Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মেডিক্যাল বর্জ্যে মারাত্মক হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

জান্নাতুল মাওয়া নাজ | প্রকাশের সময় : ২০ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মেডিক্যাল বর্জ্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পরিবেশগত ইস্যুগুলো স্বাস্থ্যখাতে জনসচেতনতা লাভ করা সত্তে¡ও, হাসপাতালগুলোতে এগুলোর যথাযথ সুরাহা করা হচ্ছে না। এসব বিষয়ের মধ্যে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থপনা (এমডাব্লিওএম) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ মেডিকেল বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনার সংক্রমণের ফলে বেড়েছে মাস্ক, গ্লাভস, পারসোনাল প্রটেকশন ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই), স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার। কিন্তু, নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় ব্যবহারের পর এসব সুরক্ষা সামগ্রী যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে করোনা বর্জ্যের ফলে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্যের মাত্র ৬.৬ ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়। বাকি ৯৩.৪ ভাগ বর্জ্যই সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি পরিচালিত কোভিড-১৯ মহামারিকালে কার্যকর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে মেডিকেল বর্জ্য এখন বড় সমস্যা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনাকালে এই সমস্যা আরো প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ এর বিধিবিধান পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন আদালত। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) জুন মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২৫০ টন মেডিকেল বর্জ্য সংগৃহীত হয়েছে। আর করোনাকালে তা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন।

দেশে প্রতিদিন উৎপন্ন মেডিকেল বর্জ্যের পরিমাণের সঠিক হিসাব নেই। তবে মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল ও ৫ হাজার ৫৫টি বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯০৩টি। প্রতিটি শয্যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ৬৩ থেকে ১ দশমিক ৯৯ কেজি মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার পর এটা আরো বাড়তে পারে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মেডিকেল বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের মধ্যে ৪০ লাখই শিশু।

৮ মার্চের পরে এসব মেডিকেল সরঞ্জামাদির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভ মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ফেলার বিধান থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতাল তা মেনে চলছে। তাছাড়া, বেশিরভাগ মানুষই এইসব মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার জীবাণুমুক্ত না করে যত্রতত্র ফেলে দিচ্ছে। এই মেডিকেল বর্জ্যগুলো একদিকে যেমন সংক্রমণের ব্যাধি ছড়ানোর মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে আবার পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েও দাঁড়াচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এই বর্জ্যগুলো বৃষ্টির পানির সাথে মিশে বিভিন্ন খাল, ডোবা, নদ-নদীর পানিতে যায়। ফলে পানি দূষিত হয়। আবার মেডিকেল বর্জ্যগুলোর জীবাণু বাতাসে মিশে বায়ু দূষিত করে।

গবেষণায় আরও উঠে আসে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী থেকে প্রতিদিন ২৮২.৪৫ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার পুরোটাই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে অপসারণ করা হয়। মাস্কসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন ৭১ ভাগ মানুষ, যার সিংহভাগই শহুরে। যারা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তাদের ১০০ ভাগই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে তা অপসারণ করেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও জানিয়েছেন তারা প্রায় সব বাড়ি থেকেই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্যের বর্জ্য পান। যদিও ৮১.৪ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন এসব বর্জ্য থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা আছে এবং ৯০.৬ ভাগ মানুষ মনে করেন এসব বর্জ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

মেডিকেল বর্জ্যসহ আমরা যে প্রতিনিয়ত চা, কফি, জুস, মুদির দোকানের পলিথিন ব্যবহার করছি তা ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। ফলে দূষিত হচ্ছে মাটি। পরিবেশের তিনটি উপাদান মাটি, পানি, বায়ু দূষিত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের জীববৈচিত্র্যের উপর, জলবায়ুর উপর। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল রোগ দেখা যাচ্ছে যেমন- শ্বাসকষ্ট, হার্ট অ্যাটাক, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি। বেড়ে যাচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মেডিকেল বর্জ্যসহ প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যবহৃত এসব বর্জ্য ভ‚মি ক্ষয় করে। জমির উর্বরতা কমে গেলে ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে খাদ্যসঙ্কট। যা আমাদের অর্থনীতে চরম প্রভাব ফেলবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষা প্রয়োজন।

একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসা বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, হাসপাতাল ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মেডিকেল বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অথচ বাংলাদেশে মেডিকেল বর্জের নিরাপদ নিষ্কাশনের কার্যকর ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। মেডিকেল বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশনের মানদন্ডে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব বাড়ানো দরকার। ২০০৮ সালে মেডিকেল বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশন নিয়ে আইন হলেও তা খুবই দুর্বল কিংবা যুগোপযোগী নয়। তাই আইনটি সংশোধনের দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত কলেবরে বেড়েছে, ডিসপোজিবল বা একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবহারও উল্ল্যেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই বর্জ্যের বেশির ভাগই সংক্রামক, এগুলোর মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ বাড়তে পারে। চিকিৎসা বর্জ্যকে অবশ্যই জনস্বাস্থ্যসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকরী হবে না, বর্তমান নাগরিক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করত পারবে না। ২০০৮ সালের মেডিকেল বর্জ্য নিষ্কাশন সংক্রান্ত আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। কেননা কার্যকারিতা কম হওয়ায়, হাসপাতালের মেডিকেল বর্জ্য এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল বর্জ্যসমূহ নির্দেশনা মেনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করি, তারা এগুলো যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ফেলব। একই সাথে জনগণকে সচেতন করা দরকার। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এক করে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থপনার জন্য কালার কোড অনুযায়ী ময়লা উৎপাদনস্থল আলাদা করতে হবে। পরিবহন বর্জ্য খোলা অবস্থায় পরিবহন করা যাবে না এবং হাসপাতালের নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশনে জমা করতে হবে। বর্জ্যের শ্রেণিভেদ অনুযায়ী এগুলো ব্যবস্থপনা করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কিছু মুনাফালোভী অসাধু চক্রডিসপোজাল আইটেম যেমন, সিরিঞ্জ, স্যালাইন সেট, গাউন এগুলো ডাম্পিং স্টেশন থেকে চুরি করে আবার বাজারে ছেড়ে দেয় এটি মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। সাধারণ বর্জ্যগুলো শুধুমাত্র সঠিকভাবে প্যাকেজিং করে আলাদাভাবে ডাম্পিং করতে হবে। হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না করা গেলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এবং আমরা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ব। এজন্য স্ব স্ব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আইসোলেশন সেন্টারগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থপনা চালু করা দরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে চলা অপরিহার্য। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করে, সংক্রমণ কমানো উচিত। এভাবে আমরা বিপজ্জনক বর্জ্য থেকে নিজেদের ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে পারব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জনস্বাস্থ্য

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন