পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চামড়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি শিল্প। নির্দিষ্ট কিছু কারণে রফতানিমুখী এ শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশের চামড়াশিল্প এখন সংকটের মুখে। দেশি ও বৈশ্বিক মিলে সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। উদ্বেগের বিষয়, এ শিল্প থেকে গত দুই বছরে অব্যাহতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমছে। কাঁচামালের সহজলভ্যতার পাশাপাশি মূল্য সংযোজনের হিসেবে কোনো একটি নির্দিষ্ট খাত থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়ের অন্যতম বড় উৎস দেশের চামড়া শিল্প। কিন্তু এ সত্য শুধু কাগজে কলমেই।
নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রতি মাসে আমদানি করছে প্রায় ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া। করোনা পরিস্থিতির কারণে গতবারের চামড়াই এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে পারেনি। এতে সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। নতুন চামড়া সংরক্ষণে স্থান সংকট রয়েছে। অনেক ট্যানারি এখনো উৎপাদনে যায়নি। এসব কারণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয় ১১৩ কোটি ডলার। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ কোটি ডলারে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। কিন্তু ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রফতানি আয় অস্বাভাবিক কমে ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ওই অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১০১ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ ক্ষেত্রে আয় কম হয়েছে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া খাত থেকে ৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যদিও এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ আয় কমেছে।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১১০টি রফতানিমুখী কারখানায় চামড়ার পাদুকা তৈরি হয়। এর মধ্যে এপেক্স, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশ, বে ট্যানারি, জেনিস, আকিজ, আরএমএম, বেঙ্গল এবং আরও রয়েছে নিজস্ব ট্যানারি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এর বাইরে শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এমন কারখানার সংখ্যা ২০৭টি। চামড়া শিল্পের যোদ্ধাদের মতে ফরাসিদের ফ্রেঞ্চ কাফের পর মানের দিক থেকে আমাদের দেশের চামড়াই দুনিয়ার সেরা। এরকম স্মুথ গ্রেইনের চামড়া বিশ্বের অন্য কোথাও মেলে না। তারপরও পিছিয়ে ছিল আমাদের দেশের চামড়া শিল্প। কিন্তু গত তিন অর্থবছর থেকে সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে চামড়াজাত পণ্য রফতানির পরিমাণ। কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, চামড়ার জুতা উৎপাদনকারী প্রধান দেশ চীন, ভিয়েতনাম এবং ব্রাজিল এ খাত থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের প্রধান আকর্ষণ কেন্দ্র। কারণ, এ শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত কাঁচামাল, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সস্তা শ্রম এবং জুতা তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা।
বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে চামড়াশিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে নেয়ার সময় বলা হয়েছিল, ট্যানারিগুলো পরিকল্পিত শিল্পনগরে এলে বুড়িগঙ্গা দূষণ থেকে বাঁচবে। শিল্পনগরী হবে কমপ্লায়েন্স। বড় ব্র্যান্ডগুলো আর বাংলাদেশী চামড়ায় তৈরি জুতা-ব্যাগ কিনতে কোনো দ্বিধা থাকবে না। চামড়া খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। ইউরোপে মন্দার কারণে রপ্তানি আদেশ চার ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। ইউরোপে তিন ডলারের পণ্যের দাম নেমে গেছে দেড় ডলারে। স¤প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে ফিনিশড লেদারের সবচেয়ে বড় বাজার চীনের ব্যবসা থমকে গেছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবর্গফুট কাঁচা চামড়া ১৩০ টাকায় বেচাকেনা হলেও, এখন তা ৩০ টাকায় নেমে এসেছে বিশ্ববাজারের দরপতনের ছুঁতোয়।
দাম না পেয়ে চামড়া মাটিতে পুতে ফেলা, নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা আগাম আঁচ করতে পেরে অনেকে কুরবানির চামড়া মাদ্রাসা, এতিমখানায় দান করেছেন। সরকারিভাবেই এবার কমিয়ে দেয়া হয়েছে গরু-ছাগলের চামড়ার দর। গত বছরের চেয়ে কমিয়ে এবার ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা বেঁধে দেয়া হয়। গত বছর এ দাম ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অন্যদিকে খাসির চামড়া সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্যানারি মালিকরা নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কেনার ঘোষণা দিয়েছিল। এ বছর চামড়া যাতে নষ্ট না হয় এবং নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিয়েছিল। বাস্তবে দেখা গেছে, তার কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
এক সময় সোনালি আঁশ নামের পাটশিল্প, বিদেশে পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে এ শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এ দেশের কৃষি খাত বিশেষ করে ধান ব্যবসাও সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে। ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। প্রায় একইভাবে চামড়াজাত পণ্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি পণ্য হওয়া সত্তে¡ও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে শিল্পটি বিপন্ন হতে চলেছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। এ দুইয়ের কারসাজিতে চামড়া শিল্প আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকায় যাচ্ছে বাংলাদেশের জুতা ও চামড়াজাত পণ্য। এতে সামান্যতম সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের জন্য চামড়া শিল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত, যা সুষ্ঠু পরিচালনা ও যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও এ খাতের বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। চামড়াশিল্পের নানাবিধ সংকটের পাশাপাশি করোনা নতুন সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ভাইরাসের কারণে বিশ্বের চামড়ার প্রধান বাজার চীন, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, হংকং ও ইতালিতে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া চীন-আমেরিকা বাণিজ্য বিরোধে চামড়াজাত পণ্যের ওপর বাড়তি সংকট তৈরি করেছে। চীনের চামড়াপণ্যের প্রধান ক্রেতা আমেরিকা। চীন পণ্য উৎপাদন করে আমেরিকায় রপ্তানি করত। অভ্যন্তরীণ বিরোধে জড়িয়ে চীন আমেরিকায় রপ্তানিবাজার হারিয়েছে। আর চীনের চামড়াপণ্যের জন্য বেশির ভাগ কাঁচামাল আমদানি হতো বাংলাদেশ থেকে। এখন যেহেতু চীনের চামড়াপণ্যের বাজার মন্দা, সেহেতু আমাদের রপ্তানিতেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। যার ফলে এ দেশের চামড়াশিল্পের পথ আরও একধাপ সংকুচিত হয়ে গেছে।
এ দেশে কোরবানি থেকে সংগৃহীত চামড়ার মূল্য বেশির ভাগ চলে যায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয়। বিশেষ করে এতিমখানা, মাদ্রাসা, ফকির-মিসকিন, হতদরিদ্র মানুষ সাহায্য হিসেবে চামড়া বিক্রির টাকা পেয়ে থাকে। এতে প্রান্তিক অতি দরিদ্র শ্রেণীর মানুষই বেশি উপকৃত হয়। এক অর্থে চামড়া বিক্রির অর্থ দারিদ্র্য নিরসনে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়ে থাকে। সংগৃহীত চামড়াগুলো অধিক নি¤œমূল্যে বিক্রি হলে কিংবা অবিক্রীত অবস্থায় থেকে গেলে শিল্পের পাশাপাশি দরিদ্ররাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বঞ্চিত হয় সাহায্য প্রত্যাশী অসহায় মানুষ।
আবারো বলতে হচ্ছে, চামড়া সাধারণ কোনো শিল্প নয়, দেশের অন্যতম বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শিল্প। তাই দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, যত দ্রæত সম্ভব এ শিল্পের সমস্যাগুলো সমাধান করা। তাহলেই চামড়াশিল্প রক্ষা সম্ভব হবে। তাই সময়ক্ষেপণ না করে চামড়াশিল্পের রক্ষার কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাটি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।