পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আধুনিকতা, বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তিবিদ্যার সম্প্রসারণে পৃথিবীতে পরিবর্তন ঘটছে। একই সঙ্গে সমাজ যত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ততই পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে মূল্যবোধের মধ্যে। জীবন ধারায় এক অদ্ভূত রূপান্তর দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নীতিবোধ বা মূল্যবোধের অর্থও পাল্টে যাচ্ছে। তবে অর্থের তারতম্য যাই থাকুক না কেন এটা বোঝা যাচ্ছে, মানুষ আজ চিন্তিত। সবার মুখে শোনা যায়, হারিয়ে যাওয়া নীতিবোধের কথা। একটা কষ্ট, উৎকন্ঠা অনুভব করেন প্রবীণরা। প্রায়ই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলা হয় আমাদের সময়ে এসব ছিল না। এ কোন সংস্কৃতি এসে ঢুকল আমাদের সমাজে।
দেশজুড়েই এখন অবাধে চলছে দুর্নীতি, চুরি, ধর্ষণসহ, অনৈতিক কাজ , অন্যায় আর অবিচারের অসংখ্য ঘটনা যা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে করে তুলছে ভারাক্রান্ত। বিশ্বাসের অভাবে সন্দেহের দৃষ্টিতে সবাইকে দেখতে শিখছি। একটা অজানা ভয় আমাদের দুর্বল করে যেন তাড়া করছে, যার প্রতিফলন আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের উপর ভীষণভাবে পড়ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের উপরও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক অন্যায়-অনিয়ম আর অবিচার। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, সেকালে তো সমাজে এত সংকট, এত দ্ব›দ্ব ছিল না। বর্তমান আধুনিক জগতে এসব নিয়ে বেশি আলোচনা করলে মধ্যবয়স্ক যারা তারা বলেন, কোনও সংকট বা দ্বন্দ্ব নয়- শুধু প্রাচীন অভ্যস্ত চিন্তধারা স্বাভাবিক নিয়মের আবর্তে সমাজ বদলের সঙ্গে বিবর্তিত হচ্ছে, আর এটা হবেই।
নীতিবোধকে ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে সৎ জীবন, বিবেকবান, মানবিক, ভালমন্দ বিচার করা, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের আদর করা, ন্যায়, নিষ্ঠা, সততা ও পরোপকারী ইত্যাদি বিশেষ গুণাবলির ভিত্তিতে, যে সব শ্বাশত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আন্তরিকভাবে সত্যের পথে থাকা। ছোট ছোট নিষ্পাপ ছেলেমেয়ে শৈশব থেকেই কতগুলো শব্দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, যার অর্থ কিছুই বোঝে না এরা। যেমন, ছিনতাই, রাহাজানি, দুর্নীতি, কালো টাকা, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি। অদম্য কৌতহুলবশত শিশুরা অভিভাবকদের প্রশ্ন করে, এসব শব্দের অর্থ কী? মার পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না। বলেন, ‘এগুলো খুবই খারাপ কাজ, খারাপ লোকেরা এ কাজগুলো করে।’
এসবের মধ্য দিয়েই শিশুরা বড় হচ্ছে। সেকালে যেগুলোকে গর্হিত বলা হতো আজ আর সে-সবকে খারাপ চোখে দেখে না অনেকে। পরীক্ষার সময় নকল করা, নকল পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষা দেওয়া, ঘুষ নেওয়া, জাল সার্টিফিকেট, জাল নোট তৈরি করা, শিশুদের খাদ্যে ভেজাল মেশানো- এগুলো অবলীলায় ঘটে যাচ্ছে। তাই বলে সেকালে একেবারেই মিথ্যা মুক্ত সমাজ ছিল তা বলা যায় না। তবে তখন মিডিয়ার এত ব্যাপ্তি ছিল না। তাই অনেক কিছু জানা যেত না। অত্যাচার, শোষণ অথবা মেয়েদের সঙ্গে চরম অন্যায় সবই ছিল তবে মাত্রা ছিল কম। এমনটাও হতে পারে, মানুষ অনেক কিছু জানতে পারত না। সাহস ও সততা থাকায় দুর্নীতিবাজ মানুষকে চিহ্নিত করতে ভয় পেত না মানুষ। মাতাল, চোর, লোভী, মানুষেরাও ছিল। কিন্তু এখন যেন মাত্রাতিরিক্তভাবে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় এরা। আর আমরা তা দেখেও দেখি না। রাজনীতি ক্ষেত্রে তো এখন যে যত দুর্নীতিবাজ, সে ততই ক্ষমতাবান। ভোটের আগে পত্রপত্রিকায় সম্পত্তির খতিয়ান তুলে ধরা হয়। প্রশ্ন জাগে, এত টাকার উৎস কোথায়? সাধারণ মানুষ যত ভাবে এসব, দুর্নীতিবাজরা ততই বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, শিল্পবিপ্লব সমস্ত দুনিয়াকে পাল্টে দিয়েছে। যে যার জায়গায় ছিল সেখান থেকে ছিন্নমূল হয়ে পেটের তাগিদে শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়। তখন থেকেই কিন্তু চিরাচরিত নীতিবোধের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কারণ, গ্রাম ও শহরের দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান ছিল। শহরে প্রতিযোগিতা বেশি, সুযোগ কম তাই মানুষ যেনতেন-প্রকারে অর্থের প্রয়োজনে বাঁচার জন্য কাজে নেমে পড়ে। মানুষের স্বভাব পাল্টে যেতে থাকে, বেপরোয়া হয়ে সে তার চিরন্তন শাশ্বত নীতিগুলোকে ছেড়ে দেয়, নির্দয় হয়, আত্মকেন্দ্রিকতা একটু একটু করে জন্ম নেয়, সে হিংস্র হয়। তখন থেকে জিততে না পারলে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারায়, লোভ আর চাহিদা গ্রাস করে ভয়ঙ্করভাবে নিষ্ঠুরতার খেলায় মেতে ওঠে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য তার হৃদয় থেকে মানবিক গুণগুলো ঝরে পড়ে যায়। অমানবিক কাজে আনন্দ পায় সে।
ছোট ছোট ভালবাসার স্মৃতি, ভালবাসার গান, মায়ায় ভরা মন সব হারিয়ে অর্থই জীবন, বিলাসবহুলভাবে বাঁচার ইচ্ছা জাগে। ভোগেই আসল, ত্যাগ নয়- মানবতা নয়, বিচ্ছিন্নতাই ভাল। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না কোথায় যেন পড়েছিলাম- ‘পাশ্চাত্যের তুলনায় আমাদের দৈন্য আরও প্রকট, এই কারণে যে সে দেশের বিত্তের দাম আছে, বিদ্যার দাম আছে। বিত্ত ও বিদ্যার সম্মিলিত মূল্যও অনেক বেশি, কিন্তু ও দেশে একমাত্র বিত্ত ছাড়া আর কিছুর কদর নেই। এখন শুধু টাকা, জনপ্রিয়তা, গাড়ি, বাড়ি, বৈভব।’ এসবের চাপে ভাল মানুষের ভালমানুষি হারিয়ে যাচ্ছে।
এ সমস্ত দেখে বলতেই হয়, পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কিত হয়ে নতুন মূল্যবোধ বা নীতিবোধ এসে ঢুকেছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে কোনও কিছুর মধ্যে পরিবর্তন আসবে না, এটা ভাবা উচিত নয়। যেহেতু সমাজ স্থিতিশীল নয়, তাই এক রকমভাবে সে থাকতে পারে না। তবে পরিবর্তনগুলো যদি কাম্য হয়, যদি সমাজের উন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করে না তা হলে সে পরিবর্তন অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। আজকের যুগে উচিত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা। বলতে গেলে শ্রদ্ধাবোধ সামাজ থেকে বিলুপ্তপ্রায়। অবজ্ঞা বলব না, তবে সমীহ করতে খুব একটা দেখা যায় না। মা-বাবার চেয়ে বন্ধুবান্ধবকে অনেকে শ্রেয় বলে মনে করছে। ন্যায়-নীতি পাল্টে যাচ্ছে। অথচ আমরা জানি, শিক্ষা, সভ্যতা আমাদের জীবনগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে, এটাই তো মূল্যবোধ। আমাদের সময় ছোটবেলা থেকে শিখে আসছি, সত্যই সুন্দর। এই সত্যের জন্য সবকিছু ছাড়া যায়, কিন্তু সবকিছুর জন্য সত্যকে ছাড়া যায় না। মহাপুরুষরা তা-ই বলে আসছেন সর্বত্র। এই সত্যকে যে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে , ভালবাসে সে-ই প্রকৃত সুখী। আজকাল আমাদের পরিচয়ের ক্ষেত্র অনেক বেড়েছে, অসংখ্য রকমের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। ফলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বিস্তৃত হচ্ছে। নতুন নতুন সংস্কৃতি এসে ঢুকছে।
প্রজন্মগত পরিবর্তনের ব্যবধানে স্বীকার করে নিতে হবে। আমাদের যুগই ভাল ছিল আর এ যুগে সবই খারাপ ভাবা অন্যায়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এদের কত কিছু শেখাচ্ছে, পরিবর্তন আসছে জীবনে, উন্নতির শিখরে উঠতে পারছে- এসব তো আমরা সেভাবে পাইনি। অবাধে ছেলেমেয়েরা খেয়ালখুশিমতো মিশছে, বন্ধুত্ব করছে, বিয়ে করছে আবার কিছুদিন পর সম্পর্ক ভেঙেও যাচ্ছে। যে দাম্পত্য জীবন দীর্ঘদিন ধরে আমরা লালন-পালন করে রক্ষা করে চলছি, এই প্রজন্মের এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। মতের অমিল হলেই বিচ্ছেদ। এখানে ‘নতুন’ মূল্যবোধ এসেছে। পাপ-পূণ্য বোধগুলো পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে জীবনবোধ।
পরিবর্তিত জীবনবোধের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যাখ্যাও হারিয়ে যায়। ধর্ম মানেই শৃঙ্খলা, অনুশাসন। এখানেই সংকট। আর্থিক অবস্থা মূল্যবোধের সংকটের একটি কারণ বলে অনেকে মনে করেন। সমাজের একেবারে উঁচু শ্রেণির মানুষেরা নীতিবোধ, মূল্যবোধকে নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। কারণ, ক্ষমতার লড়াইয়ে টাকাই প্রধান। টাকা থাকলে দুনিয়া কেনা যায়- এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী এরা। আর একেবারে নিম্নশ্রেণির কাছে মূল্যবোধ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। কারণ, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের কাছে এসব অর্থহীন। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী সবদিক থেকে বিপদে। এই শ্রেণি অনৈতিক কাজকর্ম করতে বারবার ভাববে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত মননের জন্য নৈতিক নীতিবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় হচ্ছে। এটা মানতেই হবে, আমাদের চলনে, স্বভাবে, মানসিকতায় চরম অবক্ষয় ঘটেছে। একটা উৎকট নব্যসংস্কৃতি প্রবেশ করেছে, হয়তো সেটা অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের অনুকরণে, উপনিবেশবাদে, ক্ষমতায়নের দাপটের জন্য। তবে মনে রাখতে হবে, এই নব্যসংস্কৃতি যেন আমাদের চেতনাকে আর ভাষাকে গ্রাস না করে। আমাদের শেকড় আর আমাদের সনাতন সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে আমরাও হারিয়ে যাব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।