়ানমারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এমনকি গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির প্রতিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন কার্যত প্রত্যাহৃত হয়। বিভিন্ন দেশে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান অং সান সুচিকে দেয়া তাদের সম্মাননা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। এভাবেই মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রীর আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে সামরিক বাহিনী। ২০১০ সালের পর দ্বিতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে সব গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব খর্ব করে গত সোমবার ভোরে ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক বাহিনী।
গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দল সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) অস্বাভাবিক ভরাডুবি সেনাবাহিনী মেনে নিতে পারেনি। গত ১ ফেব্রæয়ারী সোমবার নবগঠিত পার্লামেন্টের প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সোমবার সকালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এনএলডি নেতা সুচি, প্রেসিডেন্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও প্রাদেশিক মন্ত্রীদের গ্রেফতার করেছে। সামরিক বাহিনীর জেনারেল ইউ মিন্ট সুয়েকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আর ক্ষমতার ভার কুক্ষিগত করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল মিং অং হ্লাইং। এক বছরের জন্য সংবিধান স্থগিত ও জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। সব গণমাধ্যমের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্য টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইয়াঙ্গুন-নেই পি দোতে আসলে কি ঘটেছে, বিভিন্ন রাজ্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোতে এ মুহুর্তে কি ঘটছে তার বাস্তব চিত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। নির্বাচনে সেনাসমর্থিত দলের প্রতি ভোটারদের সমর্থন প্রত্যাহার এবং জনগণের রায়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেখানে নির্বতনমূলক সেনা শাসন জারির এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জনগণ কি প্রতিক্রিয়া দেখায় তার উপর নির্ভর করছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যত। দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে সামরিক স্বৈরতন্ত্র চালু থাকলেও একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত জনগণের রায়কে জান্তার বুটের তলায় নিষ্পেষিত করার এই ব্যবস্থা মানিয়ে নেয়া এবার হয়তো খুব কঠিন হতে পারে।
বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও এনএলডি নেতা সুচি’র সন্তানরা বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করায় মিয়ানমারের সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকতে পারেননি। ডি-ফ্যাক্টো নেতা কারাবন্দি অং সান সুচি জনগণকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে রাস্তায় নেমে আসার আহŸান জানিয়েছেন। তবে ইন্টারনেটসহ গণমাধ্যমের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে সেখানকার প্রকৃত অবস্থা জানা হয়তো সম্ভব হবে না। প্রথম দফায় রেডিও টিভির সম্প্রচার বন্ধ রাখা হলেও খুব শীঘ্রই হয়তো এসব মাধ্যম জান্তা সরকারের প্রপাগান্ডা মাধ্যম হয়ে উঠবে। ঔপনিবেশোত্তর স্বাধীন মিয়ানমারের প্রথম বছরেই স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি জেনারেল অংসান আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার সময় তার কন্যা অং সানের বয়স ছিল মাত্র ২ বছর। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি প্রতিশ্রæতিশীল অং সান সুচি সামরিক জান্তার কারাগারে থেকেও জনগণের বিপুল সমর্থন পেয়ে জনগণের নেত্রী হয়ে উঠলেও তার দলের ১০ বছরের শাসনে সেখানে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ন্যূনত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থতা এবং রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনায় নিজের অবস্থান কলুষিত করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা পেয়েও কার্যত ক্ষমতাহীন ও মর্যাদাহীন নেতায় পরিনত হয়েছেন। মিয়ানমারে আবারো রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্ব সম্প্রদায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানালেও গত ১০ বছরের শাসনে অং সান সুচির ব্যর্থতা ও অস্বচ্ছতা না থাকলে এখন গণতন্ত্র হত্যা করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের রাজনীতির পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। এক সময় যে নেত্রী ক্ষমতার বাইরে থেকেও ক্ষমতার অনন্য উদাহরণ হয়েছিলেন এবং কারাবন্দী অবস্থায় নোবেল পুরস্কারের মত সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন, সে নেতার দল এখন পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতাচ্যুত হলো। সবেচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে এখন কি ঘটছে বাকি দুনিয়া তা জানতে পারছে না।
নির্বাচনে জনগণের রায়ই শেষ কথা নয়, সেখানে আরো বেশ কিছু কুশীলব ও ফ্যাক্টর সক্রিয় থাকতে পারে। সেটা নির্বাচনের আগে এবং পরেও ঘটতে পারে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে গণতন্ত্রের নামে যা হচ্ছে তাকে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ অথবা আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের খেলা বলে অভিহিত করা যায়। এ খেলা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির ক্ষেত্রে ঘটে তখন তাকে কর্পোরেট পুঁজিবাদের কুশীলব তথা জায়নবাদী ডিপ-স্টেটের ক্রীড়নকদের খেলা বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এবারের মার্কিন নির্বাচনের পর ফলাফল মেনে নিতে সাবেক প্রেসিডেন্টের অস্বীকৃতি, হোয়াইট হাউজ দখলে রাখা এবং আইনগত সব ফ্রন্টে ব্যর্থ হয়ে চরমপন্থী সমর্থকদের দিয়ে ক্যাপিটলে আক্রমণ করে তছনছ করার ঘটনা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের অভ্যন্তরে থাকা চরমপন্থীদের গণতন্ত্র হরণের ব্যর্থ প্রয়াস। গত বছরের ৩ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে ২০ জানুয়ারী জো বাইডেন-কমলা হ্যারিসের ক্ষমতা গ্রহণের দিন পর্যন্ত এক ধরণের অজানা আশঙ্কা ও টানটান উত্তেজনা ছিল। যদিও মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক মুল্যবোধে সেনাবাহিনী বা পুলিশের আইনের বাইরে গিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের কথা ভাবা যায় না। বর্ণবাদী উগ্র সমর্থকদের উস্কে দিয়ে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরী এবং সাংবিধানিক আইনের ফাঁক-ফোঁকড়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার অপচেষ্টা করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন জনগন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বিরোধী এসব কারসাজিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয়নি, এমন ন্যাক্কারজনক প্রেক্ষাপট তৈরীর জন্য ক্ষমতা হারানোর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিসংশন এবং বিচারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন নির্বাচনের ৪ দিন পরে অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের নির্বাচনে সেনা সমর্থিত ইউএসডিপি’র চরম পরাজয়ের পর থেকেই অনেকটা ট্রাম্পের মত কল্পিত ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। মিয়ানমার জান্তা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের কারসাজির ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিল? তবে সেখানে গণতন্ত্রের বিজয় হলেও মিয়ানমারে সামরিকতন্ত্রের কাছে গণতন্ত্রের পরাজয় ঠেকানো যায়নি। সেখানকার ক্ষমতার দÐ-মুÐের কর্তা যখন সেনাবাহিনী, তখন জনগণের উত্তাল আন্দোলন ছাড়া তার উত্তরণ সম্ভব নয়। মিয়ানমারের দুই ডি-ফ্যাক্টো শক্তি হচ্ছে, একদিকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে অংসান সুচির দল এনএলডি অন্যদিকে সামরিক বাহিনী ও তার পৃষ্ঠপোষক পরাশক্তি চীনা সমর্থন। এই দুই শক্তি জনগণের স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুতি মিয়ানমারকে আবারো হয়তো একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিনত করবে। এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সুবিধার টোপ গিলিয়ে মিয়ানমারকে একটি পরিপূর্ণ ভ্যাসাল স্টেটে পরিনত করতে পারে চীন। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চীনের প্রতি নির্ভরশীলতাই হবে মিয়ানমারের অলঙ্ঘনীয় নিয়তি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিজ নাগরিকদের উপর চরম বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পর এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সামরিক শাসন চলেছে। মূলত ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী উ নো জেনারেল নেউইনকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। নে উইন ১৯৪৯ সালের ১ ফেব্রæয়ারী বার্মায় সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক বাহিনী সময়ে সময়ে পরীক্ষামূলকভাবে সিভিল শাসন ও নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল। সেনা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের প্রথম ১২ বছরের পর ১৯৬২ সালে নেউইনের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসন শুরুর পর থেকেই রোহিঙ্গা সংকট ঘণীভূত হতে শুরু করেছিল। মনে করা হচ্ছিল, সেখানে গণতন্ত্র না থাকায় শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিকরা আইনগত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অং সান সু চির নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বসহ আইনগত সুরক্ষার অধিকার পাবে। মিয়ানমারে বেসামরিক শাসনাধীনে সেনাবাহিনী জাতিগত বিরোধ ও সহিংসতা উস্কে দিতে আরো বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালের ১ ফেব্রæয়ারী মিয়ানমারের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক শাসনক্ষমতা হারিয়েছিল। দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে জনগনের সাথে ইঁদুর-বিড়াল খেলা শেষে এই ১ ফেব্রæয়ারীতে মিয়ানমার আবারো সামরিক শাসনেই ফিরে গেল। মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতা ও রোহিঙ্গা সংকটের প্রধান ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক খেলায় মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সোমবারের সেনা অভ্যুত্থানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। তারা নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং কারারুদ্ধ নেতাদের মুক্তি দাবি করেছে। পক্ষান্তরে মিয়ানমারের উপর সবচেয়ে বড় প্রভাবক চীন নিরপেক্ষতার ভান করে পরোক্ষভাবে কার্যত সেনাবাহিনীকেই সমর্থন দিচ্ছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় সূচিত আলোচনা এবং অগ্রগতির পরবর্তী ধাপে মিয়ানমারের নতুন জান্তা সরকারের ভূমিকা থেকে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে বাংলাদেশকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
জন্মের শুরু থেকেই মিয়ানমারের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে সামরিক বাহিনীর অবস্থান। সামরিক বাহিনীর ইচ্ছায় মাঝে মধ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচন চর্চার কিছু নমুনা দেখা যায়। সেখানে সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের পক্ষপাতও থাকে। তবে গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের সর্বশেষ নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি’র পক্ষে সেনাবাহিনী সরাসরি প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে চাইলে এখন হয়তো সেনা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন হতো না। একইভাবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের সেনাশাসকরা পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনকে সরাসরি প্রভাবিত করলে নির্বাচনের ফলাফল ও বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন রকম হতে পারতো। তারা নির্বাচনকে সরাসরি প্রভাবিত বা হস্তক্ষেপ না করে নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং জনগণের রায়ের প্রতি আস্থা ও সম্মানের স্থানটিকে অক্ষুন্ন রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা যেন তার উৎসেই কলুষিত হয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একপাক্ষিক ও ভোটারবিহিন নির্বাচন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাতের আঁধারে ব্যালটবাক্স বোঝাই করে রাখার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুইবার ক্ষমতায় পুর্নবহালের মধ্য দিয়ে দেশে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী দলীয় সরকারের রেকর্ড হলেও এর ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সিভিল প্রশাসন, আইন পরিষদ. মন্ত্রী পরিষদ ইত্যাদি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই সংবিধানের রক্ষক হিসেবে সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। সেখানে শপথভঙ্গ ও আইনের লঙ্ঘন রাষ্ট্রের ভিত্তি, নাগরিক সমাজের অধিকার ও মর্যাদার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যে অধিকার ও মর্যাদার জন্য লাখো মানুষ যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছিল সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে জনগনের ট্যাক্সের টাকায় কেনা আইনের পোশাক আর অস্ত্র, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠির স্বার্থে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে-গণতন্ত্রের বিপক্ষে ব্যবহার করা মানে জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের মৌলক কমিটমেন্টের বিপক্ষে চলে যাওয়া। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বার বার সে দেশের গণতন্ত্র হরণ করেছে। তারা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিনত করেনি। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এখন কি দেখছি? একের পর এক জাতীয় নির্বাচন এবং হাজার হাজার স্থানীয় নির্বাচনকে লোক দেখানো তামাশায় পরিনত করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকলেও নির্বাচনের ফলাফল সরকার সমর্থিত ব্যক্তিদের পক্ষে অনেকটা আগেই যেন নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ কারণে মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ব্যাপক গণসংযোগ, বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভোটে কোটি কোটি টাকা খরচের খেলায় একটি একপাক্ষিক উৎসবে পরিনত হলেও ভোটার উপস্থিতি টেনেটুনে ২০-২৫ ভাগের বেশি নয়। এভাবেই আমাদের গণতন্ত্র পিছিয়ে পড়ছে। ভোটে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা আর ভোটকে প্রহসনে পরিনত করার মধ্যে কোনটা বেশি নিন্দনীয় এই প্রশ্নের জবাব দিতে বললে আমার জবাব হবে দ্বিতীয়টি। এর জন্য যে বা যারাই দায়ী হোক না কেন, তারা গণতন্ত্র ও জনগণের মূল প্রতিপক্ষ। এ সপ্তাহে দেশের নাগরিক সমাজের নেতারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে রাষ্ট্রপতির কাছে তৃতীয় বারের মত চিঠি পাঠিয়ে আবেদন জানিয়েছেন। তবে বিশিষ্ট্য নাগরিকদের চিঠিতে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ ও নিরাপত্তা, সুশাসন এবং নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা রিকনসিলিয়েশনের প্রয়োজনীয়তার উপর বেশি দেয়ার বদলে নির্বাচন কমিশনের আর্থিক দুর্নীতি-অনিয়মের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাই হচ্ছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।