Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনান্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের যত ক্ষতি করেছেন, অতীতের আর কোনো প্রেসিডেন্ট তত ক্ষতি করেননি। তার চার বছরের কার্যকালে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়েছে। জাতীয় সংহতির ক্ষতি হয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষতি হয়েছে। সরকারের প্রতি গণআস্থার ক্ষতি হয়েছে। অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদার ক্ষতি হয়েছে। মোটাদাগে এগুলোই উল্লেখ করা যায়। এর বাইরেও অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখনো দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি, এমন ক্ষতিও হয়ে থাকতে পারে। এ সাকুল্য ক্ষতি মোকাবিলা করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন ও দুরূহ হয়ে উঠতে পারে।

গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য। দু’শ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো এই গণতন্ত্র বিশ্বে গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ অনুপ্রেরণা হিসাবে বিবেচিত। সহাবস্থানমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যে এই ঐতিহ্যের প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাপিতারা গণতন্ত্রের যে আদর্শ, মূল্যবোধ ও কৃষ্টি নির্দেশ করে যান, সুদীর্ঘকাল ধরে তা অনুসৃত হয়ে আসছে তবে ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়েছে। এ সময়কালে গণতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাস্য অপেক্ষা প্রদর্শিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক ব্যক্তি, গণতন্ত্রের প্রতি যার শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শন করতে দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন, কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাসী একজন মানুষ এবং কর্তৃবাদকে রাজনীতি ও প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার একান্ত প্রয়াসী। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি কর্তৃত্ববাদী একনায়কসুলভ ও বেপরোয়া শাসনের অধীনস্ত করার সর্বোত চেষ্টা চালান। কর্তৃত্ববাদী শাসনের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গন দখল, প্রশাসন কুক্ষিগত করা, সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা; সংবাদমাধ্যম বশীভ‚ত কিংবা বন্ধ করা, বিচার বিভাগ করায়াত্ত করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ সব করার ক্ষেত্রে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না, যদিও পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। না পারার কারণ, পর্যবেক্ষকদের মতে, রাষ্টীয় বা সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী থাকা। তারা মনে করেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে পারলে রাষ্টীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিকরণ বা দলীয়করণের ভয়ঙ্কর শিকারে পরিণত হতো। আর তখন কর্তৃত্ববাদী শাসন কাকে বলে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করতে পারত।

ক্ষমতা ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের খুবই প্রিয়। ক্ষমতা ছাড়তে হবে, তিনি ভাবতে পারতেন না। নির্বাচন না দিয়ে কিংবা নির্বাচন নামীয়, প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সম্ভব হলে তিনি অবশ্যই তা করতেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থায় সে সুযোগ ছিল না। তিনি নির্বাচনে পরাজিত হতে পারেন, এমন আশঙ্কা ছিল বৈকি; কিন্তু পরাজয় মানার মানসিকতা তার একরাবেই ছিল না। যে কোনো ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় টিকে থাকাই ছিল তার লক্ষ্য। নির্বাচন বিতর্কের সময় তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, তিনি তা মেনে নেবেন কি-না। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তিনি দল ফল মানবেন কি-না, তা ফল কি হবে, তার ওপর নির্ভর করছে। গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা থাকলে তিনি এমন জবাব দিতে পারতেন না। বোঝা গিয়েছিল, তিনি পরাজিত হলে ফল মানবেন না।

নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর সত্যি সত্যিই তিনি তা মেনে নিতে নারাজি প্রকাশ করেন। বলতে থাকেন, তিনি এ ফল মানবেন না। ক্ষমতা ধরে রাখতে একের পর এক উপায় খুঁজে বের করে তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, তার ভোট চুরি করা হয়েছে, তিনিই প্রকৃত বিজয়ী- এমন কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন তিনি। বিচার বিভাগের কাছে ধরণা দিয়েও কোনো ফায়দা না পাওয়ায় তিনি সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করেন। ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে যে ভয়ানক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। কিছু হিংসা মানুষ নব্যনাৎসী পতাকা ও ট্রাম্পের সমর্থনে লেখা ব্যানার নিয়ে যা কিছু করেছে, অনেকে বলছেন, সেটা ছিল অভ্যুত্থান প্রয়াস। তারা এও জানিয়েছেন, পুলিশের কিছু সদস্য সন্ত্রাসীদের সহায়তা করলেও সেনাবাহিনী কোনো ভ‚মিকা রাখেনি। এ কারণেই ওই অভ্যুত্থানপ্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কে পাঠিয়েছিলেন সন্ত্রাসীদের? ট্রাম্প ছাড়া আর কে? তিনিই এই অপকর্মটি করেছিলেন। তার উগ্র সমর্থকদের তিনি ক্যাপিটলে যাওয়ার এবং শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্ররোচনা দিয়েছিলেন।

ওইদিন সন্ত্রসীরা যদি সফল হতো এবং অভ্যুত্থান সংঘটিত হতো, তাহলে ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যেতো। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিতে পারতেন না। প্রেসিডেন্ট থাকতেন ট্রাম্প। এই চিত্রটি কল্পনা করতেও যে কারো গা শিউরে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্র একটা বড় ধরনের বিপদ ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। গণতন্ত্রও সুরক্ষা লাভ করেছে। গণতন্ত্র টিকে গেছে। কর্তৃত্ববাদ বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে।

২০১৬ সালের নির্বাচনে যখন প্রথমবারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখনই বুঝা গিয়েছিল, ভুল ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। রাজনীতিভাবে অপরিপক্ব, একগুঁয়ে, গোয়ার, অপরিণামদর্শী ও বর্ণবাদী ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়াটা কম বিস্ময়কর ছিল না। মার্কিন সমাজের বৃহদাংশের মধ্যে শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ সুপ্ত অবস্থায় ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে জাগিয়ে তোলেন। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা তাকে তাদের নায়ক হিসাবে বিবেচনা করে তার পক্ষে একচেটিয়া ভোট প্রদান করে। সে সময় তিনি শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের পক্ষে, কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে, অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এবং তার প্রতিপক্ষ হিলারী ক্লিনটনের বিরুদ্ধে এমন ভাষা প্রয়োগ করেন, যা অতীতে কোনো প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর মুখে শোনা যায়নি। তিনি হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে বলেন, তাকে জেলে পুরে রাখা উচিৎ। অভিবাসীদের বলেন, ধর্ষক ও মাদককারবারি। আর নির্বাচিত হওয়ার পর কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হামলাকারীদের প্রশংসা করেন। তখন ধারণা করা হয়েছিল, তিনি আরো অনেক কিছুই বলতে ও করতে পারেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পাওয়ার পর সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা দেখেছি, তিনি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সব ধরনের সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ বা অভিবাসীদের প্রতি বিরূপ আচরণ প্রদর্শন করেছেন। সাম্য ও ন্যায়বিচারের নীতি লংঘন করেছেন। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের কার্ডটি তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনেও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা কাজে আসেনি। তবে তিনি বিপুলসংখ্যক ভোট পেয়েছেন এবং অতীতে আর কোনো পরাজিত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এত ভোট পাননি। অনেকে মনে করেন, এটাই তাকে ক্ষমতার জন্য বেদিশা ও পাগলপারা করে তোলে। তিনি কান্ডজ্ঞান হারিয়ে চরম স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার পালাবাদল শান্তিপূর্ণ ও ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। রীতিপ্রথা অমান্য করে জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকেন তিনি। অনেকটা নীরবেই হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয়, অভিবাসীদের রাষ্ট্র। সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের মানুষ দেশটিতে আশ্রয় পেয়েছে। তারা নিজেদের আমেরিকান বলেই পরিচয় দিয়েছে। তাদের সম্মিলিত চেষ্টা ও শ্রমে আজকের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তুলনামূলকভাবে শ্বেতাঙ্গরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ট। রাজনৈতিক ও শাসন কর্তৃত্ব মূলত তাদের হাতেই। প্রশাসন, সেনা ও পুলিশে তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, অর্থনীতি, শিক্ষা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সফল ক্ষেত্রেই তাদের অধিপত্য। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও অবস্থানের কারণেই বর্ণ শ্রেষ্ঠত্ববোধও তাদের মধ্যে প্রবল। কিন্তু সংবিধান, আইন, প্রথা ও নীতিনির্দেশ এর প্রকাশকে বাধা দিয়ে রেখেছে। দেশটি একটি উদার গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সহমর্মী দেশ হিসাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষ এক বা ঐক্যবদ্ধ জাতিরূপে গণ্য হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ জাগিয়ে তুলে এই একজাতিত্বের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। তিনি জাতিকে বিভক্ত করেছেন। সাদা ও কালোকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। অভিবাসী আগমন কমিয়ে জাতির শক্তিবৃদ্ধিকে রুখে দিতে চেয়েছেন। অতীতে ঔপনিবেশিক শাসকরা উপনিবেশের জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতো, যেন তাদের শাসন সহজ ও নিরাপদ হয়। তাদের এ নীতি ডিভাইড অ্যান্ড রুল নামে অভিহিত। ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার ক্ষমতা ও শাসন স্থায়ী করার জন্য এই নীতি অনুসরণ করেন। তবে চার বছরের কার্যকালে সাদা-কালোর বিরোধ ও তিক্ততা, সংঘাত ও সহিংসতা এবং অভিবাসীদের প্রতি বৈরিতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে জাতিকে দুর্বল ও অকার্যকর করার এক সর্বনাশা খেলায় মেতেছিলেন তিনি। তাকে ক্ষমতার বাইরে ছুঁড়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এর কৃতিত্ব অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষের।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার অনুগত রিপাবলিকান নেতৃবৃন্দ এবং বর্ণবাদী প্রশাসন, সেনা-পুলিশ, বিচার বিভাগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের লাগাতার চেষ্টা করলেও সাফল্য খুব বেশি আসেনি। সে কারণেই ট্রাম্প ক্ষমতা লিপ্সা চরিতার্থ ও কর্তৃত্বপ্রবণ শাসন কায়েম করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যতটুকু ক্ষতি তিনি এসব ক্ষেত্রে করেছেন তা পূরণ করতে বেশ সময় লাগতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

ক্ষমতার সুখ উপভোগ করার প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার সাঙ্গপাঙ্গ ও প্রশাসকে যতটা মত্ত থাকতে দেখা গেছে, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও আইনিশাসন প্রতিষ্ঠায় ততটাই অবহেলা করতে দেখা গেছে। করোনা মোকাবিলায় শোচনীয় ব্যর্থতা এর একটি উল্লেখযোগ্য নজির। শুরু থেকে এই প্রাণঘাতী মহামারিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অভিমত ও পরামর্শকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এর ফল হিসাবে এ পর্যন্ত বিশ্বে আক্রান্ত ও মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। লাখো লাখো মানুষ এর মধ্যেই মারা গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক কোটি। করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেই নয়, নাগরিকদের দুঃখ-দুর্ভোগ লাঘবে সরকার চরম ব্যর্থ হয়েছে। করোনাকালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায়ও নেই তেমন কোনো সাফল্য। লাখ লাখ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য শ্রমিক-কর্মী বেকার হয়ে নিরাশ হয়ে পড়েছে। সরকারের বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজের কল্যাণে এক সময় অর্থনীতিতে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ শুরু হলে তাতেও ভাটার টান দেখা দিয়েছে। জনগণের সমস্যা-সংকট ও বিপদাপদে সরকারই তো ভরসা। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার বা প্রশাসন জনতাকে ন্যূনতম গুরুত্ব ও পাত্তা দেয়নি। এতে সরকারের প্রতি জনগণের প্রবল আস্থার যে জায়গা ছিল, তা অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সরকারের প্রতি গণআস্থা ফেরানো খুব সহজ হবে না।

যে কোনো বিচারে বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। তার রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে খুব কম দেশই মুক্ত। তার মিত্রের অভাব নেই। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যাতে বিশ্বে দেশটির প্রভাব ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং মিত্রের সংখ্যা কমে যায়। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সউদী আরব প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়ন দেখা দেয়। জলবায়ু চুক্তি ও ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ, জাতিসংঘের সাথে শীতল সম্পর্ক ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ ও ব্যাহত করে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মিত্রদের ক্ষুব্ধ করে। ট্রাম্পের প্রশ্নবিদ্ধ নীতি-নির্দেশিকার কারণে তার ভাবমর্যাদা প্রায় তলানি স্পর্শ করে। এটা পুনরুদ্ধার করা ব্যাপক নীতিগত পরিবর্তন এবং নিজের স্বার্থের সঙ্গে মিত্রদের স্বার্থ দেখার ওপর নির্ভর করবে।

বিশ্বের কোনো কোনো দেশে উগ্র ডানপন্থী, কোনো কোনো দেশে বর্ণবাদী-সম্প্রদায়িক এবং কোনো কোনো দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় আছে। তাদের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি-আদর্শের মিল থাকায় তারাই তার মিত্রে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে ভারতের মোদি সরকার ও ইসরাইলের নেতানিয়াহু সরকারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে মোদি ও নেতানিয়াহু ট্রাম্পের বন্ধুতে পরিণত হন। রাশিয়ার পুতিনের সঙ্গেও তার সখ্যের সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। তিনি যেমন তাদের দ্বারা প্রভাবিত রয়েছেন, তেমনি তার দ্বারাও অনেকে প্রভাবিত হয়েছেন। বিশ্লেষকদের অনেকেরই অভিমত, ট্রাম্পের পরাজয় ও বিদায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তেমন ভালো হয়েছে, বিশ্বের জন্যও তেমনি ভালো হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার অভিষেক ভাষণে ট্রাম্পশাসনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিগুলোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন এবং তা মেরামত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। গণতন্ত্র বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আজ আমেরিকার দিন, আজ গণতন্ত্রের দিন। এটি ইতিহাস ও প্রত্যাশার দিন। মহাসংকট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমেরিকা গড়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের জন্য আমরা আমাদের দিনটি উত্থাপন করব। জনগণ ও জনগণের ইচ্ছাকে শোনা হয়েছে। আমরা আবারো জেনেছি, গণতন্ত্র অতি মূল্যবান। গণতন্ত্র নাজুক অবস্থায় পড়লেও গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে, টিকে রয়েছে।’ বলাবাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র একটা বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য আনন্দসংবাদ। আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে জনগণের ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে ঘৃণা-বিদ্ধেষ, উগ্রবাদ, অরাজকতা, সহিংসতা, বেকারত্ব ও হতাশার বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে জো বাইডেন বলেছেন, ‘এখন ইতিহাসের অন্যতম সংকট ও চ্যালেঞ্জের সময় ঐক্যই হলো এগিয়ে যাওয়ার পথ। এই মুহূর্তকে মোকাবিলা করতে হবে এক যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে। আমরা সেটা করলে পরাজিত হবো না, আমরা এক হলে কখনই ব্যর্থ হয়নি। এখন থেকে নতুন শুরু করতে হবে। একে অন্যকে শুনতে হবে, দেখতে হবে, সম্মান দিতে হবে।’

জো বাইডেন তার ভাষণে রাজনৈতিক উগ্রবাদ, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা এসব মোকাবিলা এবং অবশ্যই পরাজিত করব। এসব চ্যালেঞ্জ জয় করতে বিবেককে ফেরাতে হবে এবং আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে কথার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করা দরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার ও মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক করব। বিশ্বের সঙ্গে আবারও যুক্ত হবো। এটি পরীক্ষার সময়, আমাদের গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হয়েছে। সব কিছুকে পেছনে ফেলে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখব।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়েছে, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ রাজনীতিক জো বাইডেনের ওপর। একজন সজ্জন, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, উদার ও সহৃদয় মানুষ হিসাবে তিনি পরিচিত। তার কাজ হবে ক্ষত ও ক্ষতিগুলো শনাক্ত করা এবং যত দ্রুত সম্ভব দূর করা। ইতোমধ্যেই তিনি জানিয়েছেন, তার প্রথম দায়িত্ব মহামারি ঠেকানো। দ্বিতীয় চেষ্টা হবে, ট্রাম্প দেশের জন্য যে অন্ধকার যুগ সৃষ্টি করেছেন তা থেকে তাকে মুক্ত করা। এর মধ্যেই করোনা মোকাবিলা, অর্থনীতি পুনারুদ্ধার, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা পুনরুদ্বারের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। গোটা বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে একটি উদার, গণতান্ত্রিক, ন্যায়বাদী, মানবিক ও পরোহিতৈষী রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায়। জো বাইডেন কি পারবেন এমন প্রত্যাশা পূরণ করতে?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্র


আরও
আরও পড়ুন