পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জানুয়ারির ২০ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন জো বাইডেন। আপাত দৃষ্টিতে তা স্বাভাবিক মনে হলেও তার এই শপথ নেয়ার বিষয়টি খুব সহজ ছিল না। শপথ নেয়ার আগে নানা শঙ্কা ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যা এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো প্রেসিডেন্টের শপথ নেয়ার ক্ষেত্রে ঘটেনি। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের সামনে করতালিমুখর আনন্দঘন পরিবেশে শপথ নেবেন, এটাই দেশটির ঐতিহ্য। এক্ষেত্রে, ব্যতিক্রম দেখা গেল জো বাইডেনের ক্ষেত্রে। একদিকে দেশটি প্রকৃতিসৃষ্ট করোনায় বিপর্যস্ত, অন্যদিকে মনুষ্যসৃষ্ট সংঘাতময় পরিবেশ-এই দুইয়ের মধ্যেই তাকে শপথ পাঠ ও দায়িত্ব নিতে হয়েছে। মনুষ্যসৃষ্ট যে সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্য দায়ী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করতে হেন কোন পন্থা নেই, যা তিনি অবলম্বন করেননি। ট্রাম্প তার চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বর্ণবাদ ছড়িয়ে যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন, তা ঘূর্ণিঝড়ে কোনো জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার সাথেই তুলনীয়। ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট ক্ষত সারতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে ট্রাম্প বর্ণবাদের যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেছেন তা নিরাময় হতেও দীর্ঘ সময় লাগবে। বলা যায়, বিধ্বস্ত ও অস্থিতিশীল এক পরিবেশে জো বাইডেনকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এই বিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে স্থিতিশীল পথে আনতে তাকে এখন কাজ করতে হবে। কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং পথটিও বন্ধুর। প্রথমত, করোনা থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্ত সমাজকে একীভূত করতে হবে। করোনা থেকে মুক্তির পথটি সহজ হলেও, বিভক্ত সমাজকে একীভূত ও একসূতায় গাঁথার পথটি অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। এই অভিষেক অনুষ্ঠানের ভাষণে তিনি এই কঠিন কাজটি করারই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, তারাও যেন নিজেদের রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট না ভাবেন। এক দেশ এক জাতি হিসেবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
দুই.
‘গতস্য শোচনা নাস্তি’ বলে একটি প্রবাদ রয়েছে। যা গেছে, গেছে তা নিয়ে শোচনা করার দরকার নেই। সামনে তাকাতে হবে। আবার এ কথাও ঠিক, নদী শুকিয়ে মরে গেলেও তার বয়ে যাওয়ার দাগ থেকে যায়। এ দাগ সহজে মোছে না। যুক্তরাষ্ট্রকে ট্রাম্প যেভাবে তছনছ করে দিয়েছেন, তার উত্তরণ ঘটলেও ইতিহাসে অত্যন্ত খারাপ নজির হিসেবে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে। এই ইতিহাস আগামী দিনে মানুষ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরবে। বিশেষ করে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে বিবেচিত, দেশটির নাগরিকসহ অন্যরা তা স্মরণ করবে। ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলকে খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরবে। কারণ, বিশ্বের অন্যদেশে গণতন্ত্র বা শাসন ব্যবস্থা নিয়ে দেশটি যতই অগণতান্ত্রিক কথাবার্তা ও আচরণ করুক না কেন, নিজ দেশের গণতন্ত্রের প্রতি সে বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। তার এই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত দিয়েছেন ট্রাম্প। তার একনায়ক সুলভ আচরণ, অশ্বেতাঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার নীতি, পরাজয় না মেনে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা এবং তা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা, উগ্র সমর্থকদের উস্কে দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় যেতে না দেয়ার অপচেষ্টা, তার সমর্থকদের সশস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় মহড়া দেয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক চরিত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের আঘাত দিয়েছে। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশটিতে আভ্যন্তরীণ উগ্রবাদ জন্ম নেয়ার। এ আলামত পরিদৃষ্ট হয়ে উঠেছে। এর সবকিছুর জন্যই দায়ী ট্রাম্প। শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য তার মতো গোঁয়ার্তুমি যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো প্রেসিডেন্টকে করতে দেখা যায়নি। অথচ ২০১৬ সালের নির্বাচনে যখন ট্রাম্প হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে বিজয়ী হন, তখনও হিলারির লাখ লাখ সমর্থক তার পরাজয় মানতে পারেনি। সমর্থকরা ট্রাম্পকে কিছুতেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করতে রাজী ছিল না। তারা ‘ট্রাম্পকে মানি না’ প্লেকার্ড নিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল ও হিলারির প্রতি আবেগ প্রদর্শন করেছে। কোনো উগ্রপন্থা অবলম্বন করেনি। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য এবং গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজ দলের সমর্থকদের শান্ত থাকার আহবান জানান। তিনি নিজে দলের প্রার্থীর পরাজয় মেনে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় নেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ট্রাম্প ঠিক উল্টো কাজ করেছেন। পরাজয়ে পাগলপারা হয়ে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার পথ খুঁজতে থাকেন। নির্বাচনের আগে থেকেই পরাজয় মানবেন না, নির্বাচনের ফলাফল দেখে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন কিনা তা ভেবে দেখবেন ইত্যাদি নানা কথা বলেছিলেন। এমনকি তাকে জিতিয়ে দিতে চীনের সহযোগিতা পর্যন্ত চেয়েছিলেন। নির্বাচনের ফলাফল আসার সময় সুস্পষ্ট ব্যবধানে জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও তা প্রত্যাখ্যান করে ট্রাম্প সমর্থকদের উদ্দেশে গোয়ার গোবিন্দর মতো বলতে থাকেন, তিনি বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। তারপর যখন নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি, তখন ভোটে কারচুপি হয়েছে, সুষ্ঠু ভোট হয়নি ইত্যাদি অভিযোগ তুলে বিভিন্ন রাজ্যে মামলাও ঠুকে দেন। সেসব মামলায় পরাজিত হওয়ার পরও তিনি পরাজয় মানতে নারাজ ছিলেন। পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর তার আচরণ আরো উগ্র হয়ে উঠে। কিভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় এ নিয়ে নানা অনিয়মতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক পথ খুঁজতে থাকেন। তার বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে একের পর এক টুইট করে তার সমর্থকদের উত্তেজিত করে তোলেন। সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের অদূরে তার সমর্থকদের এক সভায় ভাষণ দিয়ে ক্যাপিটল হিলে পদযাত্রা করার আহবান জানান। এতে তার উগ্র সমর্থকরা ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যা প্রায় পৌণে দুইশ’ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনা ঘটে। ট্রাম্পের এমন আচরণে পুরো বিশ্ব যেমন স্তম্ভিত হয়, তেমনি ট্রাম্পের দলের অনেক সিনেট সদস্য ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করেন। এ ঘটনায় ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো ইমপিচমেন্টের শিকার হন, যা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেনি। ট্রাম্পের বিদায় যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে, তার সমর্থকরাও উত্তেজিত হতে থাকে। তারা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়া শুরু করে। ক্ষমতায় থাকার জন্য ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের কোনো অপচেষ্টাই শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাছে তাদের অশুভ শক্তির পায়তারা পরাজিত হয়েছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন।
তিন.
গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় এবং জনগণের মনে তা মেনে চলার মনোভাবের কাছে যে অগণতান্ত্রিক কোনো কিছু টিকে থাকতে পারে না, তা যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে দেখিয়েছে। এ থেকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর যেমন অনুধাবনের বিষয় রয়েছে, তেমনি আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোরও শেখার রয়েছে। আমাদের মতো দেশ, যেখানে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আকাক্সক্ষা রয়েছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কিভাবে ভিত্তি লাভ করেছে এবং জনগণের মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয় রয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দৃঢ় হলে যেকোনো অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড যে প্রতিরোধ করা যায়, তা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও প্রশাসন দেখিয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন না থাকার পরও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কোনো অপচেষ্টাই সেখানে কাজ হয়নি। আমরা যদি আমাদের দেশের নির্বাচনের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, এখানে সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। নির্বাচন হয় ঠিকই, তবে তা লোক দেখানো ছাড়া কিছুই নয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা দিয়েই তার দায় সারে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যে ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার তার কোনো কিছুই পরিলক্ষিত হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধানতম কাজ হচ্ছে, সব দলের জন্য সমান মাঠ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং নির্বাচনের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে বিগত প্রায় এক দশক ধরে যেসব নির্বাচন হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে এমন পরিবেশ বলতে কিছু নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এককেন্দ্রিক ও লোক দেখানোতে পরিণত করা হয়েছে। জাতীয় থেকে স্থানীয় নির্বাচনকে পরিণত করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে। নির্বাচন মানেই যেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনিত প্রার্থী এবং তার মনোনয় বঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতিদ্ব›িদ্বতা। বলা বাহুল্য, এই দুই প্রার্থীর মধ্যে যেই বিজয়ী হোক না কেন, তাতেই সে সন্তুষ্ট। এখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ হয়ে পড়েছে নামকাওয়াস্তে এবং নির্বাচন করতে হবে বলে করা। তাদের এই অংশগ্রহণ মূলত নিজেদের পিঠের চামড়া বাঁচানোর জন্য। কারণ, তারা ক্ষমতাসীন দলের একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে কমজোরি হয়ে পড়েছে। ফলে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ করার বিষয়টি হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলকে সন্তুষ্ট করে নির্যাতন ও জেল-জুলুম থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার একটি উপলক্ষ্য। আর ক্ষমতাসীন দলও তা চায় এবং বিরোধী দলের নির্বাচনী ফলাফলের ভরাডুবি দেখিয়ে ‘জনগণ তাদের সাথে নাই’ বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। নির্বাচনের এই ফলাফল দেখিয়ে এটাই বোঝায় জনগণ বিরোধী দলকে মোটেই চায় না আমাদেরই ক্ষমতায় দেখতে চায়। এটাই হচ্ছে, আমাদের দেশের গণতন্ত্রের চলমান রূপ। এই ধারায়ই ক্ষমতাসীন দল একযুগ পার করে দিয়েছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের ইকোনোমিস্ট পত্রিকার ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর গণতন্ত্রের হাল-হকিকত নিয়ে বিশ্বব্যাপী ১৬৭টি দেশের ওপর ডেমোক্রেসি ইনডেক্স নামে একটি জরিপ করে। জরিপে প্রধান তিনটি সূচক হচ্ছে, পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ, ত্রুটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ এবং হাইব্রিড গণতান্ত্রিক দেশ। এই তিনটি সূচকের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে হাইব্রিড গণতান্ত্রিক দেশে এবং অবস্থান ৮০। হাইব্রিড গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সুষ্ঠু ও মুক্ত গণতন্ত্রকে প্রতিরোধ করা, বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাহীনতা, সর্বব্যাপী দুর্নীতির আগ্রাসন এবং গণমাধ্যমকে চাপে ও হয়ারানিতে রাখা। অর্থাৎ বাংলাদেশ তৃতীয় স্তরের গণতান্ত্রিক দেশ এবং এর শাসন ব্যবস্থায় উল্লেখিত ত্রুটিগুলো রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থে এসব বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে, নাকি এর চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর বোধকরি পাঠক জানেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের বদলে ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় থাকলেও তার যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং তা ধরে রাখার তীব্র আকাক্সক্ষা, তার কাছে ট্রাম্পের একরোখা ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যদি তা না থাকত, তাহলে ট্রাম্পের সমর্থকরা যেভাবে সশস্ত্র অবস্থায় বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মহড়া দিয়েছে এবং তা প্রতিরোধে জো বাইডেনের সমর্থকরা নেমে পড়ত, তাহলে কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো? জো বাইডেন তো পারতেন বিজয়ের উল্লাসে প্রতিপক্ষকে দমাতে ও প্রতিরোধ করতে তার সমর্থকদের আহবান জানাতে। কিংবা তিনি আহবান না জানালেও তার অতি উৎসাহী সমর্থকরা তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করতে রাস্তায় নামতে পারত। জো বাইডেন তা করেননি এবং তার সমর্থকরাও প্রতিহত করতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। এখানেই শীর্ষ নেতার গণতন্ত্র ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন এবং জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে কি এমন চিত্র কল্পনা করা যায় বা এমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ রয়েছে? পরাজিত দলের সমর্থকরা যদি মাঠে নামত, তাহলে কি তাদের আস্ত রাখা হতো?
চার.
অনেককে বলতে শোনা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের তুলনা হতে পারে না। তাদের দুইশ’ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাস। আর আমরা মাত্র পঞ্চাশ বছরে পা দিতে যাচ্ছি। তাদের এ কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, আমাদের স্বাধীনতার মূল ভিত্তিই তো রচিত হয়েছে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয় বলেই অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে বের হতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোও রাজনীতি করছে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে। ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলগুলোও গণতন্ত্রেরই কথা বলছে। জনগণ তো আগে থেকেই গণতন্ত্রকামী। সকলের লক্ষ্যই যদি হয় গণতন্ত্র, তাহলে তা প্রতিষ্ঠা করতে তো পঞ্চাশ বছর লাগার কথা নয়। এক্ষেত্রে, গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতাসীন হওয়া দলের সদিচ্ছাই তো সবার আগে প্রয়োজন। আমরা কি তা দেখছি? ছোট্ট দেশ ভুটান যদি জনগণকে সুখী করার জন্য ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ)’ নীতি প্রণয়ন এবং সংবিধানে তা যুক্ত করে সুখ-সাচ্ছন্দ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না? কেন গণতন্ত্রের মোড়কে একনায়কতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হবো? অনেকে বলতে পারেন, ‘যশ্চিন দেশে যদাচার’ বা যেই দেশের যে আচরণ। তাদের এ কথার উত্তরে বলা যায়, মানবতা, মানবিক গুণাবলী, মূল্যবোধ, দেশ ও জনগণের কল্যাণ চিন্তা-এগুলো সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এগুলোর কোনো বাউন্ডারি বা সীমা নেই। গণতন্ত্রেরও কোনো সীমা নেই। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দেশে কোনো না কোনোভাবে গণতন্ত্র রয়েছে। এটি সার্বজনীন। এর কোনো নির্দিষ্ট দেশ নেই। যে কেউই গণতন্ত্র ধারণ করতে পারে। তবে গণতন্ত্রের কথা বলা হবে, তা প্রতিষ্ঠা বা মানা হবে না, এর নামে একনায়কতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদ পরিচালনা করা হবে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের আচরণ জনগণের সাথে প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। গণতন্ত্রকে ভিত্তি করে যেসব দেশের শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা শাসক দল খর্ব ও সংকুচিত করে কিছু কাল হয়তো টিকে থাকতে পারে, তবে কোনো না কোনো সময় সেসব দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসবেই। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে লন্ডভন্ড করে দেয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তার এ অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত টিকেনি এবং তাকে অপদস্ত ও অসম্মানিত হয়েই বিদায় নিতে হয়েছে। আমাদের মতো যেসব দেশে কম-বেশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত, যারাই তা খর্ব করার প্রয়াস চালাচ্ছে বা চালাবে, তাদের বিষয়টি বিশেষভাবে স্মরণ রাখা উচিত।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।