পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চিঠি লিখেছে। আবার ঐ দিকে মিয়ানমারের গণমাধ্যমেও সরবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ নাকি মিয়ানমার সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে। অবশ্য মিয়ানমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশের অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কোনো পত্র দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। দুই দেশের সৈন্য সমাবেশে বিশেষ করে মিডিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকায় এমন আশঙ্কা অথবা আতঙ্ক প্রকাশ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যায় কিনা। এসব কারণে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়।
প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়ার প্রয়োজন। দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার পেছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে হয়। যেমন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে রয়েছে কাশ্মীর বিরোধ। এই বিরোধ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে দুটি যুদ্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশকেন্দ্রিক যুদ্ধ এই দুটি যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত নয়। চীন ও ভারতের মধ্যে আকসাই চীন, লাদাখ, অরুণাচল প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে বিরোধ রয়েছে। ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়।
বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে এই ধরনের কোনো বিরোধ নেই, যে বিরোধ নিয়ে যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। দুই দেশের একটি বড় সমস্যা রয়েছে। সেটি হলো রোহিঙ্গা সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যাও ঠিক সেই ধরনের সমস্যা নয়, যে ধরনের সমস্যা নিয়ে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ লাগতে পারে।
বর্তমান সরকারের আমলে ৭ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান উদ্বাস্তু হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ বা সাবেক আরাকান থেকে বাংলাদেশে এসেছে। এই সরকারের আগে মিয়ানমার থেকে দুই দফায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে এসেছে। তখন থেকেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের ওপর রেগে গেছে। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তখনও দুই দেশের মধ্যে এবং দুই দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চলেছে। এসব কূটনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশের পক্ষে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারপরেও যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। যুদ্ধের আগুন যে জ্বলে উঠেনি তার জন্য ১০০ ভাগ কৃতিত্ব কিন্তু বাংলাদেশের। বাংলাদেশ অসাধারণ ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছে এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে শক্তভাবে কেউ এগিয়ে আসেনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারত। ভারত এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি। রোহিঙ্গা ইস্যুর একমাত্র সমাধান হলো ঐ ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে সসম্মানে এবং পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে রাখাইন তথা আরাকানে ফেরত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু মিয়ানমার বছরের পর বছর ধরে নানা টালবাহানা করেছে এবং পরোক্ষভাবে তাদের ফেরত নিতে অনিহা প্রকাশ করেছে।
দুই
সোজা কথায়, মিয়ানমার ওদেরকে ফেরত নেবে না। বিষয়টি অনেকটা কাশ্মীর ইস্যুর মতো। ভারত কাশ্মীর প্রশ্নে গণভোটে রাজি হয়েছিল। গণভোটের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। কিন্তু ৭১ বছর হলো ভারত গণভোট প্রশ্নে টালবাহানা করেছে এবং করতে করতে জম্মু এবং কাশ্মীর গ্রাস করেছে। জম্মু এবং কাশ্মীর ভারত গ্রাস করতে পারলো এই জন্যই যে গণভোট অনুষ্ঠানে ভারতকে বাধ্য করার মতো কোনো বৃহৎ শক্তি এগিয়ে আসেনি। সেদিনের সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং আজকের রাশিয়া ভারতের জবরদখলকে সমর্থন করেছে। আমেরিকা ও পশ্চিমা দুনিয়া গণভোট প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য কোনো গণভোট অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অথচ গণভোটের ন্যায্যতা সারা দুনিয়া স্বীকার করেছিল।
একই অবস্থা হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও। রোহিঙ্গাদের অন্যায়ভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সে কথা সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু তাদেরকে ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করবে, এমন কেউ নাই। ভারত বলে, বাংলাদেশের সাথে তার সৌহার্দ্যপূণ সম্পর্ক অনেক উঁচুতে। এত উঁচুতে যে তার ওপরে আর ওঠা যায় না। বাংলাদেশের ‘জিগরী দোস্ত’ ভারতের সাথে মিয়নামারের সম্পর্কও ভালো। অথচ বাংলাদেশের প্রাণের সখা ভারত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করাতো দূরের কথা, তাদের ওপর বিন্দুমাত্র চাপও প্রয়োগ করেনি। ইদানিং বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে। ঐ দিকে মিয়ানমার তার অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রে চীনের ওপর শতকরা একশত ভাগ নির্ভরশীল। চীন চাপ দিলে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টিই করতো না। আমেরিকা খুব জোরের সাথে বলে, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিয়ে স্বদেশে ফেরত নিতে হবে। কিন্তু ঐ মুখে বলা পর্যন্তই। কাশ্মীরের ব্যাপারে আমেরিকা ও পশ্চিমা দুনিয়া যেমন লিপ সার্ভিস দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও তারা শুধুমাত্র লিপ সার্ভিস দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। সুতরাং বাংলাদেশে অবস্থানরত ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। সেই তিমির থেকে তারা বের হবে, এমন কোনো সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না।
তিন
ভ‚রাজনৈতিক ও ভ‚কৌশলগত কারণেও বাংলাদেশ-মিয়ানমার যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা নাই। তার কারণ দুটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান। উভয় দেশেরই স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব বিপুল। সে কারণেই বাংলাদেশকে কাছে পেতে চাইছে তিনটি দেশ। দেশ তিনটি হলো, ভারত, চীন এবং আমেরিকা। ’৭১ সাল থেকেই তো বাংলাদেশ ভারতের সাথে আছেই। অর্থনৈতিক, কারিগরি এবং মেডিক্যাল সাহায্যের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। আর আমেরিকা তো ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েই রেখেছে। বাংলাদেশ কোনো অবস্থায় মিয়ানমার আক্রমণ করবে না। আর মিয়ানমার যদি বাংলাদেশ আক্রমণ করতে চায় তাহলে বাইরে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারত এবং চীনই সর্বাগ্রে তাকে বাধা দেবে। আমেরিকায় ট্রাম্পের সরকার থাকুক অথবা জো বাইডেনের সরকার থাকুক, তারা চোখ বন্ধ করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে।
আরেকটি কথা খুব স্পষ্টভাবে বলা দরকার। বাংলাদেশ কোনো সময় প্রথম মিয়ানমারকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু যদি আক্রান্ত হয় তাহলে আত্মরক্ষা করার মতো যথেষ্ট সামরিক সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। যদি আক্রান্ত হয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য সেটি আর ডিফেন্সিভ যুদ্ধ থাকবে না, বাংলাদেশ তখন অফেন্সে যেতে অর্থাৎ পাল্টা আক্রমণে যেতে বাধ্য হবে।
মিয়ানমারকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি বিশেষ সুবিধা আছে। সেটি হলো, রামুতে বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্ট রয়েছে। এটি মিয়ানমার সীমান্তের খুব কাছে । পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বক্ষণিক সেনা ছাউনি আছে। এই সেনা ছাউনি মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইনের একেবারে সন্নিকটবর্তী। প্রয়োজনে সেই সীমান্তে বাংলাদেশের সেনা মোতায়েনে কোনো সময় লাগবে না। সেটি মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র। এছাড়া বিজিবির, অর্থাৎ বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তো বর্মী সীমান্ত জুড়ে সার্বক্ষণিক টহলে রয়েছে।
একটি কথা পুনর্বার উল্লেখ করা দরকার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের কোনো বন্ধু নাই। তাদের একমাত্র শক্তি এবং নির্ভরতা হলো চীন। আমেরিকার সামনে এখন প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী রাশিয়া নয়, চীন। চীনকে বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি গাড়তে দেবে না আমেরিকা। আমেরিকার মুখোমুখি হওয়ার সক্ষমতা এখনও অর্জন করেনি চীন। সে জায়গায় পৌঁছতে তার এখনও বেশ কিছু সময় লাগবে। তার আগে মিয়ানমারকে কোনো অ্যাডভেঞ্চারিজমে যেতে দেবে না চীন।
চার
এই আলোচনার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, মিয়ানমার তাহলে কেন সৈন্য সমাবেশ করেছে? এটির উত্তর জানতে হলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু জানা দরকার।
একটা সময় ছিল, যখন মিয়ানমারের বিদ্রোহী শক্তি বলে শুধুমাত্র বোঝাতো আরাকান আর্মিকে। কিন্তু বিগত দুই এক বছরে আরাকান আর্মি প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করেছে। এখন নতুন করে অভুদ্যয় ঘটেছে আরো তিনটি নতুন শক্তি, যাদেরকে বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাকামী বলা হয়। এরা সকলেই সশস্ত্র। এরা হলো রাখাইনের বৌদ্ধ বাহিনী, বর্মী এবং রোহিঙ্গা বিদ্রোহী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, যাদেরকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী বলা হয় তারা কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কেউ নয়। রাখাইনে এখনও যে ৪/৫ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের মধ্যে থেকেই এই রাখাইন রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠি গড়ে উঠেছে।
উত্তর রাখাইনে আরাকান আর্মি ছাড়াও আলাদাভাবে কারেন এবং শান নৃতাত্বিক গোষ্ঠি বর্মী সেনাদের ওপর মাঝে মাঝেই চোরাগুপ্তা সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। আরাকান আর্মি, কারেন এবং শান বিদ্রোহীরা গেরিলা আক্রমণ করে কিছু এলাকা দখল করে এবং সেখানে স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমারে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত সশস্ত্র বিদ্রোহীরা একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলেছে। এই বৃহত্তর ঐক্যের নাম দিয়েছে তারা ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’। আসল সত্যটি বিশ্ববাসীকে জানতে দেওয়া হচ্ছে না। সেটা হলো, রোহিঙ্গারা স্বাধীনতার জন্য উচ্চকণ্ঠ নয়। কিন্তু কারেন নৃতাত্ত্বিক জাতি স্বাধীনতার জন্য উচ্চকণ্ঠ। কারেনরা স্বাধীনতার জন্য মাঝে মাঝেই অ্যামবুশ করছে।
এককথায় মিয়ানমার রাজনৈতিকভাবে আর শান্ত দেশ নয়। মিয়ানমারের উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম এখন দারুণ অশান্ত। আরাকান বা রাখাইন ছাড়িয়ে সমগ্র বিদ্রোহ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব জায়গায় যারা সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে, তারা হলো ‘থ্রি ব্রাদার্স’। এই থ্রি ব্রাদার্স হলো, ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স, টুংক ন্যাশনাল আর্মি (কোচিন প্রদেশে) এবং আরাকান আর্মি।
আগামী মাসে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন। অং সাং সুচির বিরুদ্ধে যে দলটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তাদের মদদ দিচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কারেন বা শানরা অতীতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ছিল। এখনও যে নাই ঠিক তা নয়। কিন্তু বর্মী সেনাবাহিনীর মারের চোটে বিদ্রোহীরা একে অপরকে সাহায্য করছে। ঘটনাচক্রে বিদ্রোহের ফোকাল পয়েন্ট হলো রাখাইন এবং তৎসংলগ্ন এলাকা। আর রাখাইন বা আরাকান বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত। এখানে মিয়ানমার বিপুল সৈন্য সমাবেশ করেছে। তাই মনে হয়, তারা বুঝি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রণসাজে সজ্জিত হচ্ছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।