Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতে ৩টি কৃষি বিল নিয়ে যে কারণে কৃষক আন্দোলন...

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

নতুন পাশ হওয়া তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লি সীমান্তে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত কৃষকরা। এই আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক কোন কোন বিষয়গুলি জড়িত? এক নজরে দেখে নেয়া যাক।

কোন তিনটি কৃষি আইন নিয়ে এত বিতর্ক?
স¤প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি আইন পাশ করেছে। দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০, ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিউরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট, ২০২০ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন ২০২০।
সরকারের দাবি এই তিনটি আইন কার্যকর করলে ফড়েদের দাপট এড়িয়ে সরাসরি ক্রেতাদের ফসল বেচতে পারবেন কৃষকরা। আরও বড় বাজার খুলে যাবে তাঁদের সামনে।

কীভাবে?
দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০ আইনটি কার্যকর হলে বিভিন্ন রাজ্যের কৃষি পণ্য বিপণন কমিটিগুলির (এপিএমসি) অধীনে থাকা বাজারগুলির বাইরেও ফসল বেচার ক্ষেত্রে কৃষকদের কোনও বাধা থাকবে না।
ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিউরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট, ২০২০ আইনটিতে চুক্তি চাষের নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন ২০২০ কার্যকর হওয়ার ফলে মজুতের ঊর্ধ্বসীমা উঠে যাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত ফলনের সময় ব্যবসায়ীরা সরাসরি কৃষকদের থেকে বেশি পরিমাণে কৃষি পণ্য কিনে মজুত করে রাখতে পারবেন।

কিন্তু কৃষকরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন কেন?
কৃষকদের আশঙ্কা, নতুন আইনগুলির সুযোগ নিয়ে কৃষি পণ্যের বাজারে কর্পোরেট সংস্থাগুলির একচেটিয়া দাপট তৈরি হবে। ফলে সুযোগ বুঝে কৃষকদের ন্যায্য মূল্যের থেকে কম দাম দেবে তারা।
কিন্তু বর্তমান এপিএমসি ব্যবস্থার থেকে নতুন এই মডেল কীভাবে আলাদা? এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় সাধারণত অনুমোদিত বাজারে লাইসেন্স প্রাপ্ত মধ্যস্বত্ত¡ভোগীদের কাছে তাঁদের ফসল বিক্রি করতে হয়। সাধারণত কৃষকরা যেখানে থাকেন সেই এলাকাতেই এই বাজারগুলি হয়। ফলে এতদিন সুযোগ থাকলেও নিজেদের এলাকার বাইরে ফসল বিক্রি করতে পারতেন না কৃষকরা। ১৯৬০ সালে কৃষকদের সহায়তায় এই এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই বাজারগুলিই কৃষকদের হাত পা বেঁধে দিয়েছিল। কারণ এই কমিটির মাধ্যমেই ফসল বেচতে বাধ্য হতেন তারা।

কিন্তু ফড়িয়ারাই যে এই বাজারগুলি নিয়ন্ত্রণ করত তার প্রমাণ কী?
এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত এই বাজারগুলিতে যে বহু ক্ষেত্রেই যে স্থানীয় কয়েকটি ব্যবসায়ী পরিবারের দাপট থাকত, তা প্রমাণিত হয়েছে। ২০১০ সালে কম্পিটিশন কমিশন তদন্ত করে জানতে পারে, মহারাষ্ট্রের নাসিকে এশিয়ার বৃহত্তম পেঁয়াজের পাইকারি বাজারে মোট লেনদেনের কুড়ি শতাংশই একটি ফার্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যে এই ব্যবস্থায় ফড়েদের দাপটে কৃষকদের থেকে যে দামে ফসল কেনা হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি দামে তা ক্রেতার কাছে পৌঁছচ্ছে। কারণ বিভিন্ন স্তরে ফড়িয়ারা নিজেদের লভ্যাংশ রাখতে গিয়ে পণ্যের দাম বেড়ে যেত।

বর্তমান আইনে সুরাহা কীভাবে?
নতুন দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০ অনুযায়ী যেখানে ভাল দাম পাবেন, সেখানেই ফসল বেচতে পারবেন কৃষকরা। এমন কি এক রাজ্যের কৃষক অন্য রাজ্যেও সরাসরি ফসল বিক্রি করতে পারবেন।

কৃষকদের আপত্তি কীসে?
কৃষকদের আশঙ্কা নিয়ন্ত্রণহীন কৃষি বাজারগুলিতে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা ঢুকে পড়লে চাষিরা হয়তো দর কষাকষির ক্ষমতা হারাবেন।
বেশ কিছু রাজ্য সরকার কেন এই আইনগুলির বিরোধিতা করছে? যে রাজ্যগুলি কৃষকদের প্রতিবাদকে সমর্থন করছে, তাদের মধ্যে অনেক রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা দলই এতদিন কৃষিক্ষেত্রে এই সংস্কারগুলির দাবি জানিয়ে আসছিল। ফলে এখন তারা বিক্ষোভ দেখানোয় এটা স্পষ্ট যে এর পিছনে রাজনীতিই বড় কারণ। আবার বেশ কিছু রাজ্যে এই এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলি রাজস্বের উৎস। যেমন পঞ্জাবে গম কেনার ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ কর নেওয়া হয়। বাসমতি নয় এমন ধানের ক্ষেত্রেও একই হারে কর নেওয়া হয়।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে ভয় কেন?
কৃষকরা ভয় পাচ্ছেন নতুন ব্যবস্থা চালু হলে হয়তো ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে তাঁদের থেকে আর ফসল কিনবে না সরকার। ফলে তাঁদের পুরোপুরি বড় বড় কর্পোরেটদের উপরে নির্ভর করতে হবে।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কী?
সবুজ বিপ্লবের পর থেকে সরকার কৃষকদের থেকে যে দামে ফসল কেনে সেটাই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য। সরকার নির্ধারিত মূল্যের কমে যাতে কৃকদের ফসল বেচতে না হয়, তা নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা। ২৩টি ফসলের ক্ষেত্রে এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করত সরকার।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কারা ফসল কেনে?
ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া বা এফসিআই-এর মাধ্যমে সরকারই কৃষকদের থেকে মূলত গম এবং ধান ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কিনে নেয়। এর ফলে সরকারের কাছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে গম এবং চাল বছরের পর বছর ধরে জমা হয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের কাছে মোট ৭০ মিলিয়ন টন চাল এবং আটা মজুত করা রয়েছে। যেখানে খাদ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার শর্ত মানলেও জুলাই মাসে সরকারের কাছে ৪১.১ মিলিয়ন টন এবং অক্টোবর মাসে ৩০.৭ মিলিয়ন টন চাল এবং আটা মজুত করা থাকলেই চলে।
সরকার কেন ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করে আইন আনতে পারে না? অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, ২৩টি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করে সরকার আইন আনলে তা মুদ্রাস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ব্যবসায়ীদের যদি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিয়েই ধান এবং গম কিনতে হয়, তাহলে প্রতি বছরই ক্রেতাদের আরও চড়া দামে বাজার থেকে এই সামগ্রীগুলি কিনতে হবে।
এই ব্যবস্থা রপ্তানির ক্ষেত্রেও প্রতিবন্দ্ধকতা সৃষ্টি করবে। কারণ, এমনও হতে পারে যে কোনও বছর ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে বিদেশের বাজারে ফসলের দাম কম। সেক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বেশি দামে ফসল কিনে কোনও ব্যবসায়ী কম দামে রপ্তানি করতে চাইবেন না। আবার দেশে বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কিনতে না পারলে একমাত্র ক্রেতা হিসেবে এফসিআই-এর একাধিপত্য সৃষ্টি হবে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থাকার অর্থ, যে ফসলগুলিতে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম দাম পাওয়া যায় সেই ২৩টির বাইরে অন্য ফসল চাষ করতে চাইবেন না কৃষকরা। তৈল বীজের মতো বিভিন্ন কৃষি পণ্যের জন্য এই কারণেই অন্য দেশ থেকে আমদানির উপরে নির্ভরশীল ভারত।

কীভাবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে এই জটিলতা কাটাতে পারে সরকার?
সরকারের দাবি, নতুন ব্যবস্থায় কৃষকদেরই আয় বাড়বে। শুধু তাই নয়, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা চালু থাকবে বলেও সরকারের কৃষকদের আশ্বস্ত করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, কৃষকদের আশ্বস্ত করতে প্রয়োজনে ফসলের দামে ভর্তুকি দেওয়ার পথ বেছে নিতে পারে কেন্দ্র। যে ব্যবস্থা মধ্যপ্রদেশে চালু আছে। যার অর্থ বাজার মূল্য এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের মধ্যে যে ঘাটতি থাকবে তা সরকার কৃষকদের মিটিয়ে দেবে।

সরকার আর কী কী আশ্বাস দিচ্ছে কৃষকদের?
সরকার কৃষকদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছে, তাঁদেরকে অতিরিক্ত আইনি সুরক্ষা দেয়া হবে। বকেয়া আদায়ের জন্য কোনও ভাবেই যাতে কৃষি জমি দখল না করা হয়, খড় পোড়ানোর জন্য কৃষকদের থেকে জরিমানা আদায় না করার মতো আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০ সংশোধন করে বেসরকারি বাজারগুলিকেও এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলির মতো নথিভুক্ত করানোর ব্যবস্থা হবে বলেও আশ্বস্ত করেছে সরকার। পাশাপাশি, ব্যবসায়ী বা বেসরকারি কোনও সংস্থার সঙ্গে বিবাদের ক্ষেত্রে কৃষকরা প্রয়োজনে ফৌজদারি আদালতেও যাতে যেতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও নতুন আইনে রাখতে রাজি হয়েছে সরকার। এ ছাড়াও বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কৃষকদের। সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ