পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বহু বছর ধরে বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানী ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর ভয়াবহ দূষণ ও দখলে অস্তিত্ব সংকটের কথা বলে আসছি। এবার উঠে এসেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এবং সমুদ্রবন্দরের লাইফলাইন কর্ণফুলী দূষণের চিত্র। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচলের প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং কর্নফুলী নদীর নাব্য বৃদ্ধিকল্পে গৃহিত আরো একটি প্রকল্প অবিশ্বাস্য রকম অতিরিক্ত পলিথিন বর্জ্যের কারণে ব্যর্থ হতে চলেছে। গতকাল একটি ইংরেজী দৈনিকে প্রকাশিত রির্পোটে জানা যায়, কর্ণফুলী নদী চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে সদরঘাট থেকে বাকলিয়াচর পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ নদীর তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণের প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় নদীর তলদেশ থেকে ৪৩ লাখ বর্গমিটার বর্জ্য অপসারণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কর্ণফুলী বক্ষে প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৪ মিটার স্তর রয়েছে বলে বুয়েটের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে। প্রকল্পের আনুমানিক প্রাক্কলন করা হলেও কাজ শুরু হওয়ার পর দেখা যায়, সেখানে ৭মিটার প্লাস্টিক বর্জ্যরে স্তর রয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুই বছর পেরিয়ে এসে প্রকল্পের কাজ হয়েছে তিরিশ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তদারকিতে চলমান এই প্রকল্পের কাজ বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে তা শেষ হতে আরো তিন বছর লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারনা করছেন।
পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণের পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা বাদ দিলেও নদী, সমুদ্র, পানি এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে অচল করে ফেলার বাস্তবতা এখন দেখা যাচ্ছে। দু’এক ঘন্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ক্রমবর্ধমান দৃশ্য আমরা দেখছি। এই পানিবদ্ধতার মূলে রয়েছে শহরের স্যুয়ারেজ লাইনগুলোতে অতিরিক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে জট। বছরের পর বছর ধরে নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং স্যুয়ারেজ লাইনের প্রতিবন্ধকতা দূর করার ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যর্থতার দায় এড়ানো যাবে না। ইতিপূর্বে বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণ ও বর্জ্য ডাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পনাহীনতা ও লেজেগুবুরে অবস্থা দেখা গেছে। সেসব প্রকল্পের কাজ যেনতেন প্রকারে শেষ করার পরও বুড়িগঙ্গার অবস্থা তথৈবচ। এমনকি কর্ণফুলী ড্রেজিং ও বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে আগের একটি প্রকল্প মাঝপথে বন্ধ করে গুটিয়ে ফেলতে হয়েছিল বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। ২০১১ সালে গৃহিত প্রকল্পে সদরঘাট জেটি থেকে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও নদী উপত্যকা সংরক্ষণে মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং কর্পোরেশনকে কাজ দেয়ার পর একই রকমের ভুল ফিজিবিলিটি রিপোর্ট প্রাক্কলনের কারণে কাজ অর্ধেক শেষ না হতেই প্রকল্প বন্ধ করে দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে কর্ণফুলীর বর্জ্য অপসারণ ও ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে নতুন সিদ্ধান্তে আসা জরুরী। যথাশীঘ্র কাজ শেষ করে নদী দূষণ রোধের স্থায়ী পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
নদীর নাব্য পুনরুদ্ধার এবং বন্দরে জাহাজ চলাচল নির্বিঘœ রাখার প্রকল্পে এমন দায়সারা প্রাক্কলণ, বাজেট ও সময়সীমা নির্ধারণের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ ও কার্যাদেশ দিচ্ছেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বারবার হোঁচট খাচ্ছে। প্রতিদিন সারাদেশে কি পরিমান পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ব্যবহার হয় এবং এর কত শতাংশ সরাসরি নদনদীতে নিক্ষিপ্ত হয় তার সঠিক হিসাব আমাদের হাতে না থাকলেও এ বিষয়টি অনুমান করা যাচ্ছে যে, বছরে লাখ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদীগর্ভে জমা হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় নদীর গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল থেকে ত্বরিৎ গতিতে বর্জ্য অপসারণের এক বছরের প্রকল্প যদি বাস্তবায়ন করতে ৫ বছর লেগে যায়, তাহলে ৫ বছরে আরো বিপুল বর্জ্য জমা হয়ে নদী চ্যানেল প্রকল্প বাস্তবায়নের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এতে একদিকে যেমন নদ-নদীর নাব্য ফেরাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, অন্যদিকে নৌ-পথও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। প্রকল্প গ্রহণের আগেই নিজস্ব সমীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা অবহিত হওয়া দরকার। নদ-নদীতে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য বর্জ্য ফেলা বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। স্যুয়ারেজ লাইনে এবং নদীতে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার নাগরিক অভ্যাস এবং নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাধ্যতামূলক পরিবর্তন আনতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে পাশাপাশি কলকারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক তরল ও ভারী বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদী বা সমুদ্রে ফেলার বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে নগর কর্তৃপক্ষ, শিল্প ও পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্লাস্টিক পণ্য ও পলিথিন উৎপাদন, ব্যবহার, নিপণন ও রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরো বেশি সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পলিথিন ও অন্যান্য কেমিক্যাল বর্জ্য নদ-নদীতে কিভাবে নিক্ষিপ্ত হয় এবং এর সাথে কারা জড়িত, সুনির্দিষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু নদ-নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করলেই হবে না, দূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।