পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নাগরনো কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার উত্তেজনা এখন ভয়ঙ্কর সম্মুখযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত ৯ দিনে দুই পক্ষের শত শত সেনাসদস্য হতাহত, যুদ্ধুবিমান, ড্রোন, আর্টিলারি যান ও ট্যাংক বিদ্ধস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যুদ্ধবিরতির কোনো ক‚টনৈতিক তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না। সেই প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার জটিল বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং জর্জিয়ার মাধ্যমে ককেশাস অঞ্চলে একটি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্য দিয়ে যে ভ‚-রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছিল তা নিরসনের কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কখনো গ্রহণ করা হয়নি। প্রায় প্রত্যেক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি এ আঞ্চলিক বিরোধকে নিজের মত করে স্বার্থ হাসিলে কাজে লাগাতে সচেষ্ট রয়েছে। রাশিয়া দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে নিজেদের সম্প্রসারণবাদী নীতি বজায় রাখার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের বিরোধ-বিস্বম্বাদ জিইয়ে রেখেছে। গত তিন দশক ধরে ফিলিস্তিন, ইসরাইল, লেবানন, ইরান ও তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যে রিজিম চেঞ্জে’র টার্গেট নিয়ে যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে, তা কার্যত ব্যর্থ হলেও এ অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগনের মধ্যকার সংহতিকে চরমভাবে ব্যহত করা হয়েছে। এর ফলে একের পর এক আঞ্চলিক দ্ব›দ্ব সংঘাতে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ব্যবসা, অধীনতামূলক নিরাপত্তাচুক্তি এবং জনগণের সম্পদের উপর পশ্চিমা হরিলুট নিশ্চিত করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরনাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি পশ্চিমা বশংবদ আরব রাজপরিবারকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে ফিলিস্তিন সমস্যাকে আরো জটিল ও দূরূহ করে তুলেছেন। ইরানের সাথে ২০১৫ সালে সম্পাদিত ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে গিয়ে ইরানের উপর নতুন কঠোর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পাশাপাশি সামরিক আগ্রাসন চালানোর ইসরাইলী ও মার্কিনী পরিকল্পনা ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ বছরের একেবারে শুরুর দিকে বাগদাদ বিমান বন্দরে ইরানের আলকুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সুলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যার মধ্য দিয়ে ইরানকে যে নতুন বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাটিতে মিসাইল হামলার মধ্য দিয়েই তার কঠোর জবাব দিয়েছে ইরান। সুলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ এখনো শেষ হয়নি বলে সম্প্রতি ইরানের পক্ষ থেকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
রাজতান্ত্রিক শাসন অথবা নিজেদের বশংবদ শাসক বসাতে না পারলে পশ্চিমারা কোনো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে ইচ্ছুক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর গত সাত দশকে এটা বার বার প্রমানিত হয়েছে। বিশেষত মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলের উপর আধিপত্য কায়েম রাখতে বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে এক প্রকার অঘোষিত বোঝাপড়া লক্ষ্য করা যায়। মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, মধ্য এশিয়া , বসনিয়া, চেসনিয়া, ককেশাস অঞ্চল ও আরাকানের মুসলমানদের ঐতিহাসিক বিরোধের সাথে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি, রাশিয়া ও চীনের ভ‚মিকার মধ্যে খুব একটা বড় পার্থক্য দেখা যায় না। এই মুহূর্তে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে যে সামরিক সংঘাত চলছে তার পুরোটা আঁচই লাগছে মুসলিম বিশ্বের অগ্রসর ও নেতৃত্বশীল রাষ্ট্র তুরস্ক, ইরানের মত দেশগুলোর সীমানার মধ্যে। এ কারণেই এই যুদ্ধ আমাদেরকে আশির দশকের আট বছরব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমা ভ‚-রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি না থাকলে যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরেই একটি শান্তিপূর্ণ যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। দু:খজনক হলেও এখানে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বাস্তবতা উঠে আসে। মুসলমানের প্রতিপক্ষ যদি কোনো অমুসলিম রাষ্ট্র হয় এবং বিরোধ বা যুদ্ধের জের বা ফলাফল যদি শেষ পর্যন্ত মুসলমানের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, ঠিক তখনি পশ্চিমা শক্তিগুলো ব্যাপক ক‚টনৈতিক লম্ফঝম্ফ শুরু করে দেয় এবং কৌশলগত প্রতিপক্ষের সামরিক-রাজনৈতিক বিজয় প্রতিহত করতে যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দেয়। পশ্চিমা সামরিক শক্তি ও সহায়তায় বলিয়ান হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভ‚মি জবরদখল প্রক্রিয়ায় ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সাল এবং ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘকে এই ভ‚মিকায় দেখা গেছে। এতগুলো আরব দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ইসরাইলের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। আকষ্মিক ত্বরিৎ বিমান হামলায় প্রতিবেশি বিমান বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করার পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার জমি দখলে নেয়ার কৌশল বাস্তবায়নের পর পশ্চিমা ক‚টনৈতিক তৎপরতা ও মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হলেও দখলকৃত ভ‚মি আরবদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ তাদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। ১৯৬৭ সালে দখলকৃত ফিলিস্তিনী ভ‚খন্ড, গোলান মালভ‚মিসহ সিরিয়া, লেবাননের ভ‚মি নিয়ে এখনো ন্যক্কারজনক সম্প্রসারণবাদী খেলায় মেতে আছে ইসরাইল ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রকারীরা।
ফিলিস্তিন, জেরুজালেম, আরব-ইসরাইল সংকট এবং নাগরনো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণসহ মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক বাস্তবতার সাথে অটোমান সা¤্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাসের অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনের যুদ্ধগুলোর সাথে যেমন একেকটা সা¤্রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল তারই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এখনো ঘটমান রয়েছে। আজারবাইজানের অন্তর্গত পাবর্ত্য নাগরনো-কারাবাখ শত শত বছর ধরে তুর্কি সুলতানদের নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর আঞ্চলিক বাস্তবতায় ককেশাস অঞ্চলের বড় অংশই সরাসরি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অবশ্য আরো শত বছর আগে রুশ-পার্সিয়ার যুদ্ধে এই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ১৮০৪- ১৮১৩ সালে সংঘটিত ৯ বছরব্যাপী রুশ-পার্সিয়ার যুদ্ধে পারস্যের পরাজয়ের পর ১৮১৩ সালের গুলিস্তান চুক্তিতে নাগরনো-কারাবাখের উপর আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়া হয়। প্রতিটা যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে মানচিত্র ও ভ‚-রাজনীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। সাম্প্রতিক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক যুদ্ধ, জাতিগত ও ভ‚-রাজনৈতিক টানপোড়েনে পরাশক্তিগুলোকে অনেকটা শীতল ভ‚মিকায় দেখা গেলেও প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে সুস্পষ্ট ও সরাসরি ভ‚মিকায় দেখা গেছে। কখনো কখনো সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দি এলাকায় তুর্কিদের বিতর্কিত ভ‚মিকায় দেখা গেলেও আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা, জেরুজালেমের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং ফিলিস্তিনী স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে কতিপয় আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রের ইসরাইলের সাথে সমঝোতা চুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছেন এরদোগান। তিনি যথার্থই বলেছেন, এসব আরব শাসকের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। সেই সাথে তিনি বরাবরের মতই ইসরাইলের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার নামে মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে কতিপয় দেশের সাথে চুক্তি করার মধ্য দিয়ে ইসরাইল মূলত আরব বিশ্বের সাথে প্রতারণ্ াকরেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় ইরান ও তুরস্কের শক্ত ভ‚মিকা পশ্চিমাদের প্রভাবকে গৌণ করে তুলেছে। এতে ইসরাইলীরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করতেই পারে। সেই সাথে তুরস্কের উপর সউদি শাসকদের ক্ষেপে ওঠার নানাবিধ ভ‚-রাজনৈতিক কারণ সক্রিয় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ও অশান্তির মূল উৎস ইসরাইলের আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদি নীতির প্রশ্নে সউদি আরবের নমনীয়তা নিয়ে মুসলিম বিশ্বে হতাশা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। গত সাত দশকে ইসরাইলের হাতে হাজার হাজার আরব মুসলমানের রক্ত ঝরলেও উপসাগরীয় আরব শাসকদেরকে কখনো ইসরাইলী পণ্য বর্জনের ডাক দিতে দেখা যায়নি। অথচ এবার এরদোগানের সত্য ভাষণের প্রতিবাদে সউদি ব্যবসায়ীরা তুর্কি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। তুর্কি পণ্য বর্জন করে বিকল্প হিসেবে তারা নিজস্ব দেশীয় পণ্যের ব্যবহার শুরু করলে তা হতো শোভনীয়, তাদের আহŸানে সউদি ব্যবসায়ী কনজিউমাররা সাড়া দেবে কিনা, অথবা তুর্কি পণ্যের বদলে ইসরাইলী পণ্য আমদানি বানিজ্য বাড়বে কিনা তা দেখার জন্য আমাদেরকে হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
দক্ষিন ককেশাস বা ট্রান্স-কমেশিয়ান অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে গত চারদশকে নানামুখী ভ‚-রাজনৈতিক মেরুকরণ দেখা গেছে। কখনো নাগরনো-কারাবাখ, কখনো চেচনিয়া, কখনো ইঙ্গুশেটিয়া আবার কখনো আত্রাস্ক, ওসেটিয়ার গণআন্দোলন, স্বাধীনতা-স্বায়ত্বশাসন নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে ঝড় উঠতে দেখা গেছে। এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক ও ভ‚রাজনৈতিক গুরুত্ব। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং আধুনিক যুগের নৃতাত্তি¡কদের বর্ণনা ও গবেষণায় ককেশাস অঞ্চলকে মানব জাতির অন্যতম কেন্দ্রভ‚মি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্যএশিয়া তথা কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী এই উচ্চ পাবর্ত্য অঞ্চলটি এশিয়ার সাথে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগ স্থাপন করেছে। এ কারণেই শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলটি ভ‚-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কালের বিবর্তনে এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী ভ‚-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক সময়ের প্রতিদ্বন্দী প্রতিপক্ষ রাশিয়া, পারস্য, অটোমান এবং চায়নিজরা এখন একটি সাধারণ ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। পশ্চিমা স্বার্থ ও বৈরীতার বিপরীতে ককেশাসের আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, চেচনিয়া, ওসেটিয়া, দাগেস্তান, আবখাজিয়াকে ঘিরে আছে একদিকে রুশ ফেডারেশন, অন্যদিকে তুরস্ক এবং ইরান। অর্থাৎ এ অঞ্চলের যে কোনো যুদ্ধে এসব কৌশলগত বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ তো আছেই। সেই সাথে এসব আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলো নিজেরাও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নাগরনো কারাবাখ এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের অসমর্থিত আন্ত্রাস্ক-এর উপর নিয়ন্ত্রন প্রশ্নে গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে ইতিমধ্যে তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষ নিয়েছে। একইভাবে ইরাণ সরাসির কাউকে সমর্থন না দিলেও আজারবাইজানের সাথে স্থলসীমানা থাকায় তুরস্কের পাশাপাশি ইরানেরও জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে। চীনের রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের সাথেও এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ যোগসুত্র থাকায় আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধের তাপ চীনের গায়েও হয়তো লাগবে। তবে রাশিয়ার ে গাপন সমর্থন যেখানেই থাক, প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে যুদ্ধের প্রাথমিক ফলাফল আজারবাইজানের পক্ষে রয়েছে বলে জানা যায়। তবে গত দুইশ বছরে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রেখা তুরস্ক, রাশিয়া ও পারস্যের মধ্যকার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন ঘটলেও এবার হয়তো তা ঘটবে না। কারণ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং অথনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এ অঞ্চলের প্রায় সব শক্তি এখন একটি ঐক্য প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সিরিয়ায় পশ্চিমা প্রক্সিযুদ্ধে সেই ঐক্য ও সহযোগিতার বাস্তব প্রতিফলন দেখা গেছে।
খৃষ্টধর্ম ও স্বেতাঙ্গ জাতির বিকাশের স্থান হিসেবে একদিকে জর্জিয়া-আর্মেনিয়ার উপর খৃষ্টীয় সমাজের আগ্রহ অন্যদিকে আজারবাইজানের সাথে তুরস্ক, রাশিয়া, ইরান ও চীনের ভ‚রাজনৈতিকÑঅর্থনৈতিক মেলবন্ধন চলমান যুদ্ধপরিস্থিতি একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধে রূপ নেয়ার আশঙ্কাও রয়েছে । প্রাচীন চীনের সিল্করুটের প্রধান পথটি গিয়েছে ককেশাস অঞ্চল দিয়ে। আর এখনকার চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ও জ্বালানি পাইপলাইনের সাথে আজারবাইজান ও ককেশাস অঞ্চল অন্যতম গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। এখন নাগরনো কারাবাখ নিয়ে আমের্নিয়ার সাথে যুদ্ধ যদি একটি ব্যাপক যুদ্ধে পরিনত হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীনের মহাপরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ। দুইদিন আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনের রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ বিরোধি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার কৌশলগত মিত্ররা আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধকে একটি ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিনত করতে পারে। এ কারণেই এই যুদ্ধ বৃহদাকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষে শক্তি প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করলেও আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার সেনা উপস্থিতি থাকার পরও এই যুদ্ধে রাশিয়া এখনো কোনো পক্ষে অবস্থান নেয়নি। একইভাবে ইরানও তার সীমান্তে কোনো রকম যুদ্ধের আঁচ লাগার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি বার্তা দিয়েছে। গত রবিবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট প্রতিপক্ষ আর্মেনিয়ার প্রতি কঠোর বার্তা দিয়েছেন। তার সেনাবাহিনী আর্মেনীয়দের কুকুরের মত তাড়া করছে বলে দাবি করেছেন। তিনি আমের্নিয়ার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিপরীতে কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করেছেন। আজারবাইজানের পেটের ভেতর জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে নাগারনো-কারাবাখ এবং আত্রাস্ক অঞ্চলে আর্মেনিয়ার ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড বন্ধে এবার একটি স্থায়ী উদ্যোগ নিতে পারলে এর্ অঞ্চল তার হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরে পেতে পারে। একইভাবে আরাকান বা রাখাইনে মিয়ানমারের জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে চীন-রাশিয়া-তুরস্ক ও ইরানসহ সব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির একটি সাধারণ মতৈক্যে পৌঁছা জরুরি। কোনো পক্ষের একতরফা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সব পক্ষকে একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানে আসতে হবে। গত এক দশকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়া, চীন, তুরস্ক এবং ইরানের মধ্যে একটি সাধারণ মৈত্রী তৈরি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত অ্যাকাডেমিসিয়ান ও আন্তজার্তিক উন্নয়ন গবেষক, ড. অ্যাড্রিয়ান ক্যাম্বেল ২০১৭ সালে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বøগে লেখা নিবন্ধে রাশিয়া, চীন, ইরান ও তুরষ্কের জোটকে একটি ন্যাচারাল এলি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। গত কয়েক বছরে এ নিয়ে আরো বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, ককেশাস এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মেরুকরণ ও ভাগ্য নির্ধারণে এই জোটের সমন্বিত উদ্যোগ, কৌশলগত সিদ্ধান্ত ও বিনিয়োগ বিশাল ভ‚মিকা রাখবে বলে ধারণা করা যায়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।