Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কেউ ভাঙেনি বাবরি মসজিদ ৩২ অভিযুক্তই খালাস

ভারতের আদালতে ‘কলঙ্কিত’ রায় রায়ে ‘অবাক’ তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৭ এএম

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রায় ঘোষণা করল ভারতের বিশেষ আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, ‘বাবরি ধ্বংসের ক্ষেত্রে কোনো পূর্র্ব পরিকল্পনা ছিল না!’ পাশপাশি, লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতী, কল্যাণ সিং, সাধ্বী ঋতম্ভরা, সাক্ষী মহারাজ সহ ৩২ জন অভিযুক্তই বেকসুর বলে ঘোষণা করেছে আদালত। বিতর্কিত এ রায়ে বিজেপি উল্লাস প্রকাশ করলেও হতাশ হয়েছেন মুসলিমরা। সমালোচনা করেছে বিরোধী দল কংগ্রেসও। এই রায় মানতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব মাধব গোডবোলে।

বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে রায় যখন এলো, ততদিনে রামমন্দির নির্মাণের পথ প্রশস্থ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ইতিমধ্যে রামমন্দিরের ভ‚মিপুজা হয়ে গেছে। মন্দির বানানোর কাজও শুরু হয়ে গেছে। তা সত্তে¡ও বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো দেশ। কারণ, মামলার মূল বিষয় ছিল, বাবরি ভাঙার চক্রান্তের দিকটি। বাবরি মসজিদ তো ১৯৯২ সালেই ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। প্রশ্নটা ছিল, সেই ঘটনার পিছনে কি আদবানীদের বা আরো স্পষ্ট করে বললে বিজেপি, ভিএইচপি, আরএসএস’র কিছু নেতার চক্রান্ত ছিল? সুপ্রিম কোর্টও রামজন্মভ‚মি নিয়ে রায়ে বলেছিল, বাবরি মসজিদ ভাঙা ছিল পুরোপুরি বেআইনি কাজ। এই পরিস্থিতিতে সিবিআই-এর বিশেষ বিচারকের রায়, বাবরি ধ্বংসে কোনো চক্রান্ত ছিল না। অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে সেরকম কোনো তথ্য প্রমাণই নেই। অডিও-ভিডিও-র বিষয়টি তো সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন তিনি। অথচ, বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হয়, তখন কল্যাণ সিং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। আদবানী, যোশী, উমা ভারতীরা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় ছিলেন।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দীর্ঘ ২৮ বছর পর আদালত রায় দিল, এর পিছনে কোনো চক্রান্ত নেই। সিবিআই বিচারক এস কে যাদব তার রায়ে বলেছেন, আদবানী, যোশীরা উল্টে বাবরি মসজিদ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক অশোক সিঙ্ঘলও চেষ্টা করেছিলেন, যাতে বাবরি মসজিদ ভাঙা না হয়। তা হলে বাবরি মসজিদ ভাঙল কে? বিচারকের রায়, ষড়যন্ত্র বা পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। গোটাটাই ‘হঠাৎ ঘটে যাওয়া’ স্বতঃস্ফ‚র্ত জনরোষের ফল। কিছু অসামাজিক লোক, যারা মসজিদের পিছন থেকে এসে বাবরি মসজিদের মাথায় চড়ে যায়, তারাই ভেঙেছে। কিন্তু ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর যে উত্তেজক ভাষণ দেয়া হয়েছিল বলে অভিয়োগ উঠেছিল, সংবাদপত্রের রিপোর্টেও বলা হয়েছিল, কিছু নেতা-নেত্রী সোচ্চারে বলছিলেন, ‘এক ধাক্কা আওর দো’ তার কী হলো? বিচারক জানিয়েছেন, আদালতের কাছে জমা দেয়া অডিও ও ভিডিও পরিস্কার নয়। আর সিবিআই এই অডিও-ভিডিওর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি।

রায়ে ‘অবাক’ তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় যিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন, সেই প্রাক্তনআমলা মাধব গোডবোলে কিছুতেই এই রায় মানতে পারছেন না। বাবরি ধ্বংসের জন্য কোনও আগামষড়যন্ত্র হয়নি, তা বিশ্বাস করেন না প্রাক্তন এই আইএএস অফিসার। এই রায়ের সঙ্গে একেবারেই সহমত নন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব মাধব গোডবোলে। তিনি বলেন, ‘অত বিপুলসংখ্যক মানুষ আগাম পরিকল্পনা ছাড়া স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে জড়ো হয়েছিলেন, তা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্যনয়। ২৮ বছর পরে যদি এমন রায় দেওয়া হয়, তাহলে তা আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকেনিয়েই প্রশ্ন তোলে। কারণ সুপ্রিম কোর্টই এই ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিল। তার পরেও সিবিআই আদালত কোনও প্রমাণ পেল না, এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

অবসর নেওয়ার পর নিজের বইতে মাধব গোডবোলে দাবি করেছিলেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব হিসেবে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা রুখতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও-কে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে বাবরি মসজিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছিল। যদিও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাবে সায় দেননি।

রায়ের পরে প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিরোধী দল কংগ্রেস জানিয়েছে, এই রায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিপরীত। পুরো দেশ দেখেছিল, কীভাবে বিজেপি ও আরএসএস নেতারা চক্রান্ত করেছিলেন। তার সঙ্গী ছিল সে সময়ে রাজ্যের বিজেপি সরকার। তারা সুপ্রিম কোর্টে মিথ্যা হলফনামা দিয়েছিল। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি টুইট করে বলেছেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে বাবরি ভাঙার চক্রান্তের অভিয়োগ করা হলো, তারা সকলেই বেকসুর। তাহলে মসজিদ কি আপনা থেকে ভেঙে গেলো? প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাংবিধনিক বেঞ্চ বললো, বাবরি ধ্বংস হলো বেআইনি কাজ। তারপর এই রায় লজ্জার।’ এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসির মতে, ‘এই দিন ভারতীয় বিচারব্যবস্থার কালো দিন।’

স্বাভাবিকভাবে রায়ের পর বিজেপি নেতারা উল্লসিত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিছিল করেছে তারা। যোগী আদিত্যনাথের মতো নেতারা অভিযোগের আঙুল তুলেছেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। আদিত্যনাথ বলেছেন, ‘এই রায় থেকে বোঝা গেল, কংগ্রেস সাধু-সন্তদের ফাঁসাবার চক্রান্ত করেছিল।’ নিশ্চিন্ত আদবানী বলেছেন, ‘রামের প্রতি তার ও বিজেপি’র দায়বদ্ধতা আবার প্রমাণিত হলো।’ বিজেপি’র এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা আবার করোনা, উত্তর প্রদেশে দলিত ধর্ষিতার মৃত্যু ও তারপরের বিতর্কিত ঘটনা, কৃষক বিক্ষোভের মতো বিষয়গুলি থেকে লোকের নজর ফেরাবার জন্য বাবরি ধ্বস নিয়ে রায়কে হাতিয়ার করবে। আর এই রায়ের পর বিজেপি বা সংঘ পরিবারের গায়ে কালো দাগ লাগলো না।

বিশেষ আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার আইনি রাস্তা সিবিআইয়ের কাছে এখনও খোলা থাকছে। যদিও, বিজেপি সরকারের আমলে সিবিআই সে পথে হাঁটবে কি না সেটা স্পষ্ট নয়। তবে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড ইতিমধ্যেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, লখনউয়ের বিশেষ সিবিআই আদালতের এই রায়কে তারা চ্যালেঞ্জ করবে। এবং রায়ের বিরুদ্ধে এলাহাবাদ হাই কোর্টে আবেদন করা হবে। সূত্র : টিওআই, ডয়চে ভেলে, এনডিটিভি।



 

Show all comments
  • আমান উল্লাহ ১ অক্টোবর, ২০২০, ৫:০৭ এএম says : 3
    রাষ্ট্র যখন বলে অন্যায় ভাবে কেউ মসজিদ ভাঙ্গে নাই, দুষ্কৃতিকারীকে মুক্তি দেয়, তখন আল্লাহ হয়তো ভয়াবহ প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা পূরণ করবেন। সামনের দিনগুলো রক্তপাতের দিন, হত্যার কান্ডের দিন। ভারত খন্ড বিকন্ড হয়ে মুসলমানদের করতলগত হওয়ার দিন। অপেক্ষা বৎস,অপেক্ষা।
    Total Reply(0) Reply
  • Shihab Ahmed ১ অক্টোবর, ২০২০, ৫:১৪ এএম says : 2
    এ রায় হলো ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার সমুজ্জ্বল প্রতীক। কি মনে হয় - ভারত কি এখনও সুসভ্য দেশ?
    Total Reply(0) Reply
  • Qudry Sumon ১ অক্টোবর, ২০২০, ৫:১৫ এএম says : 2
    এই রায়ের মাধ্যমে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Yousuf ১ অক্টোবর, ২০২০, ৫:১৫ এএম says : 2
    Allah afni bicar korun .
    Total Reply(0) Reply
  • Zillur Rahaman ১ অক্টোবর, ২০২০, ৫:১৬ এএম says : 2
    যেদেশে মানুষের চেয়ে পশুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেদেশে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা দুরাশা মাত্র। বিচারের নামে এ ধরণের প্রহসন যে হবে, তা আগেই অনুমান করা হয়েছিল। শত ধিক্কার ও নিন্দা এ ধরণের বিচারের নামে তামাশায়।
    Total Reply(0) Reply
  • Shafiqul Islam Maruf ১ অক্টোবর, ২০২০, ৫:১৬ এএম says : 3
    ৮৬ বছর পর যদি মসজিদ আবার স্বরূপে ফিরতে পারে তাহলে ১০০ বছর পর হলেও বাবরি মসজিদ আবার সরুপে ফিরবে, ইনশাআল্লাহ!!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ