Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতীয় মুসলিমদের কি সবাই পরিত্যাগ করেছে?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৫ এএম

সময় লেগেছে তিন দশক। ছিল সাড়ে আটশো সাক্ষী। দেখা হয়েছে সাত হাজারের বেশি দলিলপত্র, ছবি আর ভিডিও টেপ। এত কিছুর পর ভারতের একটি আদালত ষোড়শ শতকের একটি মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য কাউকে দোষী বলে খুঁজে পায়নি। অযোধ্যার ওই মসজিদটিতে হামলা চালিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল হিন্দু জনতা।

এই মামলায় যে ৩২ জন জীবিত অভিযুক্ত, তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এল কে আদবানী এবং আরও অনেক সিনিয়র বিজেপি নেতা। বুধবারের রায়ে এদের সবাইকে খালাস দেয়া হয়েছে। আদালত বলেছে, ১৯৯২ সালে এই মসজিদটি ধ্বংস করেছে অচেনা ‘সমাজ-বিরোধীরা’ এবং এই হামলা পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল না। মসজিদটি ধ্বংস করতে সময় লেগেছিল মাত্র চার ঘন্টা। এই কাজটি করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে। এটি ধ্বংসের আগে যে এই কাজের মহড়া দেয়া হয়েছে, এতে যে স্থানীয় পুলিশের প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল এবং হামলাকারীদের যে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল - এমন বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ দিয়েছেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তবে তারপরও আদালত এরকম রায় দিয়েছে। গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বলেছিল, এটি ছিল এক ‘সুপরিকল্পিত ঘটনা’ এবং ‘আইনের শাসনের এক গুরুতর লঙ্ঘন’।

সাধারণভাবে এই রায়কে দেখা হচ্ছে ভারতের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা কতটা ঢিমে-তালের এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ- তারই আরেকটা নজির হিসেবে। অনেকের আশংকা, কয়েক দশক ধরে বিচার বিভাগের ওপর যেরকম নগ্ন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলেছে, প্রয়োজনীয় তহবিল দেয়া হয়নি এবং এর সক্ষমতা দুর্বল করা হয়েছে, তাতে এটিকে আর সংস্কার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই রায় একই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ের ওপর তীব্র আলোকপাত করেছে- সেটি হচ্ছে কীভাবে ভারতের ২০ কোটি মুসলিমকে ক্রমশই এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হচ্ছে।
ভারতে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির শাসনে মুসলিমদের কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া যে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্র বলে কথিত, তার বহুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে মুসলিমরা এখন ভারতে নিজেদের অনেক বেশি অপমানিত বলে মনে করে। গরুর মাংস খাওয়ার কারণে কিংবা গাড়িতে গরু নিয়ে যাওয়ার কারণে মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করেছে উন্মত্ত জনতা। ভারতের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু এবং কাশ্মীর তারা কয়েক টুকরো করে ভেঙ্গে দিয়েছে। সাংবিধানিক স্বায়ত্বশাসন হরণ করেছে।

এ বছর একটি মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠী দিল্লিতে এক ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন করার পর করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য কেবল মুসলিমদের ওপরই দোষ চাপানো হয়। মহামারির মধ্যে যখন হিন্দুদের বড় ধর্মীয় সমাবেশ হয়েছে, সেটিকে কিন্তু একই রকমের নিন্দা আর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি গণমাধ্যম বা রাজনীতিকদের কাছ থেকে, একইভাবে দোষ চাপানোর চেষ্টাও চোখে পড়েনি। এখানেই শেষ নয়। গত শীত মৌসুমে বিতর্কিত এক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় উস্কানি দেয়ার কথিত অভিযোগে মুসলিম ছাত্র আর কর্মীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, জেলে ঢোকানো হয়েছে। অথচ দাঙ্গায় উস্কানি দেয়া অনেক হিন্দু মুক্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে।

অনেক মুসলিমের মতে, ভারতে মুসলিমদের যেভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে, বাবরি মসজিদের ঘটনার রায় আসলে তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতার বোধ একেবারেই বাস্তব। মোদির দল তাদের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরের আদর্শ নিয়ে কোন রাখ-ঢাক করে না। জনপ্রিয় টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলগুলো প্রকাশ্যেই মুসলিমদের দানবরূপে চিত্রিত করার কাজ চলে। ভারতের এক সময়ের অনেক শক্তিশালী আঞ্চলিক দল, যারা তাদের জনগণের পাশে দাঁড়াতো, তারাও যেন মনে হচ্ছে মুসলিমদের পরিত্যাগ করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপি যে ধরণের ধর্মভিত্তিক নির্বাচনী রাজনীতির চর্চা করে, তাতে করে মুসলিমদের ‘আলাদাকরণ’ করা হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফে জাফরেলট বলেন, ‘কিভাবে আপনি মেরুকরণের কাজটা করবেন? এটা আপনি করবেন অন্যদেরকে আপনার পরিচয়ের প্রতি একটা হুমকি হিসেবে চিত্রিত করে।’ তার মতে, ভারত এখন এক ধরণের ‘এথনিক ডেমোক্রেসির’ দিকে যাচ্ছে, যা এথনিক জাতীয়তাবাদ থেকে উৎসারিত। এর মূলে আছে একধরণের ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ বোধ।

তবে সবকিছু এখনো অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি। এক তরুণ মধ্যবিত্ত গোষ্ঠির উত্থান ঘটছে, দেশভাগের ভূত যাদের ঘাড়ে চেপে নেই। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল, তখন সেখানে এই তরুণ, স্পষ্টভাষী মুসলিম নারী-পুরুষদের দেখা গেছে ভারতের রাস্তায়। ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় এক ঘরকুনো এবং নির্বাক সংখ্যালঘু বলে যে গৎবাঁধা ছবি, সেটা তারা ভেঙ্গে দিয়েছে। এলাকায় এলাকায় এখন গড়ে উঠেছে কমিউনিটি কোচিং ক্লাস। সেখানে তরুণ মুসলিমদের ভারতের মর্যাদাপূর্ণ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জহির আলি বলছেন, ভারতের অনেক তরুণ মুসলিম এখন তাদের মুসলিম পরিচয়কে ইতিবাচক হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা তাদের মত প্রকাশে মোটেই কুন্ঠিত নয়। কিন্তু তার মতে, শেষ পর্যন্ত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায় অভিযুক্তদের খালাস দেয়ার এই ঘটনা ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে উৎকন্ঠা এবং অবিচারের বোধ আরও গভীর করবে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।



 

Show all comments
  • Zillur Rahaman ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪০ এএম says : 0
    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। "বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। তুমি রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন কর আর তুমিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও। তুমি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান কর।" (সুরা নং ৩ আল ইমরান, আয়াত ২৬-২৭)
    Total Reply(0) Reply
  • Feroj Ahmad ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪১ এএম says : 0
    মুসলিমদের পাশে স্বয়ং আল্লাহ আছে।বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না। "তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে।" সূরা আত তওবাহ ৯:৩২ "وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ اللّهُ وَاللّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ (54 এবং কাফেরেরা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী।" আলে ইমরান ৩:৫৪ নমল ২৭:৫০ আত তারিক ৮৬:১৫-১৬
    Total Reply(0) Reply
  • জান্নাতুল মিনাল ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪২ এএম says : 0
    নিশ্চই আল্লাহ সর্বোত্তম বিচারক,এর বিচার একদিন হবেই হবে,, ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • Rihisha Risha ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪২ এএম says : 0
    এই রায় ভারতের বিচার আদালতের ন্যায় নিষ্ঠতা কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং এই বিচার ব্যবসতার উপর আর যে ভরসা রাখা যায়না সেটাই তুলে ধরেছে যা লজ্জাজনক। এবং একই সাথে এটা দেখিয়ে দিলো ধর্মীয় মেরুকরন আর বিভাজন কতটা একটা নিদির্ষ্ট ধর্মের মানুষকে কোনঠাসা আর তাদের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ভারতীয় মুসলমানদের এখন অনেকটাই সচেতন জেগে উঠতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • আব্দুর রহিম আবুআনাস ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪৩ এএম says : 0
    দেশের কোন জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন।তাদেরকে কোনঠাসা করা অপদস্ত হেয় করা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর পরিনতি ডেকে আনবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Rafiqul Islam ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪৩ এএম says : 0
    যখন কোন জাতির পতন ঘটে তার আগে সেই জাতির সমাজে ইনসাফের মৃত্যু ঘটে।বর্তমান ভারতে আজ তাই হচ্ছে।তাদের পতনও আসন্ন।
    Total Reply(0) Reply
  • Kamal Khan ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪৪ এএম says : 0
    হয়ত আজ এই প্রজন্ম নেই কিন্তু আললাহ ঠিকই পরের প্রজন্ম অবশ্যই তৈরী করে দিবেন। এই ভারত বৃটিশ মুক্ত হয়েচিল মুসলমানদের শহীদের রক্তের উপর দিয়ে ইনশাআল্লাহ আমারা আসতেছি
    Total Reply(0) Reply
  • MD Rahat Bin Kamal ৩ অক্টোবর, ২০২০, ৪:৪৪ এএম says : 0
    দুনিয়া থেকে মানবতা হারিয়ে গেছে জোর যার মুল্লুক তার, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং এমপি মন্ত্রী পুলিশ প্রশাসন সরকারি আমলা সকল শ্রেণীর মানুষের হিন্দু, এইসব জাতি মানবতার কথা বলে না, সব ঠিক আছে তালগাছ আমার, বাবরি মসজিদের রায় টা তো সেই দিকেই যাবে,,,,
    Total Reply(0) Reply
  • abul kalam ৩ অক্টোবর, ২০২০, ২:৪৩ পিএম says : 0
    ভারতের মুসলিম বিদ্বেষী ঘটনা প্রমান করে,হিন্দুরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্য, মুসলমান আবার ভারতের ক্ষমতায় আসবেই, ইংশায়াল্লহ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ