পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অবশেষে পূর্ণ নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্কির কংগ্রেসের ক্যাপিটল ভবনের ওয়েস্ট ফ্রন্টে আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করলেন জো বাইডেন। নির্বাচনে পরাজিত সদ্যবিদায়ী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের সাম্প্রতিক সহিংসতা ও নাশকতার হুমকির মধ্যে নজিরবিহীন নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা, বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ১১টায় এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ঐতিহ্য ভেঙ্গে সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুপস্থিত থাকলেও সাবেক তিন প্রেসিডেন্ট এবং ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স উপস্থিত ছিলেন। আমেরিকান গণতন্ত্রের দুই শতাধিক বছরের ইতিহাসে এক চরম ক্রান্তিকালে জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া এবং শান্তিপূর্ণ ট্রানজিশনের ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়ার এই সংকটকালে বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠান এবং শপথবক্তৃতা এক বড় অভিঘাত ও উত্তরণের পথ দেখিয়েছে। মার্কিন গণতন্ত্র আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পশ্চিমা গণতন্ত্রের অন্যতম পথপ্রর্দশক ও অনুপ্রেরণা হিসেবে গণ্য করা যায়। মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য-সংহতি, মানবাধিকার ও জনগণের সার্বভৌম ঐক্যের গাইডলাইন রেখে গেছেন, গত দুইশ বছরে তার অনেক কিছুই অরক্ষিত হয়ে পড়লেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের ভোটাধিকারের সংরক্ষণ এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন নিয়ে অযাচিত প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষত কর্পোরেট মিডিয়া এবং নির্বাচনী তহবিল গঠন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অস্বচ্ছতা ও পক্ষপাতিত্বের কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা জনমতের প্রতিফলনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগ পুরনো। তবে ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার সাথে বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং ইন্টারনেট হ্যাকিংয়ের অভিযোগ পুরো ৪ বছর ধরেই আলোচিত হয়েছে। পপুলার ভোটের হিসাব এবং প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের জরিপকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব অঙ্গরাজ্যে সাধারণ মানুষের রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ করা এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে প্রত্যাখ্যান করার ঘটনাও ছিল নজিরবিহীন। এর আগে আর কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের পক্ষ থেকে এমন প্রতিবাদী প্রত্যাখ্যানের নজির নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরুটা যেমন ভালো হয়নি, তার শেষটাও হয়েছে নজিরবিহীন ও মার্কিন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্য কলঙ্কজনক। পক্ষান্তরে ট্রাম্প সমর্থকদের উগ্র-সহিংসতার হুমকি সত্তে¡ও জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানটি যথাযথ ভাব-গাম্ভীর্য, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সর্বোপরি মার্কিন গণতন্ত্রের উত্তরণ ও জনগণের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে দেশপ্রেমে উদ্ভাসিত।
শপথ অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য অনুসারে পর্যায়ক্রমিক অনুষ্ঠান সূচিতে ক্যাথোলিক জেসুইট ফাদার লিও জে.(জেরিমিয়াহ) ডোনাভান যে ইনভোকেশান বক্তৃতা দেন তাতেও আমেরিকান প্যাট্রিয়টিজমের কথা বলা হয়েছে, যেখানে ক্ষমতা বা কোনো মহলের প্রতি পক্ষপাত বা প্রভাবের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সমানভাবে সব মানুষের মঙ্গল, কারো প্রতিই বিদ্বেষ বা বৈরিতার স্থান সেখানে নেই। ইনভোকেশন বক্তৃতায় মার্কিন রিকনসিলিয়েশনের কথা বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বর্ণবাদ, জাতিগত বিভেদ-বৈরিতায় ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন জনগণের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার প্রতি ক্যাথোলিক চার্চের পক্ষ থেকেও তাগিদ দেয়া হয়েছে। এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের রায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায় এবং জো বাইডেনের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্রের নতুন ধাপে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকামী বিশ্বের জন্য এক নতুন মেসেজ পাওয়া গেল। অর্ধশতাধিক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঠের রাজনীতি, বার বার নির্বাচিত সিনেটর হিসেবে এবং দুইবারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ জো বাইডেনের সততা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। বিশ্ব রাজনীতি ও মার্কিন গণতন্ত্রের এই ক্রান্তিকালে তার মতো সৎ, দক্ষ ও প্রাজ্ঞ নেতার পক্ষেই অবক্ষয় থেকে উত্তরণের গতিপথ নির্মাণে সক্ষম হবেন, এই প্রত্যাশা জাগাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও জনগণের দ্বারা অপরীক্ষিত নেতৃত্বের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শত বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ, সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও যে নড়বড়ে ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে, ডোনাল্ড ট্রাম্প সে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তার চার বছরের শাসন ও রাজনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত চরমপন্থার উত্থান ঘটিয়েছে। নিওকনজারভেটিভদের হাত ধরে হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্ট বা শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের উত্থান মার্কিন জনগণকে বিভাজিত করে গণতন্ত্রকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তুলেছিল। পশ্চিমা রাজনীতিতে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ অনেকটা ঔপনিবেশিক আমলে তৃতীয় বিশ্বে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসকদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অথবা ‘ডিভাইড অ্যান্ড কনকোয়্যার’ পলিসির মতো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্ণ বা মতের মানুষকে সংখ্যালঘু গ্রুপের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন রাজনীতি আমেরিকাকে একদিকে যেমন ভেতর থেকে দুর্বল করেছে, অন্যদিকে মার্কিন সংবিধানের আকাক্সক্ষা ও ভাবাবেগ ভুলে আমেরিকা ফার্স্ট বা উগ্র মার্কিন জাতীয়তাবাদের তকমা লাগিয়ে বিশ্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। জো বাইডেন তার প্রথম কয়েক সপ্তাহের অগ্রাধিকার কার্যক্রমের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প কৃত বিভক্তি, বিচ্ছিন্নতা এবং বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের বিপরীতে নতুনভাবে শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্পের অপশাসন এবং বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতসহ উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ট্রাম্পের বর্ণবাদ ও মুসলিম বিদ্বেষী রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রভাবে গত কয়েক বছরে ইউরোপের দেশগুলোতেও রক্তাক্ত সহিংসতার বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে।
অভিষেক বক্তৃতায় জো বাইডেন বলেছেন, আজ আমেরিকার দিন, গণতন্ত্রের দিন। বাইডেনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম নারী এবং অশ্বেতাঙ্গ ভারতীয় বংশোদ্ভুত কমলা হ্যারিসের নির্বাচিত হওয়া দুইশ বছরের মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক। ট্রাম্পের শাসনে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্য, সাম্য, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের দাবিকে উচ্চকিত করেছেন বাইডেন। সত্যিই নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল মার্কিন গণতন্ত্র। মার্কিন জনগণ জো বাইডেনকে ভোট দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়া থেকে বিরত রেখে হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায়ের কুশীলবের ভূমিকা পালন করলেও ট্রাম্প মার্কিন জনগণের রায় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঐতিহ্যকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কলঙ্কিত করে গেছেন। জো বাইডেনের মহাসংকট ও চ্যালেঞ্জ উত্তরণের পরীক্ষায় মার্কিন জনগণের বিজয় ও জেগে ওঠার গল্পকে দেশপ্রেমের পবিত্র মোড়কে আবৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। ভাষা ও বর্ণগত পার্থক্য, জাতিগত বৈষম্য এবং ধর্মীয় বিভাজনের স্বার্থান্ধ রাজনীতি আমেরিকাকে বিভাজিত করে দুর্বল করে দিয়েছে। এই বাস্তবতাই জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছিল। এটি এখন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রায় সর্বত্র এই বিভাজনের প্রক্রিয়া পুরো বিশ্বের সমাজব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ করে তুলেছে। জো বাইডেনের অভিষেক বক্তৃতা থেকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের সেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার কুশীলব ও নাগরিক সমাজের অনেক কিছু শিক্ষনীয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় রয়েছে। দেশে দেশে উগ্রবাদ ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। এসব শাসকদের চরম শেষ পরিণতির কোনো ব্যত্যয় নেই। একদেশদর্শী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রদর্শন এবং অতীতের ক্ষতকে সামনে এনে জাতিকে বিভক্ত করার রাজনীতি দেশকে কীভাবে পিছিয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার জ্বলন্ত উদাহরণ। জো বাইডেন ট্রাম্পের সেই পশ্চাতমুখী রাজনৈতিক দর্শনের বিপরীতে মার্কিন সংবিধানের মূল্যবোধকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। ধর্ম-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে মার্কিন জনগণের ঐক্য ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হলে তা সারাবিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। সেই সাথে বেশকিছু মুসলিম দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা, ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি, প্যারিস জলবায়ু প্রটোকল, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থার সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক সম্পর্কোন্নয়নের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক মর্যাদা ও নেতৃত্বের অবস্থানকে সুসংহত করতে সক্ষম হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিসের অভিষেকের মধ্য দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নতুন পথচলাকে আমরা স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানাই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।