পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারহীন হত্যাকান্ড, জনপ্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ দেশের প্রতিটি সেক্টরে লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট, দখলবাজি, সন্ত্রাস, খুন-ধর্ষনের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সারাদেশ। দলমত নির্বিশেষে দেশের প্রায় সব মানুষই এই ভয়াবহ অবক্ষয় ও এর পাশবিকতার বিস্তার নিয়ে শঙ্কিত-সংক্ষুব্ধ। দেশের মানুষ এখন ধর্ষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। ধর্ষনের শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি ইতিমধ্যে মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু এখন কেন হত্যা-ধর্ষণের এই মচ্ছব সারাদেশে বিস্তার লাভ করেছে, এর জন্য কারা কিভাবে দায়ী তার নানামুখী বিচার-বিশ্লেষন, রাজনৈতিক বেøইম-গেম ও কাদা ছোঁড়াছুড়ি দেখা যাচ্ছে। দেশের শাসকশ্রেণী এবং শাসকদলগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়,দুর্নীতি, লুটপাট, বিচারবর্হিভুত হত্যাকান্ড ও সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, খুন-ধর্ষনের ঘটনাগুলোর জন্য কোনো একক রাজনৈতিক দল বা পক্ষ দায়ী নয়। স্বাধীনতাত্তোর ক্ষমতাসীন সকল রাজনৈতিক পক্ষগুলো এর জন্য দায়ী হলেও এ কথা স্বীকার করতেই হবে সবার দায় সমান নয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সামাজিক অবক্ষয় গত এক যুগে মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করেছে। প্রায় এক দশক আগে ঢাকার রাজাবাজারে নিজ বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন। নিহতদের ব্যবহৃত ল্যাপটপ ছাড়া বাসার আর কোনো কিছু চুরি হয়নি। ধারণা করা যায়, তাদের ল্যাপটপে এমন কিছু ছিল যা’ প্রকাশিত হলে কোনো প্রভাবশালী মহলের মুখোশ খুলে যেত। এ কারণেই সেই হারানো ল্যাপটপ উদ্ধার হলেই সাগর-রুনি হত্যার মূল মোটিফ খুঁজে বের করা সম্ভব হত বলে সে সময় অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন। এই হত্যাকান্ডে দেশের সাংবাদিক সমাজ সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে প্রতিবাদে রাজপথে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি সাগর রুনীর হত্যাকান্ডের কান্ডের পর ১২ ফেব্রয়ারী যে হত্যা মামলা হয়েছিল সে মামলায় ন্যায় বিচারের আশা ইতিমধ্যে ভুক্তভোগি দুই সাংবাদিক পরিবার ছেড়েই দিয়েছেন। আদালতে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’। এমন একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে গত ৯ বছরে ৭৩ বার তারিখ পরিবর্তন করেও ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীরা। সাংবাদিক দম্পতির কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল না, ক্ষমতার দ্ব›দ্ব ছিল না। তারা ছিলেন নেহায়েত পেশাদার সাংবাদিক। এই হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় ৯ বছর পরেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে এই ব্যর্থতার দায় আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার।
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোডের শ্যামলাপুর পুলিশ চৌকিতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমারের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান নিহত হন ৩১ আগস্ট কোরবানি ঈদের আগের রাতে। এই ঘটনায় দেশের পুলিশ বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত দুই বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরা এক সাথে মিলিত হয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলন কলে সে আশঙ্কা থেকে মানুষকে মুক্ত করেন। তবে এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারের মেরিনড্রাইভ ও সীমান্তে মাদক ব্যবসা, বিচারবর্হিভুত হত্যান্ড এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বছরে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের এক ভয়ানক চিত্র বেরিয়ে আসে। ভুক্তভোগী অনেক মানুষ অপরাধি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শুরু করে। ওসি প্রদীপের সময় যা কেউ ভয়ে কল্পনাও করতে পারত না। ওসি প্রদীপের গড়ে তোলা চক্রের হাতে দুই বছরে দুই শতাধিক নিরপরাধ মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই ওসি প্রদীপ নাকি এখন কারাগারে বিশেষ মর্যাদায় আয়েশে দিন কাটাচ্ছে। যাদের ছত্রছায়ায় ওসি প্রদীপরা এমন ভয়ঙ্কর কিলার হয়ে হয়ে উঠেন, তারা যদি সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন, ভয়ঙ্কর সব হত্যাকান্ডের ঘটনা জনসমাজে উন্মোচিত হয়ে পড়ার পরও যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরা এসব দুর্ধর্ষ অপরাধিরা কারাগারে-আদালতে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে আয়েশে দিন কাটাতে পারে আর নানাভাবে বিচারকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা করে তাহলে তাদের শেঁকড় কতটা মজবুত আর কতটা বিস্তৃত তা সহজেই অনুমেয়। আরেকটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৭জন অপহরণ ও খুনের মামলায় তিন বছরের মাথায় ২০১৭ সালে বিভিন্ন বাহিনীর ২৬ জন বিভিন্ন স্তরের সদস্যের সাজার রায় ঘোষিত হয়। দেশের ইতিহাসে এমন রায়ের নজির সম্ভবত এটাই প্রথম। কিন্তু রায়ের পর ইতিমধ্যে আরো প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও ফাঁসির দন্ড প্রাপ্ত মূল আসামীরা এখনো আদালতে হাজিরা দিতে এসে দাঁত কেলিয়ে হাসে।
গত কয়েক বছর ধরে দেশে একের পর এক কেলেঙ্কারি, নির্মম ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে চলেছে। একটি ঘটনায় তোলপাড় শুরু হওয়ার পর তা জনমনে যে ভীতি ও সংক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে তারচেয়েও মর্মান্তিক ও চাঞ্চল্যকর আরেকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজে নতুন চাঞ্চল্য দেখা দিচ্ছে এবং আগের ঘটনাটি ভুলে গিয়ে মানুষ নতুন ঘটনার উপর মনোনিবেশ করে এর বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠছে। সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের ক্রসফায়ারে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় তোলপাড় অবস্থার রেশ থেমে যাওয়ার আগেই সেপ্টেম্বরে সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগ নেতাদের নারী ধর্ষনের ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। সারাদেশে সেই ঘৃন্য ঘটনার ঢেউ আছড়ে পড়তে না পড়তেই একমাস আগে নোয়াখালির বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও ক্লিপ গত ৪ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর এখন সারাদেশে ধর্ষন বিরোধি সামাজিক গণআন্দোলনে পরিনত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া ও রাজনৈতিক পরিচয়ের যোগসুত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের ফলে সংঘটিত অপরাধ ও অবক্ষয়ের চরম দুর্যোগ লক্ষ্য করা যায়। দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার, মানব পাচার, মাদক কারবার, সন্ত্রাস-টেন্ডারবাজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পিটিয়ে শিক্ষার্থী হত্যা, নানা স্থানে প্রতিদিন অগুনতি নারীধর্ষন এবং শহরে-জনপদে শত শত কিশোর গ্যাং ও গ্যাং কালচার গড়ে ওঠার পেছনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণ নিয়ে এখন নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। সেখানে বারংবার উঠে আসছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা। কিন্তু স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টির পেছনে যে সব বিষয় কাজ করছে তার উপর যথাযথ ও পর্যাপ্ত আলোক প্রক্ষেপনের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলে আমার মনে হয়। এটি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর দুরারোগ্য ব্যাধি হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেও এই মারণ ব্যধি থেকে মুক্তির যাত্রা কোথা থেকে শুরু করতে হবে তা যেন কেউই ঠিকমত চিহ্নিত করতে পারছেন না।
আজকের সামাজিক অস্থিরতা, অবক্ষয়, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, নারী ও শিশু ধর্ষন, কিশোর গ্যাং কালচার, মাদকাসক্তি, পর্ণগ্রাফির মত সামাজিক-মানবিক সমস্যাগুলোর জন্য মোটা দাগে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয়, শৈথিল্য ও ব্যর্থতার কথা বলা হলেও এর উত্তরণের জন্য যদি কোনো সুনির্দ্দিষ্ট সেক্টরের কথা বলা যায়, তা হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাদর্শন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা, বৈষম্য, দলীয়করণ, মুনাফাবাজি, জাতীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে লক্ষ্যহীন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অনৈতিক শিক্ষা কারিকুলাম আমাদের আজকের সর্বব্যাপী অবক্ষয়ের মহামারীর জন্য দায়ী। অতীতে দারিদ্র্য বা সম্পদের অপ্রতুলতা কখনো আমাদের জন্য এমন সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেনি। কিছু দর্নীতিবাজ, তস্কর ও নৈতিকভাবে স্খলিত মানুষ সব যুগে সব সমাজেই ছিল এবং থাকবে। কিন্ত বেপরোয় নীতিহীন দুর্বৃত্তদের নিয়ে গড়ে ওঠা দুষ্টচক্র পুরো সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভ’মিকায় আসীন হওয়ার এমন নজির গত হাজার বছরেও আমাদের সমাজে আর কখনো দেখা না গেলেও খৃষ্টীয় অষ্টম শতকে বাংলায় পাল রাজবংশের শেষদিকে যে অরাজক বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখা গিয়েছিল ঐতিহাসিকেরা তাকে মাৎস্যন্যায় বলে অভিহিত করেছেন। তবে দুই হাজার বছর আগে লেখা চানক্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের অরাজক পরিস্থিতিকে মাৎস্যন্যায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যখন দন্ডদানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন আইন প্রয়োগকারি সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবেই। মাছের রাজ্যে যেমন অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোট মাছকে গ্রাস করে। বাংলায় পাল শাসনের শেষদিকে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রায় ১২শ বছর পর এই ভাডিট বাংলায় কি সেই মাৎস্যন্যায়ের যুগ ফিরে এসেছে। আজকের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরীখে ইতিহাস সচেতন মহলের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষা হচ্ছে মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করার অন্যতম অনুঘটক। এ কারণে রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আমাদের সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে অভিন্ন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও স্বাধীনতার পর অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে এসেও আমাদের রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার প্রভাব এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। শিক্ষায় নানা ধরণের বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা, যথেচ্ছ অনৈতিক মুনাফাবাজির কারণে পুরো শিক্ষাকাঠামো কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক একটি অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও মুনাফাবাজি ও জিম্মিদশায় উপনীত হয়েছে। রাজধানী শহর থেকে প্রতিটি বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরে ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু তথাকথিত নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেনতেন প্রকারে শতভাগ পাস এবং উচ্চহারে জিপিএ-ফাইভ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে তারা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে অনেকটা পণবন্দীর মতো আচরণ করে থাকে। বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্রে স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দূরের কথা স্কুলের থার্ড গ্রেড পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই নেয়া হয়না। খেলাধুলা ও বাস্তব প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণের মত শিশুদের জন্য একটি আনন্দদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। আমরা কি দেখছি? তথাকথিত নামি-দামি স্কুলে ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষা ও কোচিং করতে হয় শিশুদের। আট-দশ বছরের শিশুর পিঠে ৫-৭ কেজি ওজনের বই চাপিয়ে দেয়া হয়। শ্রেণী পাঠের পাশাপাশি বিশেষ কোচিং, বিষয়ভিত্তিক প্রাইভেট কোচিং ছাড়া ভাল রেজাল্ট করা প্রায় অসম্ভব। এভাবেই শিক্ষাকে একটি অবশ্যম্ভাবী বাণিজ্যিক মুনাফাবাজির পণ্যে পরিনত করা হয়েছে। এর ভুক্তভোগি সমাজের প্রায় প্রতিটি মানুষ।
এই করোনাকালে সারাবিশ্ব যখন একটি অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমরান তখন দেশব্যাপী শিশু ও নারী ধর্ষণের মহামারীতে তলিয়ে যেতে বসেছি। শতকরা ৯০ভাগ মুসলমানের এই দেশে এমন সামাজিক অবক্ষয় ও নীতি-নৈতিকতার স্খলনের শুরু মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈষম্য, মুনাফাবাজি, বিশৃঙ্খলা ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব না হলে এই সমাজকে দুর্নীতি,লুটপাট, সস্ত্রাস ও ধর্ষনের মত সামাজিক ক্যান্সার থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের চালকের আসনে সরকারের যে সব প্রভাবশালী আমলা, রাজনৈতিক দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রী, পুলিশের কর্মকর্তা, আদালতের বিচারক- উকিল, শিক্ষক, সংবাদকর্মী, লেখক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, বড় বাজারের আড়তদার, আমদানিককারক, মজুদদার বসে আছেন তারা প্রায় সবাই একটি অনৈতিক দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িতদের মধ্যে যে যত বেশি সার্টিফিকেটধারি উচ্চশিক্ষিত ও প্রভাবশালী সে তত বেশি সম্পদের মালিক, আইনের শাসনের প্রতি বেপরোয়া। আর আইনের রক্ষকরাও আইন ও সুশাসনের সাধারণ স্পিরিটকে একটি হীন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির মানদন্ডে আরোপ করতে গিয়ে সমাজকে বিচারহীনতা এবং দুর্নীতি-ধর্ষনের থাবার নিচে বলি দিতে সহায়কের ভ’মিকা পালন করছে। এর জন্য প্রথম দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। শিক্ষার জন্য, পাবলিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য অভিভাবকদের কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন চাকুরীজীবী অভিভাবকের পক্ষে বেতনের টাকায় সংসার চালানোর পাশাপাশি দুই-তিন সন্তানকে তথাকথিত নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করানো সম্ভব নয়। এ জন্য তাকে ঘুৃষ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে শহরের বেসরকারি নামিদামি স্কুল-কলেজগুলোর মালিকরা বছরশেষে নতুন শাখা, নতুন ক্যাম্পাস এবং জৌলুসের মহড়া দিচ্ছেন। এই বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পৃক্ত নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতির দায় বহন করছি আমরা। আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দুর্নীতি-লুটপাট ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের মূল উৎসই হচ্ছে অনৈতিক শিক্ষা কারিকুলাম, বিশৃঙ্খল ও বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা এবং নীতিহীন-দলবাজ শিক্ষক সমাজ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।