পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া একটি জাতি কখনো উন্নত হতে পারে না, সভ্যও হতে পারে না। একটি জাতি জ্ঞান বিজ্ঞানে যত বেশি উন্নত, সে জাতির মানুষের জীবন যাত্রার মানও তত বেশি উন্নত। আজকের পৃথিবীতে যা কিছু আবিষ্কার, উন্নয়ন এবং অগ্রগতি, তার সবই শিক্ষার অবদান। সুতরাং জাতি হিসাবে যদি উন্নতি করতে হয়, জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হতেই হবে। শুধু তাই নয়, এই পৃথিবীতে বিদ্যমান সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলেও শিক্ষার বিকল্প নেই। আর এই শিক্ষার মান হতে হবে বিশ্ব মানের। এই জন্য সময়ের সাথে শিক্ষার মান বাড়ানো হতে হবে।
পরিচালনাগত দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত এবং অপরটি হচ্ছে বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি, দালান কোটা, যাবতীয় অবকাঠামোর প্রায় সবই সরকারি অর্থায়নে গড়া। সরকার প্রতিবছর এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ব্যয় মেটাতে বিরাট অংকের সহায়তা করে। বিশ্ববিদ্যালয় তার খরচের বাকী অর্থ ছাত্রদের কাছ থেকে ভর্তি ফি, টিউশন ফি এবং পরীক্ষা ফি বাবদ আদায় করে থাকে। এই ফি খরচের তুলনায় বরাবরই কম। এদেশের সাধারণ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। অপরদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি, দালান কোটা, যাবতীয় অবকাঠামোর সবই ব্যক্তির অর্থায়নে গড়া। সরকার এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ব্যয় মেঠাতে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা করে না। মূলত ব্যক্তির অর্থায়নে প্রতিষ্ঠার পর এসব প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি ফি, টিউশন ফি এবং পরীক্ষার ফি বাবদ অর্থ আদায় করে থাকে। আর এই ফি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের তুলনায় অনেক বেশি। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় পরিচালনা ব্যয় ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করা ফি দিয়েই মেটাতে হয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি অনেক বেশি। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীরা মোটা অংকের টাকা ব্যয় করেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করে। স্বাভাবিকভাবেই গরিব পরিবারের ছেলে মেয়েদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করার সুযোগ সীমিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মোটা অংকের টাকা ব্যয় করা সত্তে¡ও ছাত্রছাত্রীরা অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাক্সিক্ষত মানের শিক্ষা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।
সরকার শিক্ষার হার বাড়ানো এবং জাতিকে উচ্চ শিক্ষিত করার লক্ষ্যে বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের মতো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। একইভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি উদ্যোগে অনেকগুলো মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যেগুলো দীর্ঘদিন থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষা প্রদান করছে। সরকারি মেডিকেল কলেছের মতই এসব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এমবিবিএস এবং বিডিএস ডিগ্রি প্রদান করছে। সরকারি মেডিকেল কলেজের মতই এসব বেসরকারি মেডিকেল কলেজও বিএমডিসি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অনেক শিক্ষানুরাগী এবং সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবেই শিক্ষা কাযৃক্রম চলছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকগুলোর শিক্ষার মান যথেষ্ঠ ভালো। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর হাজাারো ছাত্রছাত্রী শিক্ষা লাভ করছে, ডিগ্রি অর্জন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোরই নিজস্ব ক্যা¤পাস নেই, খেলার কোনো মাঠ নেই, খোলামেলা কোনো পরিবেশ নেই। বহুতল ভবনের এক বা একাধিক ফ্লোর ভাড়া নিয়ে পাঠদান চলে। অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দক্ষ এবং পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, গবেষণাগার নেই এবং গবেষণাও নেই। বড় আকারের কোনো পাঠাগার নেই। আবার পাঠাগার থোকলেও সেখানে দেশ বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের বই পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। আবার শিক্ষকতায় নিয়োজিত অনেক শিক্ষকেরই উচ্চতর ডিগ্রি নেই, কোনো ধরনের পাবলিকেশন নেই। এমনকি কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ভিসিও নেই, রেজিষ্ট্রারও নেই, ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চলছে। অনেকেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়েই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে। মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের পরির্বতে অর্থ ইনকামই তাদের উদ্দেশ্য। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা ভর্তি হচ্ছে, লেখাপড়াও করছে এবং ডিগ্রি নিয়ে বেরও হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার মান উন্নত না হওয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে গিয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। আবার সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক ছেলেমেয়ে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনো করে উচ্চতর ডিগ্রির অধিকারী হচ্ছে। এদের কেউ কেউ পারিবারিক ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশুনা করছে আবার কেউ কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হয়ে যাচ্ছে। উচ্চ বিত্ত পরিবারে জন্ম হবার কারণে বরাবরই সমাজের উচ্চ লেভেলে তাদের যোগাযোগ এবং বিচরণ। ফলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জন করে তারা সহজেই চাকরিও পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চাকরি হলেও অনেকেই দক্ষতার অভাবে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না।
এ অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকেই গুরুত্ব তিদে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাদের সবাইকেই এক সাথে কাজ করতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়ার পাশাপাশি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি নির্দেশনা পরিপালন করছে কিনা এবং মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করছে কিনা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে তা মনিটরিং করতে হবে। এ জন্য সরকারকে যোগ্যতা স¤পন্ন জনবল নিয়োগ দিতে হবে। আর প্রতিষ্ঠাতাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা কোনো ব্যবসায়িক পণ্য না এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো অর্থ উপার্জনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও না। তাই শিক্ষা বিস্তারের মহৎ উদ্দেশ্য এবং জাতিকে শিক্ষিত করার মহৎ লক্ষ্য নিয়েই মানবতার কল্যাণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে। যত দ্রুত সম্ভব নিজস্ব ক্যা¤পাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। দেশ বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের বই দিয়ে নিজেদের পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করতে হবে। খেলাধুলা এবং বিনোদনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানসমূহে গবেষণাগার স্থাপন এবং গবেষণার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গরিব এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং যথা সম্ভব তাদের টিউশন ফি কমিয়ে নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এমনভাবে ফি আদায় করতে হবে, যাতে প্রতিষ্ঠানের খরচ এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত আসে। তার চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করে শিক্ষাকে কোনো অবস্থাতেই বাণিজ্যে পরিণত করা ঠিক নয়।
একটি উন্নত, সভ্য এবং প্রগতিশীল জাতি গঠন করতে হলে পুরো জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার বিকল্প নেই। একই সাথে মানসম্মত শিক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। যেন তেন প্রকারে ডিগ্রি অর্জন একটি জাতির উন্নয়নে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারে না। অশিক্ষিত ব্যক্তি যেমন জাতির বোঝা, তেমনি মানহীন শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিও জাতির বোঝা। কারণ, শিক্ষিত হলেও দক্ষতা কম হবার কারণে তারা সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে না। তারা সমস্যা সমাধানও করতে পারে না, বরং নিজেরাই সমস্যা সৃষ্টি করে। একজন অদক্ষ ড্রাইভার ড্রাইভিং সিটে বসে যাত্রীদের জন্য যেমন বিপদ ডেকে আনে, তেমনি অদক্ষ মানুষ নেতৃত্বের আসনে বসে প্রতিষ্ঠানের জন্য, সমাজের জন্য এমনকি দেশের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুতরাং সার্টিফিকেট অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞান অর্জনে দক্ষ হতে হবে। তার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মানসম্মত শিক্ষা পদান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তার শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞান অর্জনের সুযোগ এবং পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে সততা, নৈতিকতা, বিবেকবোধ এবং মানবিকতাবোধ সৃষ্টি করে। অতএব, জাতি হিসাবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের সবাইকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। তার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানকে নিশ্চিত করতে হবে। আর এটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।