হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্যারেড গ্রাউন্ড ময়দানে বৃক্ষমেলা শুরু হয়েছে। ৩১ জুলাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০ দিনব্যাপী এ মেলার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে বলেন, বৃক্ষমেলার উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে গাছপালার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সারাদেশ গাছে গাছে সবুজ করে তোলা। বিভিন্ন নার্সারী সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও মেলা সফল করে তোলার জন্য প্রচুর পরিমাণ বৃক্ষচারা মেলায় স্থাপিত স্টলগুলোতে জড়ো করেছেন।
মৌসুমের শুরুতে অনুষ্ঠিত এ মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। গাছ শুধু মানুষের জন্য জ্বালানি সরবরাহ বা ছায়া বিস্তার করে না, আবহাওয়া অনুকূল রাখে ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। কোন কারণে বিশেষ করে মানুষের অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে বনাঞ্চল সংকোচিত হলে দেখা দেয় ওলোট-পালট কা-। কখন কোন ঋতু আসে আর কখন যায় তা ঠাহর করা যায় না।
এক সময় বাংলাদেশ ছিল ঘুঘু ডাকা ছায়া ঘেরা দেশ। এখন ঘুঘু বিরল, গাছপালারও যাই-যাই অবস্থা। এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থানে সংকোচিত হয়ে যাওয়া বনাঞ্চল দেখে। এক সময় রাজেন্দ্রপুর ও শ্রীপুরে ছিল গভীর গজারী বন। মধুপুর গড়ে ছিল চিতাবাঘসহ নানা ধরনের পশুপাখি, পক্ষান্তরে সুন্দরবন ছিল রহস্যাবৃত এবং চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে গেলে মনে হত সবুজে ঘেরা এক দেশ। এখন সব ফাঁকা। বাইরে কিছু কিছু গাছ দেখা যায়, ভিতরে তাকালে মনে হয় খাঁ খাঁ প্রান্তর। একই অবস্থা সুন্দরবনের। সুন্দরী, মেহগনি, কেওয়া, গোলপাতার বন কিছুই আর নেই। প্রকৃতির খেয়ালে প্রতি বছরই কিছু কিছু গাছের জন্ম হয়- কিন্ত পূর্ণতা পাওয়ার আগেই তা কেটে ফেলা হয়। একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজসে কাঠ ব্যবসায়ীরা দেদারসে কাঠ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। একটি কথা প্রবাদ বাক্যের মতো চালু আছে যে, কোন ব্যক্তিবিশেষ ৫০০ সিএফটি কাঠের একটা পারমিট নাকি পেয়ে গেলে সারা বছর কাঠ আহরণ করলেও ৫০০ সিএফটি পূরণ হয় না। আর এ প্রবাদ বাক্য নাকি দেশের যে কোন স্থানের বেলায় প্রযোজ্য। এক সময় বন-বনানীতে ঘেরা তিন পার্বত্য জেলার অবস্থা খুবই খারাপ। ঐ এলাকা না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। বান্দরবন থেকে চিম্বুক ৪০ কিলোমিটার, রামু থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি ৫৫ কিলোমিটার পথ ঘুরে দেখা যায় বামুল ছাড়া আর কিছুই নেই। স্থানে স্থানে সংরক্ষিত ও পরিকল্পিত বনভূমির সাইনবোর্ড আছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কাজীর গরু হিসাবে থাকা-আর গোয়ালে না থাকারই মতো। সিলেট অঞ্চলের অবস্থাও তথৈবচ। বিশেষ করে সিলেটের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং রাস্তার দু’পাশের ছায়াঘেরা পরিবেশ আর নেই। সবই কেটে ফেলা হয়েছে; আর রোপণ করার উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সিলেট বন বিভাগের বিশাল স্থাপনা থাকলেও বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। জানা যায়, সিলেট বন বিভাগের বিভিন্ন রেঞ্জ অফিসারকে তাদের বিভিন্ন অপকর্মের জন্য অন্যত্র বদলি করা হলেও তারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সে বদলি রহিতকরণ করে আবার সিলেটেই থেকে যাচ্ছেন। এতে একদিকে সরকারি চাকরি বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে অন্যদিকে এসব কর্মচারী আরও বেশি করে দুর্নীতির সুযোগ পায়। সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন রেঞ্জ অফিসারের যোগসাজসে বন বিভাগের অনেক জমিই বেদখলে চলে যাচ্ছে। আবার এ সমস্ত কর্মকর্তা বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের নামে জমি বরাদ্দ নিচ্ছেন। জমিতে সাইন বোর্ড আছে, গাছ-গাছালি নেই। জমি ইজারা নেয়া হয়েছে কিন্তু যে উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে তা সে ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। পাহাড়ি জমি/চা বাগানের জমি ইজারা নিয়েছেন হর্টিকালচার, ফলমূল বা আদা, পিঁয়াজ চাষের জন্য কিন্তু তা ও করা হচ্ছে না। তাহলে এ জমি বন্দোবস্ত নেয়ার উদ্দেশ্যই বা কি? একই অবস্থা সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোতে। হাজার হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে। জমি ইজারা নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়, যদি যে উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে সে উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হয়।
আমরা জানি, প্রতি বছরই ডাকঢোল বাজিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে লক্ষ লক্ষ গাছের চারা রোপণ করা হয়। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এসব চারার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। এ অপচয়ের অর্থ আমরা খুঁজে পাই না। বার বার একই জায়গায় গাছ লাগানোর একটা রীতি বা নিয়ম আমাদের দেশে দীর্ঘদিন থেকে চালু রয়েছে। এর ব্যতিক্রম যেন হচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃক্ষ মেলার আয়োজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে ক্ষীণতম চেতনাও যদি সৃষ্টি করা যায় তাতেও লাভ। বৃক্ষমেলা থেকে যেসব গাছের চারা লোকজন ক্রয় করে নিয়ে যান- সরেজমিন পরীক্ষা করে দেখা গেছে- ঐসব গাছের চারার যতœ করা হয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যাও করা হয়; ফলে গাছটি বড় হয়। ফুল-ফল ধরে। আর কাঠতো আছেই। এসব গাছপালা যে অক্সিজেন সরবরাহ করে তা সবই বোনাস।
আবহাওয়া অনুকূল রাখার জন্য একটি দেশে অন্তত ২৫ ভাগ বন থাকা আবশ্যক। আমাদের দেশে আছে ৬ বা ৭ ভাগ। পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মার বনভূমির পরিমাণ মোট জমির ৬৭ ভাগ, মালয়েশিয়ার ৫৪ ভাগ, ভিয়েতনামের ৬৩ ভাগ এবং ভারতের আছে ২৭ ভাগ। আমাদের বিস্তর জমি না থাকলেও রাস্তার পাশে বেড়িবাঁধে, অনাবাদি জমিতে, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা এবং বাড়ির আঙ্গিনায় আমরা প্রয়োজনীয় সুবিধা মতো গাছের চারা রোপণ করতে পারি। এটা মোটেই কঠিন কোন কাজ নয়। প্রয়োজন যা, তা হলো উদ্যোগ, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম। এ প্রসঙ্গে প্রবীণ অবসর প্রাপ্ত বন কর্মকর্তা মকবুল হোসেনের বক্তব্যটি স্মতর্ব্য। তিনি মেলার আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আলাপ করলে বলেন, আনুষ্ঠানিকতায় কোন লাভ নেই, যদি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হওয়া না যায়। বলা বাহুল্য, তার উক্তিটি লক্ষ্য করার মতো। বনাঞ্চল গড়ে তোলার জন্য প্রতিবছর রাশি রাশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়। পালন করা হয় মেলা ও বৃক্ষ রোপণ পক্ষ বা সপ্তাহ। এ উপলক্ষে চারাও কম সরবরাহ করা হয় না। কিন্তু সর্বশেষ কি দাঁড়ায়? আগেই বলেছি, বছর বছর একই জায়গায় রোপণ করা হয় গাছের চারা। কথাটির সহজ অর্থ হচ্ছে, চারা বিতরণ ও রোপণে দায়িত্ব শেষ হয় না। কতটা রোপণ করা হলো, কতটা চারা বাঁচলো, কতটা মরলো এবং কেন মারা গেল, এর খোঁজখবর নেয়াও দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। এ খাতে প্রচুর দুর্নীতি আর অনিয়ম আছে বলেই নাকি কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার পর লাখ টাকার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় স্বার্থে এসব অভিযোগ পর্যালোচনা করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।
এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা। পরমুখাপেক্ষিতার চেয়ে মন্দ অভ্যাস আর কিছুই নেই। ব্যক্তি তো বটেই জাতীয় জীবনের জন্যও তা অপমানকর। এক সময় অর্থাৎ বাবা-দাদার আমলে মানুষের অভ্যাস ছিল বাড়িঘরে, মসজিদ, মাদ্রাসায় এমনকি পথের পাশে গাছ লাগানোর। ভালো জাতের আম, কাঁঠাল, জাম কিনে আনার পর তার বীজ মাটিতে পুঁতে দিতেন। চারা গজালে পরিচর্যা করতে ভুল হতো না। সামান্য পরিচর্যাতেই মাত্র ক’বছরে তৈরি হতো ফলবান বৃক্ষ। কারণ বাংলাদেশের মাটির গুণ এমন যে, ডাল ভেঙে মাটিতে রাখলেই বিশাল গাছ হয়ে যায়। এতে একদিকে ফলমূল ক্রয় করার জন্য বাজারে যেতে হত না অন্যদিকে বাড়ির পরিবেশ থাকতো ছায়া স্নিগ্ধ। পাশাপাশি প্রকৃতির রাজ্যে সৃষ্টি হত অনুকূল প্রতিক্রিয়া। যে কোন কারণেই হোক সে অভ্যাস নতুন প্রজন্মের মধ্যে নেই। প্রবীণদেরতো ভোলারই কথা। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং নানা রকম প্রচার ও সচেতনতার মাধ্যমে এর প্রতিকারের ও উদ্যোগ গ্রহণ করা কল্যাণকর হতে পারে।
সারা পৃথিবীর মানুষ এখন পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন। স্বনির্ভর আন্দোলনে ব্যস্ত। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রয়োজন মিটানোর চেষ্টা করছে। জাপানে কাঠের প্রয়োজন বেশি কিন্তু উৎপাদন কম। তবুও তারা তাদের চাহিদা পূরণে উৎপাদন বাড়াতে তৎপরতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তারা সকল ক্ষেত্রের মত এ ক্ষেত্রেও স্বনির্ভর ও সফলকাম হবেই।
আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমাদের স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। হয়ত সকল ক্ষেত্রে সফল হতে নাও পারি। তবে চেষ্টা করলে অনেক ক্ষেত্রেই স্বনির্ভর হতে পারব বলে আমি মনে করি। অন্তত বনায়ন করে, বনাঞ্চল সৃষ্টি করে আমাদের চাহিদা পূরণ করতে অসুবিধার কোন কারণ নেই। আমাদের দেশের মাটি বনাঞ্চল সৃষ্টির জন্য উর্বর, আবহাওয়াও অনুকূল আছে। আমরা যদি ব্যর্থ হই, উদাসীন হই তাহলে জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মর্যাদার অধিকারী হবো কিভাবে? এক্ষেত্রে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন কি নেই?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।