Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘সব কিছুরই একটা শেষ আছে’

ইমরান মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

সেই ২০০১ সালে সদ্য কৈশর পেরুনো এক উঠতি যুবা। এক বুক স্বপ্ন আর আকাশ সমান দৃঢ়তা নিয়ে গায়ে চড়িয়েছিলেন লাল-সবুজের জার্সি। তার পর থেকে বাংলাদেশ দলে খেলছেন ১৯ বছর ধরে। দীর্ঘ এই সময়ে বহুবার চোট-আঘাতে জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়েছেন। কিন্তু পারফরম্যান্সের কারণে কখনোই বাদ পড়েননি। বারবার লড়াই করে মাশরাফি বিন মুর্তজা ফিরেছেন আপন সৌর্য্য।ে দেশের মাটিতে ২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে না পারা তার এক জীবনের আক্ষেপ। সেবার তবু কারণ বা অজুহাত ছিল ফিটনেস সমস্যা। কিন্তু বাদ বলতে যেটা বোঝায়, সেই স্বাদ তো পেলেন ক্যারিয়ারে এবারই প্রথম!
হাঁটুতে সাত সাতটি অস্ট্রোপচার টেস্ট (৩৬) আর টি-টোয়েন্টি (৫৪) খেলার সুযোগ কম দিলেও ২২০ ওয়ানডের ঝুলিতে ২৭০ উইকেট। ৩৭ বছর বয়সে এক সমুদ্র অভিজ্ঞতা। কেবল পারফরম্যান্সের বিচারেই তার ধারেকাছে নেই কোনো বাংলাদেশি পেসার। কিন্তু মাশরাফিকে শুধু পারফরম্যান্স দিয়ে বিচার করা যাবে কি! নেতা মাশরাফিও তো নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া একজন! দুটি বিশ্বকাপে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসাধারণ প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব। দলে তার উপস্থিতিই বিরাট ব্যাপার। বাংলাদেশ দলে তো এমনটা ছিলেনই। ঘরোয়া ক্রিকেট বা যেকোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও যে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে দলে খেলেছেন, সেটিকেই নিজের প্রেরণার জাদুতে বদলে দিয়েছেন আমূলে। তার অনুপস্থিতির অনুভবটা দীর্ঘই হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে।
‘অনুপস্থিতি’ শব্দটা লেখা হচ্ছে বটে, কিন্তু মাশরাফি তো এখনো খেলছেন। এ শব্দটি লিখতে হচ্ছে কারণ তাঁকে সদ্যই জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আসছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের জন্য যে ২৪ সদস্যের প্রাথমিক দল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে নেই জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়ক। নির্বাচকেরা বলছেন, কঠিন একটা সিদ্ধান্তই তাঁদের জন্য এই মাশরাফিকে বাদ দেওয়া। কিন্তু সেটি করতে হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। বয়স ৩৭ হয়ে গেছে। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে মাশরাফি পৌঁছে গেছেন এমনিতেই। ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে দলের নতুন রক্ত ঢোকাতে হবে- মাশরাফিকে তারা বাদ দিয়েছেন সেসব কথা চিন্তা করেই। দলকে নতুনভাবে গুছিয়ে সামনে এগোতে ও ২০২৩ বিশ্বকাপে চোখ রেখে নির্বাচক কমিটি, টিম ম্যানেজমেন্ট সবাই সম্মিলিতভাবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখানে মাশরাফির কিছু করার নেই।
এমন একটি খবর যে একদিন শুনতেই হবে, সেটি অবধারিতভাবে জানতেন তিনিও। মাশরাফি কি নিজেও জানতেন, বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে তার! হয়তো, নইলে বলবেন কেন ‘সব কিছুরই একটা শেষ আছে’। এর আগে নিজেই যে তৈরী করে দিয়েছিলেন বিকল্প খোঁজার পথ। বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, গত মার্চে জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে অধিনায়কত্বকে বিদায় জানানো, সবই ছিল ¯্রফে ক্রিকেটার হিসেবেই দলে জায়গা পাওয়ার লড়াইয়ের অংশ। পুরো বিষয়টিকে পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গিতেই নিয়েছেন মাশরাফি। বাদ পড়ার পর ছোট্ট প্রতিক্রিয়ায় বললেন, বাস্তবতা তিনি মেনে নিচ্ছেন। পাশাপাশি খেলা চালিয়ে যাওয়ার আগের সিদ্ধান্তেও অটল আছেন, ‘এটা পেশাদার জগৎ। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমি পেশাদারীভাবেই নিচ্ছি এটাকে। আর কিছু বলার নেই। আগেও বলেছিলাম, জাতীয় দলে সুযোগ না পেলেও খেলা চালিয়ে যাব। এখনও সেটিই বলছি। আপাতত আর কিছু ভাবছি না।’ তাই বলে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের স‚র্যাস্ত এখনই দেখতে রাজি নন তিনি, ‘ক্রিকেট খেলেই আমি এত দ‚র এসেছি। আমি খেলে যাব। ঘরোয়া ক্রিকেটে যেখানে সুযোগ পাব, সেখানেই খেলব। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর খেলব কি না, সেটি নির্বাচকদের ব্যাপার।’
গত বিশ্বকাপের পর থেকেই নিজের অবসরকে ঘিরে প‚র্ব ভাবনা থেকে সরে এসেছেন মাশরাফি। নানা কারণে ঘটা করে অবসর নেওয়ার ইচ্ছা আর নেই তার, ‘শরীর-মন যত দিন চাইবে খেলে যাব।’ এই খেলে যাওয়াটা নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার লড়াইয়ের বারুদে ঠাসতে চান না মাশরাফি, ‘খেলব মনের আনন্দে।’ এই আনন্দভ্রমণকে জাতীয় দলে ফেরার লড়াই মনে করছেন না বারবার ‘মৃত্যুক‚প’ থেকে উঠে আসা মাশরাফি, ‘ওসব ভাবনা নেই। তবে কাল কী হবে, কেউ তা জানে না! একদিন ক্রিকেট ছাড়তে হবে। সেদিন এলে আমি নিজেই ছেড়ে দেব।’
ওয়ানডের নেতৃত্ব ছাড়ায় জিম্বাবুয়ে সিরিজ একটা বিদায় সম্বর্ধনা পেয়েছেন। তাতে তো ক্রিকেটার মাশরাফিকে বিদায় জানানো হয়নি। মাশরাফি তার ‘ভালোবাসার ক্রিকেট’ ছেড়ে যাচ্ছেন না আপাতত। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাকে পাওয়া যাবে। হয়ত কোনদিন সেখান থেকে বিদায় নিতে গিয়ে পাবেন আড়ম্বরপ‚র্ণ ভালোবাসা। সেটা হলে কিংবা না হলেও মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রিকেটে থেকে যাবেন একজন নায়ক হয়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার সমাপ্তি একটা অস্বস্তি হয়ে থাকবে ঠিকই। হয়ত আগামীর কোন নায়কের জন্য উদাহরণ হয়েও থাকবে।
তবে তার আগেই ২০২৩ বিশ্বকাপের অজুহাতে নির্বাচকরা যেন বাজিয়ে দিলেন বিদায় ঘন্টা। এই ‘শেষ’টা যে অনুমিতই ছিল। তবুও কিছু সমাপ্তি প্রত্যাশিত হলেও নাড়া দিয়ে যায়। যেমনটা তাঁকে বাদ দেওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সহকারী নির্বাচক হাবিবুল বাশারের আবেগাক্রান্তও হয়ে পড়া! অবশ্য ‘মাশরাফি বিন মুর্তজা’ তো আর শুধু একজন ক্রিকেটার কিংবা সফল অধিনায়কের নাম নয়, তিনি বাঙালির আবেগও। কত ছুতানাতা কারণে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। সাতটি অপারেশনে ক্ষতবিক্ষত মাশরাফি সামান্য ব্যথা পেলেও আশঙ্কায় কুঁকড়ে উঠেছে দর্শক। সতীর্থদের কাছ থেকে সেরাটা আদায় করার নিজস্ব কৌশল, তাঁদের ছায়া হয়ে থাকা কিংবা ড্রেসিংরুমে শান্তি বজায় রাখার গুণ মিলিয়ে মাশরাফি অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন নিজেকে। তাই উত্তরস‚রি তামিম ইকবালের অধিনায়কত্ব অবধারিতভাবে তুলনা করা হবে মাশরাফির সঙ্গে। তার জায়গায় বল হাতে ছুটবেন যিনি, তাঁকেও ফেলা হবে আতশকাচের নিচে। সব মিলিয়ে মাশরাফির বিদায় যে একটি অধ্যায়েরও সমাপ্তি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাশরাফি

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ