পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কিছু পদ, পদবী ও পদধারী ব্যক্তি রয়েছেন যাদের ভিভিআইপি বা ভিআইপি বলে সর্বক্ষেত্রে প্রটোকল প্রদান করা হয়। প্রটোকল একটি আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার। ভিয়েনা কনভেনশন অব ডিপ্লোমেটিক রিলেশন-১৯৬১, ভিয়েনা কনভেনশন অন কনস্যুলার রিলেশন-১৯৬৩ এবং কনভেনশন অন দি প্রিভিলেজ এন্ড ইমমিউনিটিজ অব দি ইউনাইটেড নেশনস-১৯৪৬ ছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সময়ে সময়ে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে ভিআইপি এবং ভিভিআইপি’দের পদমর্যাদা মোতাবেক তাদের সাথে কী ধরনের শিষ্টাচার করা উচিৎ তা নির্ধারণ করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিগণ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, রাষ্ট্রীয় পতাকা বহনকারী ব্যক্তি, র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর প্রধান, বিশেষ করে দেশ রক্ষার বিভিন্ন বাহিনী প্রধান প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রটোকল পাওয়ার এখতিয়ার রাখে। তারা কোথায় কার সাথে বসবেন, কার ডান পাশে বা বাম পাশে বসবেন, ডিনার বা লাঞ্চ করার পর কাটাচামচ বা চামচ কীভাবে রাখবেন তাও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার সম্পর্কিত বইতে লিপিবদ্ধ আছে। ভিভিআইপিরা শুধু আমাদের সম্মানীয় নন, বরং তারা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশ ও জাতি সর্বসময়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে গর্ববোধ করে।
যাদের উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তারা অবশ্যই দেশ ও জাতির সম্পদ এবং তাদের প্রতিটি কথা, আচরণ, প্রতিটি কর্ম দেশের নাগরিকগণ সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সমালোচনা করার অধিকার দেশবাসীর রয়েছে। কারণ ভিভিআইপি’রা যখন উক্ত পদে আসীন হয়ে যান তখন তাদের ব্যক্তিগত স্বাদ-আহ্লাদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার চেয়ে জনগণের চাহিদাই মুখ্য হয়ে যায়। জনগণ যেমন রাষ্ট্রীয় বিধিমালার আওতায় রয়েছে, ঠিক তেমনি ভিআইপি বা ভিভিআইপি’রা কোনো প্রকারেই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
সম্প্রতিকালে ক্যাসিনো সম্রাট, মাদক সম্রাট, ভূমিদস্যু ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে র্যাব অনেকগুলি অভিযান পরিচালনা করেছে। তাতে উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় ভিআইপি এবং ভিভিআইপিদের সংযুক্ত ছবি ফ্রেম বন্ধী অবস্থায় দেখা গিয়েছে। অভিযুক্তরা এ ছবিগুলি প্রদর্শন করে নিজেদের অপকর্ম, অন্যায়, অত্যাচার, চোরাচালান, মানি লন্ডারিং ও একচ্ছত্রভাবে ঠিকাদারী ব্যবসা করেছে। এ উদ্দেশ্যেই ভিভিআইপি’দের সাথে তারা সুকৌশলে ছবি তোলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এতে লাভবান হয় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা, যারা অপরাধ জগতের গড ফাদার এবং হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল হিসেবে চিহ্নিত। তাদের ব্যবসা, ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি ও সমাজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করার জন্য সুকৌশলে ফটোসেশনের এ কাজগুলি করে থাকে। কিন্তু এ ছবিগুলি দেখে দেশপ্রেমিক ও দেশের বিবেকবান মানুষগুলির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এ রক্তক্ষরণ থেকে জাতিকে হেফাজত করার দায়িত্ব অবশ্যই ভিআইপি ও ভিভিআইপি’দের উপর বর্তায়।
যখনই তারা তাদের অপকর্মের জন্য ধরা পড়ে, তখন সরকারি দলের সম্পৃক্ত হলে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বলা হয় যে, তারা অনুপ্রবেশকারী এবং অন্যদল থেকে এসেছে। যারা অন্যদল থেকে অনুপ্রবেশকারী তাদের সাথে ভিআইপি বা ভিভিআইপি ব্যক্তিরা পাশে বসিয়ে কেন ছবি তোলেন? ভিআইপি বা ভিভিআইপি’দের এ ধরনের খামখেয়ালীপনা জাতির জন্য অশনি সংকেত। এ সব ফটোসেশনের পিছনে রহস্য কী তাও উৎঘাটিত হওয়া দরকার। একজন ব্যক্তি আমার নিকট এসে বলেছিল যে, আমি যুবদল করি, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনে আমি আপনার সমর্থন চাই। তখন আমি তাকে সমর্থন দেই নাই। এখন দেখা যায়, সরকারি দলের সমর্থনে সে ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, যার বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক ভ‚মিদস্যুতার অভিযোগ রয়েছে এবং তার সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
প্রটোকলের গুরুত্ব:
(১) প্রটোকলের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কিত বিধিমালা প্রণীত হয় এবং এসব বিধিমালার তত্ত্বাবধান করা হয়।
আধুনিককালে প্রটোকল বলতে সেসব বিধিমালাকে বুঝায়, যার মাধ্যমে প্রতিটি দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কিত নিয়মাবলির ব্যবহার করেন। প্রটোকলের মাধ্যমে একদিকে যেমন বিভিন্ন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের নানাবিধ বিষয়াদি স্থির করা হয়, অন্যদিকে তেমনি একটি কূটনৈতিক মিশনের দৈনন্দিন কার্যাবলি নির্ধারিত হয়।
(২) প্রটোকল ব্যক্তি বিশেষকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিমন্ডলে স্ব স্ব উপযুক্ত স্থানে সমাসীন করে, সরকারি পদধারীদের নিজ নিজ এখতিয়ার প্রয়োগের নিশ্চয়তা বিধান করে।
(৩) প্রটোকল প্রত্যেকের দৈনন্দিন কাজকর্মের স্বাধীনতা প্রদান করে এবং জাতীয়, আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের ও ব্যক্তি বিশেষের কর্মকান্ডকে পরিচালিত করে। প্রটোকল সরকারি অনুষ্ঠানাদির পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া, সরকারি ও ব্যক্তি যোগাযোগের নীতিমালা, পোশাক-পরিচ্ছদের শিষ্টাচার ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় নির্ধারণ করে, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি সরকার ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত উপায়ে এবং স্বীয় প্রাধিকার মোতাবেক পদ এবং মর্যাদা পেতে পারেন।
(৪) প্রটোকল বিধিমালার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিভিন্ন দেশ এবং তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে সদ্ভাব সৃজন করা। আনুষ্ঠানিক সভা-সমাবেশে পদমর্যাদা অনুসারে ব্যক্তি বিশেষগণ নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। এসব ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো অশোভনীয়। তাই নিয়মের ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে দায়ী ব্যক্তিদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। বিশেষ করে যে সব ক্ষেত্রে মহিলারা জড়িত সেসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে Stanley Woodward এর একটি মন্তব্য স্মরণ করা যায়, A prime purpose of protocol is to create an atmosphere of friendliness in which the business of diplomacy may be transacted, the rules of diplomacy tend to be reciprocal through out the world.
প্রটোকল সংলাপ ও সমঝোতাকে পরিচালিত করে এবং ভাবগম্ভীর ও আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশের আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগকে ফলপ্রসূ করে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এককালীন চিফ অব প্রটোকল মি. স্ট্যানলি উডয়ার্ড (Mr. Stanley Woodward) তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধের (Protocol: What it is and what it does?) (১৯৪৯) মধ্যে যে বক্তব্য রেখেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। Protocol is the rule book by which international relations are conducted. Any organization, any society must if it is to thrive, operates under certain rules if for no other reason than to prevent chaos. The same rules apply to relations between governments. It is necessary that contacts between nations be made according to law, and some form of planned organisations. (সূত্র: মো. নজিবুর রহমান সম্পাদিত প্রটোকল ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার, পৃষ্ঠা ৯/১০)।
উক্ত বইয়ের তিন নং অনুচ্ছেদে ‘ব্যক্তি যোগাযোগ নীতিমালার’ প্রতি অতীব গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। ভিভিআইপি এবং ভিআইপিরা ব্যক্তিগত যোগাযোগের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় স্বার্থে কোনো কারণেই এড়িয়ে যেতে পারেন কি? আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, একজন ব্যক্তি পদ-পদবীর কারণে যখন ভিভিআইপি বা ভিআইপি আসনে অধিষ্টিত হন, তিনি তখন রাষ্ট্রের হয়ে যান, কোনো কারণে আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারে (প্রটোকল) পড়ে না এমন ব্যক্তিদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের কারণে পাশে বসিয়ে ছবি তোলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? এতে কে লাভবান হচ্ছে এবং কে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ?
দুর্যোগে, দুঃসময়ে জাতি তার পাশে জাতির অভিভাবকদের দেখতে চায়, কিন্তু দেখতে চায় না মানি লন্ডারিং, ক্যাসিনিও, মাদক, অস্ত্র, ভ‚মিদস্যু প্রভৃতিদের, যারা অক্টোপাশের মতো জাতিকে গিলে ফেলছে। তারাই ভিভিআইপি বা ভিআইপিদের সাথে সুকৌশলে ছবি তুলে মার্কেটিং করে ফায়দা লোটে। ভিভিআইপি বা ভিআইপিরা কি এ খবর রাখেন? যারা বিভিন্ন অপকর্মে গণবিরোধী কাজে জড়িত রয়েছে, তারা যখন ভিভিআইপি বা ভিআইপি’দের সাথে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় তখন কি তা প্রটোকল ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী হয় না?
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।