পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘সীমিত পরিসর’ কথাটি পরিবহণ, হাটবাজার, অফিস-আদালত থেকে অনেক আগেই উঠে গেছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কেবল সীমিত নয়, শুরু থেকেই শিক্ষাঙ্গণ একেবারে লকডাউন। অর্থাৎ লকডাউন বলতে যা বোঝায়, তা চলছে একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। লকডাউন কী, কেন, কেমন, তা কেবল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেই বোঝা যাচ্ছে। করোনা কবে যাবে-এ প্রশ্নের মতো কবে খুলবে শিক্ষাঙ্গণ-এ প্রশ্নের জবাব নেই। তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এতো দীর্ঘ সময় পাঠদান বন্ধ থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে শিক্ষা খাত। এতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে টেলিভিশনে পাঠদান চালু থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এ ক্লাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরই এখন এ ধরনের ক্লাসের প্রতি আগ্রহ নেই। একাদশের শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তি বিলম্বের পাশাপাশি পিছিয়ে গেছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও। করোনার কারণে এ বছর বাতিল হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষা। এমন কঠিন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা উচিৎ-এমন দাবিও করা যাচ্ছে না। কারণ, জীবনের চেয়ে শিক্ষা বড়, তা অভিভাবকরা মানতে চাইবে না। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানে একটি বা কয়েকটি ভবন নয়। শিক্ষার্থী-অভিভাবক, শিক্ষক-কর্মচারীসহ আরো অনেককে নিয়ে এর ব্যাপ্তি। করোনার উৎপত্তি, আগমন, বিস্তারের চেয়ে এখন এর বিদায় নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে। করোনা কোত্থেকে, কিভাবে এলো, বিস্তার ঘটলো, এর চিকিৎসা কি?-এসব প্রশ্ন এখন অবান্তরে পরিণত হয়েছে। কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে ঠিকই, তবে এর কার্যকারিতার তেমন সুখবর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে করোনাকে সঙ্গী করেই মানুষকে চলতে হচ্ছে। এই গ্যাঁড়াকলে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দিনকে দিন শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ছে। সামনে আরো কত দিন এ দশা চলবে, তা বলা মুশকিল। শুধু আমাদের দেশে নয়, ইউনেস্কোর তথ্য মতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৯০টি দেশের শিক্ষার্থীরা লকডাউনে আছে। এই হিসাব অনুযায়ী, স্কুল বন্ধ থাকায় বিশ্বের ৯০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী এখন ঘরবন্দি। ইউনেস্কো এর আগে বলেছে, করোনার কারণে বিশ্বের ১৪০ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। সব দেশেই আর্থিকভাবে সচ্ছলদের তুলনায় অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধনীদের মতো অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়ার ক¤িপউটার, অন্যান্য ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ এবং নিরাপদ ও পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছে না তারা। আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে তারা মানসিকভাবেও ভালো নেই। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে কোভিড নাইনটিন সংক্রমণ শনাক্ত হলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যা এখনো চলমান। নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম তিন মাস পূরণ না হতেই মার্চে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে শেষ হয়নি সিলেবাসও। পরীক্ষা শুরু না হতেই সারাদেশের এইচএসসি ও সমমানের ১২ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনও হোঁচট খেয়েছে। আটকে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আরো ১২ লাখ শিক্ষার্থীর সব ধরনের পরীক্ষা। এক হিসাবে জানা গেছে, শিক্ষার সব স্তর মিলিয়ে একদিন ক্লাস না হলে ১৬ কোটি ঘণ্টা ক্ষতি হয়। সে হিসাবে গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ৪শ কোটি ঘণ্টার বেশি। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় টেলিভিশন রেডিওতে পাঠদান শুরু করলেও বাস্তবতার সঙ্গে তা সঙ্গতীপূর্ণ নয়। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত ছিল ১ এপ্রিল। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণার পর এ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা এরইমধ্যে পাঁচ মাস পিছিয়ে গেছে। কবে, কীভাবে এ পরীক্ষা হবে, কেউ বলতে পারছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারছে না। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয় ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন। এবার সেই ভাবনারও সময় নেই। এছাড়া করোনার কারণে এ বছর পিছিয়ে গেছে একাদশের ভর্তি কার্যক্রম। প্রতি বছর ১ জুলাই কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ক্লাস শুরু হলেও এ বছর এখনো ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়নি।
দেশে বেসরকারি, নন-এমপিও এবং প্রাইভেট মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় ৬০ হাজার। এগুলোর মধ্যে ৪০ হাজারই কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ২ হাজার বিভিন্ন রকম আধা-এমপিও ও বেসরকারি স্কুল। এছাড়া নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা প্রায় সাড়ে ৮ হাজার, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ হাজার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৯৬টি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেজি স্কুলগুলোতে ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। কারিগরি প্রতিষ্ঠানে জনবল আছে প্রায় আড়াই লাখ। বেসরকারি নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আছেন আরও প্রায় ৯০ হাজার। ৯৬ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ২৯ হাজার। এছাড়া শতাধিক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে আরও কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। অনার্স-মাস্টার্স কলেজে শিক্ষক আছেন সাড়ে ৫ হাজার। তাদের বেশির ভাগের বেতন-ভাতা অনিয়মিত হয়ে গেছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর, শহরতলী এবং গ্রামাঞ্চলে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এগুলো বিক্রির চেষ্টাও চলছে। রাজধানী ও শহরাঞ্চলের কোচিং সেন্টারগুলোও বন্ধ প্রায়। পরিস্থিতি কতটা নাজুক হলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়? অথচ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পাশাপাশি অনেক শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছিল। রাজধানীতেই দুই শতাধিক ছোট বড় কেজি স্কুল ও কলেজ বিক্রির উদ্যোগ ও চিরতরে বন্ধের কথা জানিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলো বলছে, এরইমধ্যে কেজি স্কুলের অনত্ত দুইজন শিক্ষক অর্থ কষ্টে চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেছেন। অর্ধাহারে-অনাহারে কাটছে দিন লাখ লাখ শিক্ষক, কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের। অনেকে চাকরি হারিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামে। লোকলজ্জার ভয়ে কিছু করতে না পেরে অনেকে দিন কাটাচ্ছেন অর্ধাহারে-অনাহারে। কোনো কোনো উদ্যোক্তাও পড়েছেন বিপদে। রাজধানীর অলিগলির অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো স্কুলের সামনে টু-লেট ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। উপায় না পেয়ে ফার্নিচারসহ গোটা স্কুল বিক্রির জন্য ঘুরছেন কোনো কোনো উদ্যোক্তা। স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপণ বাংলাদেশে নতুন সংযোজন। এর মাঝে আবার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মতো অনৈতিকতাও বাদ যায়নি। নানা খাত-উপখাতে যথেচ্ছ অর্থ আদায় করেছে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে একাদশ থেকে দ্বাদশে প্রমোশন দিতে গিয়ে এ ফাঁদ পেতেছে কিছু কলেজ। টাকা আদায়ের রশিদে দেখা গেছে, ৯টি খাতের মধ্যে টিউশন ফি, সেশন ফি, উন্নয়ন ফি, পরীক্ষার ফি, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফি, ম্যাগাজিন ফি, মিলাদ ফি, সাংস্কৃতিক উৎসব ফি, অন্যান্য ফি রয়েছে। এভাবে অভিভাবকদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করা হচ্ছে। যা অনেকের জন্যই অসহনীয়। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থী বিশেষ করে শিশু এবং তরুণদের জন্য ভীষণ মানসিক চাপের। কেবল শিক্ষা নয়, সামাজিক দূরত্ব মানা, পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া তাদেরকে আরো হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের এক জরিপে বলা হয়েছে, শতকরা ৭১ ভাগ শিশু ও তরুণ স্কুল বন্ধের কারণে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ অনুভব করছে। শিশু ও তরুণদের ওপর করোনা পরিস্থিতির প্রভাব জানতে বাংলাদেশসহ ১৩টি উন্নয়নশীল দেশে এ জরিপ চালানো হয়। এতে বাংলাদেশ, আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ব্রাজিল, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি, মঙ্গোলিয়া, নিকারাগুয়া, পেরু, ফিলিপাইন, রোমানিয়া, সিয়েরা লিওন এবং তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে শরণার্থী ক্যা¤েপ আশ্রয় নেওয়া সিরীয় শিশুরা রয়েছে।
শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা এখন সারাবিশ্বে চলছে। কিছু কিছু দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে মাস চারেক আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়ও চলে গেছে। সর্বশেষ সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় তিন দফা বাড়িয়ে আগামী ৬ আক্টোবর পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে। এ বন্ধ আর কত সময় চলবে তা কেউ বলতে পারবে না। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়েছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে কত শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে দেশের শিক্ষা খাত অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ পরিস্থিতির অবসান কবে হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে আমরা আশা করতে পারি, শিঘ্রই এ পরিস্থিতির অবসান ঘটবে। একটি কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে এ পরিস্থিতি উত্তরণে অনেকটাই সহায়ক হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।